ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষক জমিতে বেগুন বিক্রি করছে এক টাকা কেজি ॥ শসা বিক্রি করছে দুই টাকা কেজি

করোনায় লালমনিরহাটে সবজির বাজারে ধস নেমেছে

প্রকাশিত: ০৯:০১, ৩ এপ্রিল ২০২০

  করোনায় লালমনিরহাটে সবজির বাজারে ধস নেমেছে

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট ॥ করোনাভাইরাস সংক্রামণ রোধে দেশে চলছে অঘোষিত লকডাউন যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে লালমনিরহাটের সবজি চাষীদের উৎপাদিত ফসলের উপর। উৎপাদিত সবজির দাম নেই। কৃষক খেত থেকে সবজি তুলে পাইকারদের কাছে ৫০ কেজির এক বস্তা বেগুন বিক্রি করছে ৪০/৫০ টাকায়। ছোট করলা ৫০ কেজির এক বস্তা বিক্রি করছে ৪/৫শ’ টাকায়। শসা ৫০ কেজি এক বস্তা বিক্রি করছে ৯০/১০০ টাকায়। পাইকারি বাজারে সবজি বেচে কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠছে না। এমন কি সবজি তুলতে কৃষি শ্রমিকের মজুরি পর্যন্ত উঠছে না। তাই অনেক সবজি চাষী খেতের সবজি না তুলে খেতে নষ্ট করে দিচ্ছে। কেউ কেউ করোনায় কর্মহীন নিজগ্রামের হতদরিদ্র শ্রমজীবী পরিবার, দরিদ্র পরিবার, নিম্নবিত্ত পরিবার ও প্রতিবেশীদের যত প্রয়োজন সবজি খেতে উৎপাদিত বেগুন ও শসা বিনামূল্যে তুলে নিতে উৎসাহিত করছে। এতে করোনায় লকডাউনে পরে কর্মহীন দরিদ্র পরিবারগুলোকে বাজার থেকে সবজি কিনতে হচ্ছে না। সবজির দাম না পেয়ে মহাবিপাকে পড়েছে সবজি চাষীরা। তারা কৃষির এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষক সহায়তা প্রণোদনা হিসেবে সরকারের কাছে কৃষি উপকরণ, সার, কীটনাশক ও বীজে বেশি করে ভর্তুকি সহায়তা দাবি করেছেন। ধানের মৌসুমে ধানের দাম পায়নি কৃষক। তাই ধানের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানা বৈচিত্র্যময় সব ধরনের সবজি চাষ করছে। এ জেলায় মোগলহাট, কুমরিরহাট, কমলাবাড়ি, সাপ্টীবাড়ি, দৈই খাওয়া, ভেলাগুড়ি, জোংরা, গড্ডিমারী, হলদিবাড়ি, মহিষখোচা, পারুলিয়া, ডাউযার বাড়িসহ তিস্তা নদীর জেগে উঠা চরে চাষ হয়েছে বেগুন, আলু, ছোট করলা, শসা, লাউ, পেঁপে, কচুসহ নানা সবজি। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রামণ রোধে চলছে দেশে লকডাউন। তাই সবজির অন্য জেলার পাইকার স্থানীয় বাজারে নেই। হাটবাজারগুলোতে সমাগম বন্ধ। সবজির বাজার খোলা থাকলেও চাহিদা অনেক কমে বাজারে ক্রেতা হ্রাস পেয়েছে। তাই সবজির বাজারে প্রভাব পরেছে। সবজির বাজার এমন ছিল না। শীতের শুরুতে সবজির বাজার চাঙ্গা ছিল। সেই সময় বেগুন ৫০ কেজির বস্তা এক হাজার থেকে ১২শ’ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছোট করলা ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হয়ে ছিল ২২শ’ টাকা। শসা ৫০ কেজি বিক্রি হয়ে ছিল ২ হাজার টাকায়। করোনায় পাল্টে গেছে গ্রামীণ অর্থনৈতিক চিত্র। চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি হঠাৎ নিম্নগামী। উল্টোপথে হাঁটছে। ধস নেমেছে। যার প্রভাব সবজির বাজারে এখন সবজির দাম নেই। সবজি খেত থেকে সবজি তোলার মজুরি উঠছে না। এক মজুর সারাদিনে খেত থেকে ছোট করলা সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই মণ তোলা যায়। বেগুন ৩/৪ মণ তোলা যায়। শসা তোলা যায় প্রায় ৫/৭ মণ। বর্তমান মূল্য বিবেচনায় সবজি উত্তোলনের মূল্য উঠে না। তাই কৃষি খামারে কৃষক পুরুষ শ্রমিকের পরিবর্তে নারী শ্রমিক দিয়ে শস্য খেত থেকে তুলছে। নারী শ্রমিক কম মূল্যে শ্রম বিক্রি করছে। পুরুষের তুলনায় অর্ধে মূল্যে নারী শ্রমিক পাওয়া যায়। কুমড়ির হাটের কৃষক মোঃ আব্দুল মজিদ (৪৫) জানান, এক বিঘা জমিতে বেগুল চাষ করতে খরচ পড়ে প্রায় ১২ হাজার টাকা। উৎপাদন হয় প্রায় এক শ’ মণ। ছোট করলা এক বিঘা জমিতে চাষ করতে খরচ হয় ২৫ হাজার টাকা। উৎপাদন হয় প্রায় ৬০/৮০ মণ। শসা সারাবছর আবাদ করা যায়। এক বিঘা জমিতে আবাদ করতে খরচ হয় প্রায় ২২ হাজার টাকা। উৎপাদন হয় প্রায় দেড় শ’ মণ। বর্তমানে সবজির বাজার অনুযায়ী কৃষক ক্ষতিতে রয়েছে। তবে মৌসুমের শুরুতে দাম পাওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ গড়ে কমে এসেছে। এক সময় ছিল উত্তরের জেলা লালমনিরহাটে বছরে মাত্র দুইটি ফসল কৃষক উৎপাদন করত। কোন কৃষক বছরে একবার ধান ও পাট ফসল উৎপাদন করত। কোন কৃষক বছরে দুই বার ধান আবাদ করত। কেউ আবার ধান ও তামাক আবাদ করত। খুব সীমিত পরিসরে কোন কোন কৃষক ধান ও শীতের সবজি চাষ করত। এখন উত্তরের কৃষক ও কৃষি পাল্টে গেছে। কৃষি পণ্য উৎপাদনে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। কৃষি ফসলে এসেছে নানা বৈচিত্রতা। এখন একখন্ড উঁচু ফসলের জমিতে ১২ মাসে ৪ ফসল উৎপাদন হয়। কৃষক একই জমিতে ধান, পাট, ভুট্টা, তামাক, গম, সরিষা ও সবজিসহ তার পছন্দের নানা ফসল বছরে ৪ বার চাষ করছে। নিচু জমিতে ধান, পাটের সঙ্গে কৃষক একই জমিতে মাছ চাষ করছে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ও কৃষি নিয়ে করছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। গ্রামে সশিক্ষিত কৃষক ও অর্ধশিক্ষিত অভিজ্ঞ কৃষক কৌতূহলী হয়ে নিজ উদ্যোগে কৃষির নতুন নতুন জাত নিয়ে গবেষণা করছে। কেউ কেউ সফল হয়েছে। যার প্রমাণ কৃষক হরি বর্মণ। তার নামে অধিক ফলনশীল ধানের জাত আবিষ্কার করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়ে ছিল। হৈইচৈই ফেলে দিয়ে ছিল। এক সময় উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট জেলা ছিল মঙ্গাকবলিত জেলাগুলোর একটা। এই জেলায় খাদ্যশস্য, সবজি চাষে ছিল ঘাটতি। এ জেলার মানুষের খাদ্য, সবজির ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে অন্য জেলা হতে খাদ্যশস্য, সবজি আনতে হতো। কিন্তু এখন চিত্র উল্টো। ধান চাষে, সবজি চাষে, দুধ উৎপাদনে, মৎস্য চাষে, গরু, ছাগল পালনে পোল্টি খামার গড়ে তুলে কৃষক ও ছোট ছোট খামারিরা জেলার চাহিদা মিটিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের অন্য জেলায় উদ্ধৃত খাদ্যশস্য, সবজি, মাছ, দেশী ফলমূল প্রেরণ করে আসছে। উত্তরাঞ্চল এখন খাদ্যশস্য উৎপাদনের ভা-ারে পরিণিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব সরকার। কৃষি অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতি ১০ বছরে মজবুত ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে গিয়ে ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস সেই অর্থনীতিতে খলনায়ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। আবারও গ্রামীণ অর্থনীতি নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে।
×