ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তম চক্রবর্তী

রাজনীতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল শেখ হাসিনার হাতে

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১ জানুয়ারি ২০১৮

রাজনীতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল শেখ হাসিনার হাতে

কঠোরহস্তে জঙ্গী-সন্ত্রাস দমন, উন্নয়ন দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল আর মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নতুন প্রজন্মের গণজাগরণ। বিদায়ী বছর ২০১৭ কেমন গেল? এ প্রশ্নের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে পুরো বছরের রাজনীতিকে এমননিভাবে এক কথায় তুলে ধরেছেন বিশ্লেষকরা। মোদ্দাকথা, উন্নয়নের মাধ্যমেই বিএনপি-জামায়াত জোটকে বছরজুড়ে দমিয়ে রাখতে সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে বছরজুড়েই কার্যত অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের। বিদায়ী বছরে রাজপথে ছিল না বড় ধরনের কোন সংঘাত, নাশকতা কিংবা অতীতের মতো মানুষ পুড়িয়ে হত্যার মতো কোন ঘটনা। ছোটখাটো কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা, রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ানোর চেষ্টা কিংবা সভা-সমাবেশ থেকে সরকার উৎখাতের হুমকি দেয়া হলেও বাস্তবে রাজপথে কার্যত নামতেই পারেনি বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা। বরং বিদায়ী বছরে মানুষকে স্বস্তি এবং বাংলাদেশকে উন্নয়ন-অগ্রগতির মিছিলটি আর বৃহৎ করতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। পুরো বছরই রাজনীতির মাঠ শান্ত থাকলেও দফায় দফায় জঙ্গী তৎপরতা, বিমান ছিনতাই করে গণভবনে আক্রমণের গোপণ পরিকল্পনা ফাঁস এবং সবশেষ রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে সরকারকে কিছুটা ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। বাকি সময়ে মোটামুটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ রেখেই বিদায় নিল আলোচিত একটি বছর, ২০১৭ সাল। বিদায়ের অন্তিম পথে ২০১৭ বছরটি ইতিহাসের পাতায় রেখে গেছে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা। বিদায়ী বছরে ছিল না প্রতিহিংসা কিংবা সহিংসতার রাজনীতি। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত এখন ইতিহাসের বিষয়। পুরো বছরেই বিএনপি ছিল দৌড়ে, আত্মসমালোচনার মুখোমুখি। মাঠে ছিল শুধু আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের সবকিছুই এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক নিয়ন্ত্রণে। বিগত বছরগুলোর মতো বিদায়ী বছরেও রাজনীতির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণই ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। বিদায়ী বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের রোহিঙ্গা নিধনের প্রায় দেশটির প্রায় সাত লাখ নাগরিকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ঘটনায় বিশ্ব নেত্রীর আসনেই শেখ হাসিনাকে বসানো হয়নি, বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তাঁকে ‘বিশ্ব মানবতার নেত্রী’ হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাজনীতির সফলতা ও ব্যর্থতার বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু বিদায়ী বছর ২০১৭ সালেই নয়, বরং ২০১৩ সালের ৫ মে সরকার উৎখাতে বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতের ষড়যন্ত্র ও নীলনক্সা ব্যর্থ করার পর থেকেই পুরো রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। এরপর থেকে বিদায়ী বছরের শেষ দিন পর্যন্ত রাজনীতির মাঠে মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারেনি রাজনৈতিক প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াত কিংবা সাম্প্রদায়িক অপশক্তিরা। তবে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা হচ্ছে বিদায়ী বছরে বর্ষীয়ান রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, এবিএম মহিউদ্দিন আহমেদসহ প্রায় ২৩ জন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন। যাঁদের অনেকেই ছিলেন দেশের ইতিহাতের কালের সাক্ষী। কঠোর দমননীতির পরিবর্তে দক্ষ হাতে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নয়ন-অগ্রগতির মিছিলে শামিল করে, আন্তর্জাতিক সমর্থন ও পুরস্কার অর্জন এবং দেশের অর্থনীতিকে অতীতের সকল সময়ের তুলনায় শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর মাধ্যমেই বিএনপি-জামায়াতসহ দেশী-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। মোদ্দাকথা, উন্নয়নের মাধ্যমেই বিএনপি-জামায়াত জোটকে বছরজুড়ে দমিয়ে রাখতে সক্ষম হন তিনি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে কার্যত অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা। বছরের শুরুতেই নতুন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ শুরু করেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শেষে সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিদায়ী বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি সাবেক সচিব কেএম নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে পাঁচ সদস্যের গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দেন রাষ্ট্রপতি। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন। নতুন নির্বাচন কমিশন বছরের শেষে ২১ ডিসেম্বর দেশের ইতিহাসে সফল ও সুষ্ঠু রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সম্পন্নের মাধ্যমে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতার জানান দিয়েছে। ওই নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটলেও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন নির্বাচনটি সুষ্ঠু ছিল। বিদায়ী বছরেও শুরুটা হয়েছিল সাম্প্রদায়িক জঙ্গী অপতৎপরতার মাধ্যমে। বিগত বছরগুলোর মতো বিদায়ী বছরেও জঙ্গীরা তাদের শক্তিমত্তার জানান দিতে মাঝে মাঝে মধ্যেই নানা অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জঙ্গী বিরোধী জিরো টলারেন্স ও শক্ত অবস্থান, বছরজুড়েই বেশ কয়েকটি সফল অপারেশনের মাধ্যমে জঙ্গীদের খতম করে জনমনে শান্তি ও স্বস্তি দিতে সক্ষম হয়েছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া প্রায় পুরো বছরই স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উন্নয়নের মহাসড়কে দেশের যাত্রা, আর জনমনে শান্তি ও স্বস্তি দিয়েই কালের গর্ভের হারিয়ে গেছে ২০১৭ সাল। স্বস্তি-উন্নয়ন দিলেও সুখে ছিল না আওয়ামী লীগ বছর ধরেই রাজনীতির লাটিমের সুতা শেখ হাসিনার হাতে থাকলেও মাঝে মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে। শক্ত হাতে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অশুভ তৎপরতা ও জঙ্গী হামলা মোকাবেলা করে দেশের মানুষকে স্বস্তি এনে দিলেও সারাদেশে অব্যাহত অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব ও বিবাদ মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে দলটি। বিদায়ী বছরে কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগের মুখোমুখি ছিল আওয়ামী লীগই। দল মনোনীত প্রার্থী আর বিদ্রোহী প্রার্থিতার ছড়াছড়িতে অনেকস্থানেই দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ ক’জন কর্মী- সমর্থককে জীবন দিতে হয়েছে। বছরের শেষ হওয়ার ৯ দিন আগেও শুধু দলীয় মতানৈক্যের কারণে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শরিক জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজিত হতে হয়েছে। তবে বিদায়ী বছরজুড়েই আওয়ামী লীগ নতুন কমিটি সারাদেশের মেয়াদোত্তীর্ণ সংগঠনের সম্মেলনের মাধ্যমে পুনর্গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। দলের অধিকাংশ সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনও সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে। দু’ভাবে বিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ কমিটিতেও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে এসেছে নতুন মুখ। একই সঙ্গে প্রায় এক শ’টি থানা ও ওয়ার্ডেও সাংগঠনিকভাবে অভিজ্ঞ ও ত্যাগী নেতাদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে মূল্যায়ন করেছেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। দীর্ঘদিন পরে হলেও মহানগর কমিটি গঠন করায় রাজধানী ঢাকায় সাংগঠনিকভাবে এখন বিগত সময়ের তুলনায় এখন অনেক শক্তিধর সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ২০১৮ সাল হচ্ছে নির্বাচনী বছর। নির্বাচনের মাত্র বাকি আর একটি বছর। কিন্তু নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে সারাদেশেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দ্বন্দ্ব-বিবাদ ততই যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। নির্বাচনী মাঠে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াত অনেকটাই কোণঠাসা এবং অজনপ্রিয় হলেও অধিকাংশ নির্বাচনী আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারাতে যেন মরিয়া আওয়ামী লীগই। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিদায়ী বছরে সম্মেলনের মাধ্যমে তৃণমূলে নতুন কমিটি গঠন করতে পারলেও দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল-বিবাদ নিরসনে ততটাই ব্যর্থ হয়েছেন। বিদায়ী বছরে সরকারের সাফল্যে বা অর্জনের কমতি ছিল না। একের পর এক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিজয়, সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সাফল্যে অর্জনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, দেশীয় অর্থনীতি মজবুত, উপচে পড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিও। পুরো বছরেই রাজপথে ছিল না সরকারবিরোধী আন্দোলন কিংবা সংঘাত-সাংঘর্ষিক রাজনীতি। রাজনৈতিক প্রধান প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক সঙ্কটে ফেলার কৃতিত্বও সরকারের ঝুলিতে। এত কিছুর পরও রাজনৈতিক দল হিসেবে বিদায়ী বছরে খুব একটা স্বস্তিতে ছিল না আওয়ামী লীগ। শুধু দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল-সংঘাত আর গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা জ্যেষ্ঠ নেতাদের লাগামহীন বেফাঁস মন্তব্যের কারণে বিদায়ী বছরের বিভিন্ন সময় চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে দলটিকে। ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকা- আর দলীয় কোন্দল সামাল দিতে না পারার ব্যর্থতায় সরকারের বিপুল অনেক অর্জনই যেন ম্লান করে দিয়েছে। রাজপথে দাঁড়াতেই পারেনি বিএনপি বিদায়ী বছরের শুরুতে ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় বুক বেঁধেছিলেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। তবে বছরের শেষ দিকে এসে সে আশা হতাশায় রূপ নিয়েছে। রাজপথে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। একের পর এক ‘ইস্যু’ হাত ছাড়া করে রাজপথে সক্রিয় আন্দোলন থেকে এক প্রকার ছিটকেই পড়েছে তারা। সর্বশেষ রংপুর সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল বিএনপি। মেয়র পদে জিতলে হয়ত দলটিতে ‘নতুন প্রাণের’ সঞ্চার হতো, তবে তা হয়নি। দলীয় প্রার্থীর ব্যাপক ভরাডুবি ও তৃতীয় স্থানে অবস্থান নেতাকর্মীদের হতাশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর বিএনপির হতাশা বাড়িয়ে এ বছরই পূর্ণ হয়েছে দলের ক্ষমতার বাইরে থাকার ১১ দশক। এর আগে কখনই এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকার রেকর্ড নেই দলটির। সারাদেশে দলটির সাংগঠনিক যে ভঙ্গুর দশার সৃষ্টি হয়েছে, আগামী নির্বাচনেও জয় নিয়েও চরম উৎকণ্ঠা ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে। এমনিতেই বিদায়ী বছরে বল্লাহীন দুর্নীতির অভিযোগে আদালতে হাজিরা দিয়েই সময় পার করতে হয়েছে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে। আদালতে দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় ৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত তারেক জিয়াকে লন্ডনে ফেরারি জীবন পার করতে হয়েছে। আর এতিমের টাকা আত্মসাতের মামলা এখন শেষ পর্যায়ে। দু’এক মাসের মধ্যে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির রায় হবে। বিএনপি নেতাদের আশঙ্কা, মামলাটির সাক্ষ্য-প্রমাণ যেভাবে আদালতে উঠে এসেছে তাতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাজার দ- ঘোষিত হতে পারে। তেমনটি হলে আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না, তা নিয়েও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সংশয়-শঙ্কা রয়েছে। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে বছরের শেষের দিকে বিশ্ব মিডিয়ায় খালেদা জিয়ার সৌদি আরবে শপিং মলসহ শত শত কোটি টাকার সম্পদ থাকার সংবাদে। এ সংবাদটি দেশের গণমাধ্যমে ও ক্ষমতাসীন দলটির পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে প্রচারের কারণে বিএনপির তৃণমূল নেতারা মানসিকভাবে আরও ভেঙ্গে পড়েছে। বরং বিদায়ী বছরেও বিএনপির মাঠের নেতারা নিশ্চিত হতে পারেনি যে, আগামী নির্বাচনে তাদের দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না। সভা-সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়াসহ বিএনপির নেতারা নির্দলীয় সরকার ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বললেও দলটির সব নেতারাই নিশ্চিত যে, বিএনপিকে বর্তমান সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি যে মহা ভুল করেছে, আগামী নির্বাচনেও সেই ভুল করলে দলটির অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। এ বাস্তবতা মেনেই বিএনপির নীতিনির্ধারক নেতারা বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। স্বাধীনতার পক্ষের সকল মানুষ এমনকি বিএনপির অনেক প্রভাবশালী নেতাও জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য আহ্বান জানালেও দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তা গ্রহণ করেননি। অস্তিত্বের সঙ্কটে থাকা জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই তিনি আগামী দিনেও রাজনীতির পথে হাঁটতে মরিয়া। বিদায়ী বছরে একটি আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়েও রাজপথে ব্যর্থ হয়েছে দলটি। দু’তিনটি জনসভা, সমাবেশ, আর প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করে দলটির কয়েক নেতার সরকারবিরোধী বক্তব্যে ছাড়া আর কোন অর্জনই নেই দলটির। ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ অবস্থা জাতীয় পার্টির দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিরোধী দলের আসনে থাকা জাতীয় পার্টির অবস্থা হয়েছে ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’ প্রবাদের মতোই। বিদায়ী বছরটিতে এই দলটির নেতারা ক্ষণে ক্ষণে ভোল পাল্টানোর রাজনীতিতে যুক্ত ছিল। নির্বাচন বর্জনের বিএনপির ভুলের মাশুল জাতীয় পার্টিকে সরকার ও বিরোধী দলে একসঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ এনে দিলেও তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে দলটি। সংসদের ভেতরে-বাইরে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ সরকারের ভাল কাজগুলোর প্রশংসা করলেও দলটির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ তাঁর দ্বৈত রাজনীতির চরিত্র বদলাতে পারেননি বিদায়ী বছরেও। তবে বছরের শেষ সময়ে গত ২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনীত মেয়র প্রার্থীর এক লাখের মতো ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হওয়ার ঘটনা একটি বড় ধরনের চমকই ছিল রাজনীতির মাঠে। ক্ষণে ক্ষণে মত পাল্টালেও দলটির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ তাঁর জন্মস্থান রংপুরে যে এখনও জনপ্রিয় তার প্রমাণ অন্তত দিতে পেরেছে জাতীয় পার্টি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনী বছরে এবারও তুরুপের তাস হচ্ছে জাতীয় পার্টি। বৃহত্তর রংপুর ও দেশের হাতেগোনা আরও কয়েকটি নির্বাচনী আসনে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থান ও ভোট ব্যাংক রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে তবে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আবারও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোট হবে। দলটির প্রধান ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই তাঁর দল জাতীয় পার্টি অংশ নেবে। দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টি দুই ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। বিএনপি নির্বাচনে এলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহাজোটগতভাবেই তারা নির্বাচনে অংশ নেবে, আর বিএনপি এবারও বয়কট করলে তারা সারাদেশের তিন শ’ আসনেই প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে যাবে। তবে বিদায়ী বছরের ব্যর্থতা কাটিয়ে তুলতে নতুন বছরের শুরুতেই সারাদেশে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে জাতীয় পার্টি। বিশেষ করে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক শক্ত ভিত্তি থাকা আসনগুলোতে ধারাবাহিকভাবে সভা-সমাবেশ ও নির্বাচনী প্রচারে থাকবেন এইচএম এরশাদসহ দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। খাদের কিনারে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত ২০১৫ সালে জামায়াত-শিবিরের ভয়াল তান্ডব-সহিংসতা ও জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার পৈশাচিকতা দেশবাসীর মনে এখনও দাগ কেটে রয়েছে। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে অঙ্গার করে একাত্তরের ঘাতক দলটির উল্লাস নৃত্যও দেখেছে বিশ্ববাসী। সেই বীভৎস্য আন্দোলনে পরাজিত হওয়ার পর বিদায়ী একটি বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে দলটি দেশের কোথাও সামান্যতম মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। একদিকে জামায়াতের বাঘা বাঘা নেতাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে, অন্যদিকে শত শত মামলায় জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার-সন্ত্রাসীদের গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থেকেই বছরটি পার করতে হয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পর একথায় গভীর খাদের কিনারে অস্থিত্বের সঙ্কটে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী এই সংগঠনটি। বিদায়ী বছরেও আন্দোলন করা তো দূরের কথা, প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়াতেই পারেনি দলটির নেতাকর্মীরা। বছর ধরেই আত্মগোপণে থেকে দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র করলেও সরকারের কঠোরতার সামনে টিকে থাকতে পারেনি দলটি। বরং বছরজুড়েই দেশব্যাপী জামায়াত নিষিদ্ধের দাবির মুখে রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার মহাতঙ্কে ভুগছে আত্মগোপনে থাকা দলটির নেতাকর্মীরা। সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে একের পর এক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাশেম আলী, কাদের মোল্লা ও সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকরের পর রাজপথে সামান্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও ব্যর্থ হয়েছে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্তরা। জামায়াতের সব শীর্ষ নেতার অধিকাংশই কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্টে মৃত্যুর প্রহর গুনছে, ছয়জনের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। অনেকেই আমৃত্যু কারাভোগের সাজা খাটছেন। সভা-সেমিনা ও বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ বাম দলগুলো বিদায়ী বছরেও রাজপথে তেমন কোন তৎপরতা ছিল না বহুধা বিভক্ত দেশের বামপন্থী দলগুলোর। রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ ইস্যুতে সিপিবি ও বাসদ ঐক্যবদ্ধভাবে কিছু কর্মসূচী পালন করলেও বাকি দলগুলোর তেমন কোন তৎপরতা দেখা যায়নি বিদায়ী বছরে। সভা-সেমিনার আর বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল বেশিরভাগ বাম দলের কর্মকান্ড-। এ ছাড়া বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রচেষ্টা বছরের বিভিন্ন সময়ে নেয়া হলেও তা সফল হয়নি। আবার জনসমর্থন হারিয়ে অনেক বামপন্থী দল এখন কার্যত নাম সর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে। একমাত্র সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ছাড়া রাজপথে অন্য বাম দলগুলোর অস্তিত্ব খুব একটা দেখা যায়নি।
×