ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মন্তব্য ॥ প্রশ্নটা তাই ওখানেই -টিটো চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭

মন্তব্য ॥ প্রশ্নটা তাই ওখানেই -টিটো চৌধুরী

শিরোনামের অভ্যন্তরীণ স্থাপনা তার কাল ও কারণের ত্রিবেণী সঙ্গমেই প্রসঙ্গের অবতারণা। আমাদের মহান স্বাধীনতা শুধুমাত্র ন’মাসের মুক্তিযুদ্ধের ফসল। এমন একটি মন্তব্য করা হলে সর্বতোভাবেই ভুল হবে। কারণ তাতে ইতিহাস তার অবিচ্ছেদ্য বিস্তৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। সেইসঙ্গে ইতিহাসের মূলেও ঘটবে অনাকাক্সিক্ষত ছেদ। তাই আমাদের মহান স্বাধীনতা ও তা অর্জনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উন্মোচনের জন্য আমাদেরকে একটি সুনির্দিষ্ট পথে এগিয়ে তার উৎসে পৌঁছুতে হবে। আর এই উৎসমুখী পদযাত্রায় অনিবার্যভাবেই আমাদেরকে পৌঁছে যেতে হবে বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ধারায় বাংলা ভাষা তদানীন্তন পাকিস্তানের একটি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল শুধু তাই নয়। বায়ান্নর একুশের মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম বাঙালী জাতিসত্তার উম্মেষ ঘটেছিল। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সূচিত হয়েছিল বাঙালীর ভাষাভিত্তিক একটি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের। বাঙালী বিদ্বেষী পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রযন্ত্রটি শুরু থেকেই বাঙালী শোষণ ও নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে আসছিল। আর পাকিস্তানের এই শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আপামর বাঙালীর ক্ষোভ ও অসন্তোষ ক্রমেই দানা বেঁধে উঠছিল। সময়ের ধারাবাহিকতার এক পর্যায়ে জমাটবাঁধা বাঙালীর ক্ষোভ ও অসন্তোষ এক সোচ্চার প্রতিবাদী রূপ লাভ করে। বিক্ষুব্ধ এই সময়ের বিস্তৃতিকে অতিসংক্ষিপ্ত করে বলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালীর সোচ্চার প্রতিবাদের সর্বাত্মক বিস্ফোরণটি প্রথম ঘটেছিল উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে। আর এই গণজোয়ারের অনিবার্য ফসল হিসেবেই সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা বাঙালীর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। অপরপক্ষে দুঃখজনক সত্যটি হলো নির্বাচনে বাঙালীর নিরঙ্কুশ বিজয়কে তথাকথিত পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী কোনক্রমেই মেনে নিতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের এই মেনে নিতে না পারার একগুঁয়েমি ও অগণতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই একাত্তরের সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমেই শুরু হলো সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালীর সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। বাঙালীর আশু বিজয়ের সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পেরেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কাল রাত্রে নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চালায় শতাব্দীর ঘৃণ্যতম গণহত্যা। পাকিস্তানী সামরিক হায়নাদের পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে তাই শুরু হলো বাঙালীর প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ মুক্তিযুদ্ধ। দেশ মাতৃকার পবিত্র ভূমিকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করার জন্য তেমন কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতা মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মুক্তির দৃঢ় শপথে বলীয়ান হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। যে কৃষক লাঙ্গল চালানো ছাড়া আর কিছুই জানতেন না তিনিও কাঁধে অস্ত্র তুলে নেন অকুতোভয়ে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মুক্তির এই বিশাল জনযুদ্ধে সেদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরিক হয়েছিলেন তদানিন্তন পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে কর্মরত অসম সাহসী বাঙালী সেনারা। দল ত্যাগ করে তাঁরা সবাই বীরের মতন ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। তাঁদের সবার পেশাদারী নৈপুণ্য ও অনন্য দেশপ্রেম আমাদের বিশাল জনযুদ্ধকে আরও বেগবান করেছিল। ত্বরান্বিত করেছিল আমাদের চির আকাক্সিক্ষত বিজয়ের অর্জনকে। যুদ্ধশেষে তাঁদের অনেকেই ফিরেছেন বীর বিক্রমে গাজী হয়ে। কেউবা পথিমধ্যে শাহাদত বরণ করেছেন বীরের মতন। তাঁদের সবার স্থান আমাদের জাতীয় ইতিহাসে চির মহান ও অমরত্বের আসনে স্থায়ী হয়ে আছে। আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ন’মাস স্থায়ী হয়। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মাহুতি, দু’লাখ মা-বোনের মানসম্ভ্রম আর অযুত নিযুত ভাই-বোনের বীর গাথায় আমাদের কাক্সিক্ষত বিজয় অর্জিত হয় একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরে। বিশ্ব মানচিত্রে গর্বিত অভ্যুদয় ঘটে ‘বাংলাদেশ’ নামের নবজাত রাষ্ট্রের। উল্লেখিত ইতিহাসের পুরো ধারাবাহিকতাকে এক কথায় বলা যায় বায়ান্নর মহান একুশে দেশ মাতৃকার অগ্নিগর্ভে যে ‘পবিত্র ভ্রƒণ’ সৃষ্টি হয় সেই পবিত্র ভ্রƒণ থেকেই এক সাগর রক্তের বিনিময়ে একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরে বাংলাদেশ নামের ভূখ-ের জন্ম হয়। সুহৃদ পাঠক, আপনারা নিশ্চয় এরই মধ্যে বলতে শুরু করেছেন এ আবার নতুন কি? এর সবটাইতো আমাদের জানা ইতিহাস। অবশ্যই মানছি। তবে হ্যাঁ, তার পরবর্তীতে আমাদের নবজাত রাষ্ট্রে একটি বড় মাপের ‘কিন্তু’ সৃষ্টি করা হয়। যা বাকি ইতিহাসে কিন্তুই থেকে যায়। কবুল করছি, আমি অই বিশেষ ‘কিন্তুকে’ চিহ্নিত করার জন্যই সজ্ঞানে আপনাদের জানা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করছি। আমার ‘কিন্তু-সন্ধানী’ অভিযানে প্রথমেই একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কি কোনও কনভেনশনাল যুদ্ধ ছিল? নিশ্চয় না। কেননা আমরা জানি শুধু মাত্র পেশাদার সামরিক বাহিনীর অংশ গ্রহণে এবং সামরিক (মার্সিনারী আর্মি) বাহিনীর একক পরিচালনায় যে যুদ্ধ পরিচালিত হয় সেই সেনাযুদ্ধই কনভেনশনাল যুদ্ধ। এর বৈপারীত্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী জাগ্রত বীর বাঙালী আবালবৃদ্ধবনিতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বিস্ফোরিত বিশাল বিস্তৃত এক জনযুদ্ধ। যে যুদ্ধে ত্রিশ লাখ তাজা প্রাণ আত্মাহুতি দিয়েছে। তাঁরা সবাই কালোত্তীর্ণ বীরের আসনে সমাসীন। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তাঁরা সবাই সমানভাবে বিজয়ীর রত্নাসনে অধিষ্ঠিত। তাঁরা সবাই এক অখন্ড বীর গাথা। আমাদের চির সশ্রদ্ধ অখন্ড- স্মৃতির মিনার। আমরা সবাই তো জানি কনভেনশনাল যুদ্ধে পৃথিবীর প্রায় সব ক’টি দেশেই সামরিক বাহিনীর ভেতর বীরত্বের নানান খেতাব (গ্যালেনট্রি এ্যাওয়ার্ড) এর রেওয়াজ রয়েছে। একটি ঐতিহাসিক ভ্রান্তির মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কনভেনশনাল যুদ্ধের তরিকায় ফেলে সেনাবাহিনীর রেওয়াজ মাফিক (গ্যালেনট্রি এ্যাওয়ার্ড) হিসেবে সাতজন সেনা-শহীদ কে বাঙালী জাতির ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ এই (সুপারলেটিভ) আখ্যায় অভিষিক্ত করা হয়। তাহলে কি বায়ান্নর একুশ থেকে একাত্তরের ষোলো ডিসেম্বর পর্যন্ত বাঙালী জাতিসত্তা ও বাঙালী রাষ্ট্র বিনির্মাণে অকুতোভয় আত্মাহুতি দেয়া সকল মহান শহীদরাই কী বীরশ্রেষ্ঠ নয়? তাহলে কী তাঁরা সবাই শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে সাতজন সেনা-শহীদের তুলনায় চিরকাল খাটো হয়ে থাকলেন আমাদের জাতীয় ইতিহাসে? জন্মলগ্নের কিয়ৎকাল পরেই বাংলাদেশ নামের নবজাত রাষ্ট্রের হৃদাভ্যন্তরে বিলীন তার অমিততেজা রত্ন সন্তান সকল শহীদের ভেতর সামরিক বিভাজনের এই অশুভ কা-টি কে বা কারা ঘটিয়েছিল? প্রশ্নটা তাই আজ ওখানেই!
×