ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের খপ্পরে ৫ শ’ তরুণ মেক্সিকো সীমান্তে

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের খপ্পরে ৫ শ’ তরুণ মেক্সিকো সীমান্তে

ফিরোজ মান্না ॥ মানবপাচারের আন্তর্জাতিক মাফিয়া জাল বিস্তার করেছে দেশ জুড়ে। এবার দালাল চক্র দেশের তরুণ সমাজকে আমেরিকায় পৌঁছে দেয়ার জন্য জাল পেতেছে। এই জালে কয়েক শ’ তরুণ ধরাও দিয়েছেন। তারা ১০ হাজার মার্কিন ডলার চুক্তিতে দালালদের সঙ্গে প্রথমে মেক্সিকো পাড়ি দিচ্ছেন। সেখান থেকে মেক্সিকোর পুলিশের সহযোগিতায় আমেরিকায় পাচার করা হয়। যাদের ভাগ্য ভাল তারা আমেরিকায় প্রবেশ করতে পারেন। আর যাদের বিধিবাম তারা ধরা পড়েন আমেরিকার পুলিশের হাতে। পুলিশের হাতে ধরা পড়লেই দুই বছরের নিশ্চিত জেল। পথে নানা চড়াই-উৎরাই পাড় করে ৫শ’র বেশি বাংলাদেশী তরুণ এখন মেক্সিকোতে অবস্থান করছেন। তাদের পর্যায়ক্রমে আমেরিকা পাঠানো হবে। পাচার করতে গিয়ে ইতোমধ্যে কয়েক জন আমেরিকার সীমান্তরক্ষীর হাতে ধরাও পড়েছেন। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে কে জানে। সম্প্রতি দালালদের হাত থেকে কৌশলে পালিয়ে আসা জামালপুরের মোস্তফা জানালেন, মেক্সিকোর মাফিয়া চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দালাল চক্রের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। দেশের দালাল চক্রের এজেন্ট সারাদেশে ছড়িয়ে আছে। তারা গ্রাম পর্যন্ত বেকার যুবকদের খুঁজে বের করে আমেরিকা ইউরোপের স্বপ্ন দেখায়। এজেন্টদের মিষ্টি কথায় যুবকরা উৎসাহী হয়ে মূল দালালের কাছে আসে। মূল দালালের কথায় তারা আরও খুশি হয়ে বাবা মায়ের সর্বস্ব বিক্রি করে তাদের হতে তুলে দেয় মোটা অঙ্কের টাকা। এরপর নানা পথে তাদের নিয়ে যায় মেক্সিকোতে সেখানে নিয়ে দালালরা আরও এক দফা টাকা আদায় করার কৌশল নেয়। সর্বশেষ তাদের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা আদায় করে নেয়। মানবপাচার ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠন বলেছে, বেশিরভাগ মানবপাচার হয় মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। এক শ্রেণীর দালালের মাধমে তারা বেশি বেতনের চাকরির লোভে বিদেশ যাচ্ছে। এতে বৈধ শ্রমবাজারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এখানে থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বে। সরকার মানবপাচার প্রতিরোধ আইন করলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। ‘ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর এডাপশন অব কমপ্রিহেনসিভ ল’ এগেইনস্ট ট্রাফিকিং ও রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে না পারলে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার হারাতে হতে পারে। সমুদ্রপথে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ায় অনিয়মিত অভিবাসন দেশের সার্বিক অভিবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারত ও পাকিস্তানে বেশিরভাগ পাচার হচ্ছে নারী। এদের জীবন সবচেয়ে দুর্বিষহ। সাগর পথে ইউরোপে পাচার করা হচ্ছে যুবকদের। পাচারকারীরা সংশ্লিষ্ট দেশের দালালদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়। দালালদের হাতে পড়ার পর তাদের জায়গা হয় যৌন পল্লীতে। অথবা অন্য কোন স্থানে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। এখন শুরু হয়েছে লিবিয়াতে পাচার। লোভ দেখানো হচ্ছে-লিবিয়া থেকে সাগর পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চাকরির। লোভে পড়ে মানুষ দালালদের ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা তুলে দিয়ে অনিশ্চিত জীবনে চলে যাচ্ছে। কেউ হয় তো লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। তবে বেশির ভাগেরই ঠাঁই হয় বিভিন্ন দেশের জেলখানায়। মানবপাচার নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকটি সংগঠনের কর্মকর্তারা বলেন, চাকরির নামে পাচার ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ে মানুষের ধারণা স্পষ্ট না হওয়ার কারণে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভিকটিমরা উদ্ধার হলেও পুলিশ পাচারের মামলা রুজু না করে পাসপোর্ট আইনে মামলা করে। মানবপাচার প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সময়োপযোগী ও সার্বজনীন আইন প্রণয়ন করা জরুরী। তাদের অভিযোগ, প্রতিটি জেলায় পাচারের মামলা মনিটরিং সংক্রান্ত কমিটি থাকলেও এর বেশিরভাগের কোন কার্যক্রম নেই। এ ছাড়া দায়েরকৃত মামলার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান না করা, আদালতের স্বল্পতা ও দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে পাচারের মামলাগুলোর বিচারপ্রাপ্তি ক্রমেই অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। বাংলাদেশে মানুষের নাজুক আর্থসামাজিক অবস্থা, নিরাপত্তার অভাব, সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের অসমতা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারসহ নানা অসঙ্গতি মানবপাচার প্রতিরোধের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। পাচার রোধে অপরাধীর শাস্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সৃষ্টি করে চলছে প্রচলিত আইনে পাচারের সংজ্ঞা স্পষ্ট না হওয়ার বিষয়টি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, মানবপাচার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে বহু মানুষের জীবনহানি ঘটবে। সমাজে একটা ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম নেবে। এখান থেকে বের হতেই হবে। তা না হলে জনশক্তির বাজারও হারাতে হবে। প্রতিবছর পাচার হওয়া নারী-পুরুষের প্রকৃত সংখ্যা কত তা সরকারী বেসরকারী কোন সংস্থার কাছে নেই। সরকারী বেসরকারী সংস্থাগুলো সংবাদ মাধ্যম থেকে যে সংখ্যা পাওয়া যায় তারই হিসাব রাখা হয়। এর বাইরে আর কোন কাজ হচ্ছে না। দেশে লোক সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে এ বিষয় নিয়ে সরকারের খুব একটা মাথাব্যাথা নেই। বেসরকারী সংস্থাগুলো মাঝে মধ্যে মানবপাচার প্রতিরোধ নিয়ে বছরে দু’চারটি সেমিনার করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করছে। পাচার হওয়া পরিবারের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না। এভাবেই বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ পাচার হয়ে যাচ্ছে। দালাল চক্র ইউরোপে পাচার করার জন্য বেশ কয়েকটি পথ ব্যবহার করছে। এর মধ্যে রয়েছে লিবিয়া ও ইরাক। আমেরিকায় জন্য ব্যবহার করছে মেক্সিকোর রুট। বর্তমানে মেক্সিকোতে কয়েক শ’ বাংলাদেশী নাগরিককে রাখা হয়েছে আমেরিকায় পার করার জন্য। আমেরিকার সীমান্তে কড়াকড়ির জন্য তাদের মেক্সিকোর বিভিন্ন এলাকায় দালাল নিয়ন্ত্রিত জায়গায় রাখা হয়েছে।
×