ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিভিন্ন রাইস মিলে টাস্কফোর্সের অভিযান চলছে

প্রকাশিত: ০৫:০১, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বিভিন্ন রাইস মিলে টাস্কফোর্সের অভিযান চলছে

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ হঠাৎ করেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে চালের বাজার। প্রবল বন্যা ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে চালের বাজার এমন অস্থির হয়ে উঠেছে বলে দাবি করা হলেও অনেকের অভিযোগ অতিরিক্ত মুনাফার লোভে একটি মহল সিন্ডিকেট তৈরি করে চালের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বিদেশ থেকে চাল আমদানির পাশাপাশি টাস্ককোর্সের অভিযাগ চালানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন রাইস মিলে। এদিকে চালের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে খোলা বাজারে। ফলে নিম্নবিত্ত গরিব মানুষের দুর্ভোগ দিন দিন চরম আকার ধারণ করছে। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার। দিনাজপুর ॥ চাল সঙ্কটের প্রভাব পড়েছে দেশের উত্তরের ‘শস্যভা-ার ধানের জেলা দিনাজপুরেও। দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এ জন্য চাল সঙ্কটের পাশাপাশি চাল নিয়ে একটি সিন্ডিকেট ষড়যন্ত্র শুরু করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এদিকে চালের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া দিনমজুর থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। অব্যাহতভাবে চালের দাম বাড়ায় মিল মালিকদের কারসাজি ও সিন্ডিকেটকেই দায়ী করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে মিল মালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি ও আমদানি নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায়, বেড়েছে চালের দাম। তবে চালের বাজারে অস্থিরতা কেউ সৃষ্টি করছে কিনা তা খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে জেলা প্রশাসন। কুষ্টিয়া ॥ দৌলতপুর উপজেলার আল্লারদর্গা এলাকায় জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম রাইস মিল বায়জীদ বিশ্বাস এগ্রোফুড লিমিটেড রাইস মিলে কুষ্টিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ কমিটি অভিযান চালিয়েছে। সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তানভীর রহমানের নেতৃত্বে এ অভিযান চালানো হয়। অভিযানে বাজার নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্যবৃন্দ বায়জীদ বিশ্বাস এগ্রোফুড রাইস মিলে চাল বা ধানের অতিরিক্ত মজুদ আছে কিনা তা তদারকি করেন। এসময় বায়জীদে রাইস মিলের গুদামে অতিরিক্ত মজুদ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হয়। তবে বায়জীদ বিশ্বাস এগ্রোফুড রাইস মিলের বিভিন্ন গুদামে অতিরিক্তি চাল এবং ধানের মজুদ আছে বলে এলকাবাসী জানিয়েছেন। বায়জীদ বিশ্বাস এগ্রোফুডের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জেলার বিভিন্ন রাইস মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ মনিটরিং কমিটির অভিযানের পর থেকে গত দুই তিন দিন ধরে রাতের আঁধারে বায়জীদ বিশ্বাস এগ্রোফুড রাইস মিলের চাল ট্রাক ভর্তি করে গোপনে বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হয়েছে। এছাড়াও রাইস মিলের ভেতরের একাধিক গুদামসহ মিলের পার্শ্ববর্তী স্থানের বিভিন্ন গোপন গুদামে চাল ও ধানের অতিরিক্ত মজুদের কথা জানিয়েছেন এলাকার লোকজন ও মিলের এক কর্মচারী। জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশ্বাস মিনিকেট চালসহ বিশ্বাসের বিভিন্ন প্রকার চালের বাড়তি চাহিদা থাকায় মাঝে মধ্যে অতিরিক্ত মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে চালের মূল্য বৃদ্ধিরও অভিযোগ রয়েছে বায়জীদ বিশ্বাস এগ্রোফুডের বিরুদ্ধে। অতিরিক্ত চাল বা ধানের মজুদের কথা অস্বীকার করে বায়জীদ বিশ্বাস এগ্রোফুডের ম্যানেজার ইসরাফিল হোসেন স্বপন জানিয়েছেন, ধানের মূল্য বৃদ্ধির কারণে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বাস এগ্রোফুডে ধান বা চালের অতিরিক্ত মজুদ নাই বলে তিনি দাবি করেন। এদিকে অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তা তানভীর রহমান জানান, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে জেলার বিভিন্ন রাইস মিলে চাল বা ধানের অতিরিক্ত মজুদ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিংয়ে বায়জীদ বিশ্বাস এগ্রোফুড রাইস মিলে অভিযান চালানো হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান। অপরদিকে জেলা বাজার নিয়ন্ত্রণ মনিটরিং টিম বায়জীদ বিশ্বাস এগ্রোফুডে অভিযান শেষ করে চলে গেলেও দৌলতপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ লিয়াকত আলীকে বায়জীদ বিশ্বাস এগ্রোফুডের ম্যানেজারের কক্ষে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে দেখা গেছে। তবে তিনি জানিয়েছেন, বিশ্বাস এগ্রোফুডে চাল বা ধানের অতিরিক্ত মজুদ পাওয়া যায়নি। নাটোর ॥ অবৈধভাবে চাল মজুদ, ওজনে কম দেয়া, কম দামে ধান কিনে প্রক্রিয়াকরণ খরচের তুলনায় বেশি দামে চাল বিক্রিসহ নানা অপরাধে নাটোরের গুরুদাসপুরে চারটি রাইস মিল মালিককে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সোমবার দুপুরে উপজেলার চাঁচকৈড় বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোর্তুজা খান এই জরিমানা আদায় করেন। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাজ্জাকুল ইসলাম এবং র‌্যাব-৫ নাটোর ক্যাম্পের কমান্ডার শেখ আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড় বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় চাঁচকৈড় বাজারের সততা ট্রেডার্সের মালিক রায়হান উদ্দিন অবৈধভাবে চাল মজুদ রাখায় ৭০ হাজার টাকা, চৌধুরী ট্রেডার্সের মালিক কিশোর কুমার চৌধুরীকে ৫০ হাজার টাকা, জাহাঙ্গীর আলমকে ৫০ হাজার এবং কেএম ট্রেডার্সের মালিক আলমগীর কবিরকে এক লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোর্তুজা খান। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের সঙ্গে র‌্যাব-৫ নাটোর ক্যাম্পের কমান্ডার শেখ আনোয়ার হোসেন, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মনিরুল ইসলাম, জেলা বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা নূর মোমেন, কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশনের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রইচ উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাজ্জাকুল ইসলাম বলেন, হঠাৎ করেই চালের বাজার অস্থিতিশীল হতে থাকে। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে প্রতিটি রাইস মিলে বিশেষ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গুরুদাসপুরে অবৈধভাবে চাল মজুদ, ওজনে কম দেয়া, ভুয়া ট্রের্ড মার্ক ব্যবহার, কম দামে ধান ক্রয় করে প্রক্রিয়াকরণ খরচের তুলনায় অনেক বেশি দামে বিক্রি করার অপরাধে চারটি চালকল মালিকদের জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এই ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি। উল্লেখ্য, এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর অবৈধ ধান-চাল মজুদসহ নানা অপরাধে বড়াইগ্রামের রশিদ অটো রাইস মিল মালিককে ৫০ হাজার, গাজী অটো রাইস মিলকে ৫০ হাজার এবং নাটোর অটো রাইস মিলসহ মোট চারটি মিল মালিককে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। গত চার দিনে এখন পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে। রাজশাহী ॥ রাজশাহী নগরীর দুই চালকল মিলে পাঁচ হাজার বস্তা চাল মজুদ পেয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার বিকেলে নগরীর সপুরা এলাকায় হা-মীম ও আসলাম রাইস মিলে অভিযান চালানো হয়। এর মধ্যে হা-মীম রাইস মিলে চার হাজার ২৯ বস্তা ও আসলাম রাইস মিলে এক হাজার ২৮৫ বস্তা চাল মজুদ পাওয়া যায় বলে জানান ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুব্রত পাল। তিনি জানান, এ দুটি মিলের কোন বৈধ কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেনি। অবৈধভাবে তারা চাল উৎপাদন করে মজুদ করে রেখেছে। তাদের মিলে উৎপাদিত চালের বস্তায় কুষ্টিয়ার আব্দুর রশিদের মেসার্স হালিমা অটোরাইস মিলের স্টিকার লাগিয়ে বাজারজাত করে থাকে। এছাড়াও ওই দুইটি রাইস মিলে কয়েক হাজার বস্তা ধানও মজুদ রয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুব্রত পাল আরও বলেন, দুই রাইস মিল থেকে দুইজনকে আটক করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান তিনি। রশিদের গুদামে নিষ্ফল অভিযান ॥ এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের নির্দেশের পরপরই বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুর রশিদের গুদামে টাস্কফোর্সের অভিযান চালানো হয়েছে। রবিবার বিকেল সোয়া ৪টার দিকে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে অবস্থিত রশিদ এগ্রোফুড লিমিটেডে এ অভিযান চালায়। তবে সেখানে কোন কিছু না পেয়ে খালি হাতে ফেরত এসেছে তারা। তবে গ্রেফতার এড়াতে গা-ঢাকা দিয়েছে আব্দুর রশীদ। নীলফামারী ॥ কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে উঠেছে সারাদেশের ন্যায় নীলফামারীর চালের বাজার। বেপরোয়া সিন্ডিকেটে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে বৃদ্ধি করেছে প্রায় ১৫ টাকা হতে ২৫ টাকা পর্যন্ত। তবে এই দাম বাড়ার কারণ হিসেবে কোন উত্তর মিলছে না ব্যবসায়ী, আড়তদার ও মিল মালিকদের। সরকারের তরফে মজুদদারি ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি দেয়া হলেও প্রতিদিনই বাড়ছে চালের দাম। মজুদ থাকার পরও দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য চালের দাম নয়া দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা পর্যন্ত। মোটা চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৪ টাকায়। এতে নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েছে। খুচরা চাল ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা বলছেন, মিলমালিক ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন অজুহাতে চালের দাম রাতারাতি বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাছাড়া এখন মোবাইলের মাধ্যমে ঘণ্টায়-ঘণ্টায় চালের দাম পরিবর্তন করছেন তারা। মিলমালিকরা স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণ নিয়ে বিপুল পরিমাণ মজুদ গড়ে তুলেছেন। ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বাজার। নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, ডোমার ও সৈয়দপুর উপজেলা এলাকার বেশ কিছু মিল মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে জেলার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
×