ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন নায়করাজ : সংস্কৃতি অঙ্গনে শোক

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২২ আগস্ট ২০১৭

চলে গেলেন নায়করাজ : সংস্কৃতি অঙ্গনে শোক

সংস্কৃতি ডেস্ক ॥ অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক! সোমবার নায়করাজের মৃত্যুতে বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি, শিল্পী ঐক্যজোটসহ চলচ্চিত্র সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট মানুষরা। নায়করাজের মৃত্যুতে তারা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন নায়করাজের মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রের এক সোনালি যুগের উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হলো। এদিকে গুরুতর অবস্থায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন নায়করাজ। সেখানেই তার জীবনের অবসান ঘটে বলে জানিয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার ও মহাসচিব বদিউল আলম খোকন। প্রধানমন্ত্রীর শোক : নায়করাজের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে রাজ্জাকের অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, তার মৃত্যুতে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র। শেখ হাসিনা নায়করাজের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। শিল্পী ঐক্যজোটের শোক : নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যুতে শিল্পী ঐক্যজোটের শোক প্রকাশ করেছে শিল্পী ঐক্যজোটের নেতারা। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি শক্তিমান এই অভিনেতার মৃত্যুতে শিল্পী ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে সভাপতি ডি-এ তায়েব ও সাধারণ সম্পাদক জি এম সৈকত গভীর শোক প্রকাশ করছেন। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় আজ মগবাজারের শিল্পী ঐক্যজোটের কার্যালয়ে এক দোয়া মোনাজাতের আয়োজন করেছেন। যেভাবে নায়করাজ : নায়করাজ রাজ্জাক ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের টালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় স্বরসতী পূজা চলাকালীন সময়ে মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের জন্য তার গেম টিচার রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে নায়ক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রের বেছে নেন। এরপর শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক বিদ্রোহীতে গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে নায়করাজের অভিনয়ে সম্পৃক্ততা। তবে শৈশবেই তিনি বাবা-মাকে হারান। অভিনেতা হওয়ার মানসে ১৯৬১ সালে কলকাতা থেকে মুম্বাই পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি; সেখানে সফল না হয়ে ফিরেছিলেন টালিগঞ্জে। কলকাতায়ও পরিস্থিতি অনুকূলে না হওয়ায় ১৯৬৪ সালে ঢাকায় চলে আসেন রাজ্জাক। প্রথমে কাজ শুরু করেন সহকারী পরিচালক হিসেবে; এর মধ্যেই ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’ চলচ্চিত্রে ছোট একটি ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। ‘ডাকবাবু’, উর্দু চলচ্চিত্র ‘আখেরি স্টেশন’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্রে ছোট ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এক সময় জহির রায়হানের নজরে পড়েন রাজ্জাক। তিনি ‘বেহুলা’য় লখিন্দরের ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ দেন রাজ্জাককে, সুচন্দার বিপরীতে। ‘বেহুলা’ ব্যবসা সফল হওয়ায় আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্জাককে। সুদর্শন রাজ্জাক সুচন্দার পর কবরী, ববিতা, শাবানাসহ তখনকার প্রায় সব অভিনেত্রীকে নিয়ে একের পর এক ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র দেন ঢালিউডকে। এর মধ্যে রাজ্জাক-কবরী জুটি ছিল ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্রে খুব কমই অভিনয় করছেন নায়করাজ রাজ্জাক। শুধু নায়ক হিসেবেই নয়, পরিচালক হিসেবেও বেশ সফল। ‘আয়না কাহিনী’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন রাজ্জাক। আমৃত্যু চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গেই থাকতে চাওয়ার কথা জানিয়ে এক সময় বলছিলেন, আমি রাজ্জাক হয়ত অন্য কোন চাকরি করতাম অথবা ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু ছোটবেলার অভিনয় প্রচেষ্টাকে আমি হারাতে দেইনি। আমি নাটক থেকে চলচ্চিত্রে এসেছি। সবাই আমাকে চিনেছেন। পেয়েছি সাফল্যও। বাংলার মানুষজন আমাকে একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবেই দেখেন ও আমাকে ভালবাসেন। আজকে আমার যা কিছু হয়েছে সবই এই চলচ্চিত্রশিল্পের কল্যাণে। রাজ্জাক এও বলেছিলেন, বাংলাদেশের ছোট একটি দেশ হতে পারে, তারপরও এই দেশের একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমি গর্ববোধ করি। যাঁদের জন্য আমি রাজ্জাক হয়েছি আমি সবসময় তাঁদের কাছাকাছি থাকতে চাই। চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ ডাকলে তাতে সাড়া দিতেন রাজ্জাক। তবে এখন থেকে আর সাড়া দেবেন না তিনি। তিনি চলে গেলে না ফেরার দেশে। যেখান থেকে কেউ আর ফেরে না। তবে রাজ্জাক চলে গেলেও তার কাজগুলো থেকে যাবে। তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো পরের প্রজন্মের মানুষরা মনে রাখবে চিরকাল। রাজ্জাক অভিনীত চলচ্চিত্র : ‘আনোয়ারা’, ‘সুয়োরাণী-দুয়োরাণী’, ‘দুই ভাই’, ‘মনের মতো বউ’, ‘ময়নামতি’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বেঈমান’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘রংবাজ’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘জীবন থেকে নেয়া’ ‘পিচ ঢালা পথ’, ‘অশিক্ষিত’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘আলোর মিছিল’, ‘অবুঝ মন’ ‘পিচ ঢালা পথ’, ‘স্বরলিপি’, ‘কি যে করি’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বাঁদী থেকে বেগম’, ‘আনার কলি’, ‘বাজিমাত’, ‘লাইলি মজনু’, ‘নাতবউ’, ‘মধুমিলন’, ‘সাধু শয়তান’, ‘মাটির ঘর’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘কালো গোলাপ’, ‘কার্তুজ’। এছাড়া ‘বদনাম’, ‘সৎ ভাই’, ‘চাপা ডাঙ্গার বউ’, ‘বাবা কেন চাকর’সহ ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন রাজ্জাক। পুরস্কার : নায়করাজ রাজ্জাক চলচ্চিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা। ‘কি যে করি’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর আরও চারবার তিনি জাতীয় সম্মাননা পান। ২০১৩ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। এছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার পেয়েছেন অসংখ্যবার। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করেন তিনি। প্রসঙ্গত, সোমবার সন্ধ্যা ৬-১৫ মিনিটে তিনি রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন নায়করাজ রাজ্জাক। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। মৃত্যুকালে রাজ্জাক স্ত্রী লক্ষ্মী (খায়রুন নেসা), তিন ছেলে বাপ্পারাজ, বাপ্পি ও সম্রাট এবং দুই মেয়ে শম্পা ও ময়নাকে রেখে গেছেন। তার ছেলে বাপ্পারাজ ও সম্রাট চলচ্চিত্রে অভিনয় ও পরিচালনা করেন।
×