ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দারিদ্র্য বিমোচন, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব

বড় বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি ॥ ১২৭ পণ্য ও সেবা খাতে ভ্যাট অব্যাহতি

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৩০ মে ২০১৭

বড় বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি ॥ ১২৭ পণ্য ও সেবা খাতে ভ্যাট অব্যাহতি

এম শাহজাহান ॥ ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের’- এ সেøাগান সামনে রখে এবারের প্রস্তাবিত বড় বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। আগামী ১ জুন বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এটি হবে অর্থমন্ত্রীর ১১তম বাজেট। রোজা হওয়ায় চিরাচরিত প্রথা ভেঙ্গে ইফতারের আগেই এবার বাজেট বক্তৃতা শেষ করা হবে। ৪ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকার এ বাজেট সামনে রেখে ভিশন-২০২১ পুরোপুরি বাস্তবায়ন এবং রূপকল্প-২০৪১-এর একটি রোডম্যাপ দেয়া হবে। এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থানের জন্য নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আলোচিত ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা। এছাড়া ২০১৯ সালে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, এবারের বাজেটে বহুল আলোচিত ভ্যাট আইন-২০১২ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়া হবে। ওই আইন অনুযায়ী ১ জলাই থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে ব্যবসায়ীদের। তবে বাড়তি চাপ সাধারণ জনগণের ওপর পড়বে না বলে নিশ্চিত করেছেন অর্থমন্ত্রী এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোঃ নজিবুর রহমান। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী প্রস্তাবিত বাজেটে ১২৭ পণ্য ও সেবা খাতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা থাকছে। এছাড়া প্রায় ১২শ’ নিত্যপণ্য ক্রয়ে কোন ভ্যাট থাকছে না। ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত মৌলিক খাদ্যপণ্যের মধ্যে রয়েছেÑ চাল, ডাল, ডিম, ফল, তরল দুধ, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, মরিচ, মাংস, মুড়ি, চিঁড়া, আলুসহ সব ধরনের সবজি। জানা গেছে, বৈদেশিক ঋণ এবং অনুদানের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ থাকবে নতুন বাজেটে। সঞ্চয় উৎসাহিত এবং পেনশনারদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আপাতত সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো হচ্ছে না। তবে বাজেট ঘোষণার পর এ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। সম্প্রতি সচিবালয়ে তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিরাপদ বিনিয়োগ হওয়ায় এখানে সবাই বিনিয়োগ করছেন। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ এবং যারা পেনশনে চলে গেছেন তারা এ খাতে টাকা বিনিয়োগ করছেন। তাই আলোচনাসাপেক্ষে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থমন্ত্রী ভ্যাট প্রসঙ্গে বলেন, দেশে আট লাখ নিবন্ধিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকলেও ভ্যাট দেয় মাত্র ২৫ থেকে ২৬ হাজার। এ সংখ্যা আমরা আগামী বছর দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৫০ হাজারে নিয়ে যেতে চাই। তিনি দাবি করেন, এ ভ্যাট কাঠামোতে বাজারে পণ্যমূল্য কোন অবস্থাতেই বাড়ার কথা নয়। রোজার কারণে বর্তমানে ব্যবসায়ীরা কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ভ্যাটের কারণে বাড়ার কারণ নেই। এ সরকারের সময় তার দেয়া কোন বাজেটের পরপরই দ্রব্যমূল্য বাড়েনি বলে জানান তিনি। এদিকে, এবারের বাজেটে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় রাখতে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হবে। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হবে সাড়ে ৭ শতাংশ। আগামী বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। ৫ দশমিক ৪ শতাংশ ঘাটতি রেখে বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। আপাতত জ্বালানি তেলের দাম কমানোর চিন্তা-ভাবনা নেই। এছাড়া পদ্মা সেতুসহ অগ্রাধিকার মেগা প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ বাড়ানো হবে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হবে বিদ্যুত উৎপাদন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পরিবহন ব্যবস্থা আধুনিকায়ন এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে। এছাড়া এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যথারীতি বেশি বরাদ্দ দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আগামী বাজেটে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার পদক্ষেপ থাকবে। বর্তমান বাজেটে এ ভর্তুকি রয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। এদিকে পুঁজিবাজার উন্নয়নে টেলিটক, এসেনসিয়াল ড্রাগস, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ এবং পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডসহ (পিডিবি) সরকারী ২৭টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছাড়ার উদ্যোগ নেয়া হবে। রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে জনশক্তি রফতানি বাড়ানোর পদক্ষেপ থাকছে। রেমিটেন্স বৈধ বা ব্যাংকিং চ্যানেলে আনতে ইতোমধ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আইনানুযায়ী কালো টাকা সাদা করার যথারীতি সুযোগ থাকছে এবং অর্থ পাচার রোধে মানি লন্ডারিং আইন বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নয়ন দর্শনে এগিয়ে যেতে হবে। জাতীয় বাজেটে এর প্রতিফলন থাকা উচিত। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ভিশন ও রূপকল্প দিয়েছেন তা বাস্তবায়নে অবশ্যই বাজেটের আকার বাড়াতে হবে। সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ বিনির্মাণে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট এমন হওয়া উচিত, যেন তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও অসাম্প্রদায়িক মানস কাঠামো বিনির্মাণে সহায়ক হয়। কালের পরিক্রমায় মূল ধারার অর্থনীতির মধ্যে মৌলবাদের অর্থনীতি, সরকারের মধ্যে মৌলবাদের সরকার, রাষ্ট্রের মধ্যে মৌলবাদের রাষ্ট্র এবং ধর্মের রাজনীতিকরণ অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ করেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা দিয়ে আসছে অর্থনীতি সমিতি। অর্থনীতি সমিতি মনে করে, বরাবরের মতো বাজেটের অন্যতম দুর্বল দিক হলো সময়মতো এবং মানসম্মত বাস্তবায়ন। জানা গেছে, আসছে নতুন বাজেটে গরিবসহ দেশের সবাইকে ভাল রাখার প্রয়াস থাকবে। পুরোপুরি দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানে ব্যাপক ভিত্তিতে শিল্পায়নের বিকাশ ঘটানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। এ লক্ষ্যে চলতি বাজেটের চেয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার বাড়ানো হচ্ছে। রূপকল্প-২১ সামনে রেখে আগামী চার বছরের মধ্যে দেশের প্রায় সব গরিব মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এর মূল লক্ষ্য হলোÑ দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, অতিদরিদ্রতা দূর করা এবং দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাত। দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচীকে আরও গতিশীল ও কার্যকরী করতে সামাজিক নিরাপত্তায় ১৪৫টি খাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বয়স্ক ভাতা কার্যক্রম, প্রতিবন্ধী ভাতা কার্যক্রম, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি কর্মসূচী, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা কার্যক্রম, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা কার্যক্রম, ভিজিডি কার্যক্রমে বরাদ্দ বাড়ানোর আভাস পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, সরকারের এসব উদ্যোগের ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চার বছরের মধ্যেই দেশ থেকে অতিদারিদ্র দূর হবে। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে বাজেট বরাদ্দ এবং সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হবে। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, পূর্বের ধারাবাহিকতায় এবারের বাজেটেও দারিদ্র্য বিমোচনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। এজন্য মানবসম্পদ উন্নয়নে বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত নেয়া গৃহীত কর্মসূচীগুলো এখন পুরোদমে বাস্তবায়নের কাজ চলছে। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে। এ কৌশলের ফলে দরিদ্র্য ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি মোকাবেলায় আয় হস্তান্তর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এছাড়া স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয়, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষিতে প্রণোদনা এবং ক্ষুদ্রঋণসহ আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্তি প্রভৃতি কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দারিদ্র্য দূর করতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো হবে। এ খাতে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ থাকবে ৫২ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বরাদ্দের পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশে নামিয়ে আনতে বাজেটে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামী ২০২১ সালের পর এ দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর হার ১৩ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার সরকারী উদ্যোগ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি অর্থ বরাদ্দ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। বরাদ্দ বাড়ছে এডিপিতে চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন বছরের বাজেটের আকার এবারের তুলনায় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বেশি হচ্ছে। আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হতে যাওয়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) বরাদ্দ দেয়া হবে এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে দুই লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর ব্যবস্থা থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। বাড়ছে ঘাটতি আসছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি হবে মোট ডিজিপির ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি রয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছর তা এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে।
×