এমদাদুল হক তুহিন ॥ “ধানের খলায় নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করি। পুরুষকে আট থেকে দশ হাজার টাকা দেয়া হলেও আমাদের দেয়া হয় মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা। তিন ছেলেমেয়েকে দেশে রেখে স্বামীর সঙ্গে এখানে কাজ করছি, ওদের দূরে রাখার কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করার নয়! আরও কিছু টাকা বেশি পাওয়া গেলে অন্তত কিছুটা শান্তি পেতাম। কাজ করার সময় মালিকেরা পুরুষের সঙ্গে ভাল আচরণ করলেও আমাদের সঙ্গে ধমকের সুরে কথা বলেন। পুরুষকে ধমক দিতে ভয় পেলেও আমাদের ক্ষেত্রে ভয় পায় না।”- কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব কদমা গ্রামের মোছাঃ মরজিনা বেগম। স্বামী এখলাসের সঙ্গে ময়মসিংহ জেলার একটি ধানের খলায় কাজ করেন এই নারী শ্রমিক। কৃষি কাজে নারীর অবদান অতুলনীয় হলেও নারীদের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য দেখা যায়, মরজিনা তার জলন্ত উদাহরণ!
শুধু মরজিনা নন, কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি নারী শ্রমিকের একই হাল। ফিরোজা বেগম তাদের একজন। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় বসবাসরত এই নারী জানান, “পুরুষের তুলনায় কামে আগে যাই। ছয়ডায় কাম শুরু হইলেও আমরা ছয়ডার আগেই হাজিরা দেই, হেরা পরে আইয়্যে। পুরুষেরা মাঝেমইধ্যে চা-পান-বিড়ি খাইবার নাম কইর্যা জিরায় (বিশ্রাম নেয়)। পুরুষ কামলা ৩০০ টেহা পাইলে আমদের দেয় ১৫০ থেকে ২০০ টেহা! তহন খুব খারাপ লাগে! হাজিরা (পারিশ্রমিক) কম দিলে মনে দুঃখ লাগে। মনে হয়, আম্গর কি যেন নাই। একেতো বাইতে (বাড়িতে) হেগর নানা যন্ত্রণা, কাজ করার সময় টেহা কম আবার টিটকারিও পারে।” এই নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়; শুধু ধানের খলায় নয়, কৃষি সংশ্লিষ্ট একাধিক কাজে সহায়িকা হিসাবে পরের বাড়িতেও কাজ করেন তিনি। গ্রামের অপেক্ষাকৃত ধনীদের বাড়িতে অল্প টাকায় শ্রম দিতে হয়, কোন কোন ক্ষেত্রে এক থেকে দুই কেজি চালের বিনিময়েই এই কাজ চলে পুরো দিন। মরজিনা ও ফিরোজার মতো নারী শ্রমিকরা তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে মানসিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার, তবে কৃষি ক্ষেত্রে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
গ্রামে বসবাসরত প্রতিটি মহিলাই নিজ নিজ পরিবারে কৃষি ও কৃষি কাজের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট। প্রত্যক্ষভাবে কৃষি খামার কিংবা কৃষি জমিতে কাজ করা নারীর পরিমাণ নগণ্য হলেও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অনেক নারীকে সরাসরি এই খাতে শ্রম দিতে হয়। পারিবারিক প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদার কারণে নারী কৃষাণীরা নিজের ঘরে কিংবা খামারে পরিশ্রম করলেও তা প্রকাশে অপারগতা জানান। গ্রামের প্রতিটি পরিবারেই মা, স্ত্রী, কন্যা কোন না কোনভাবে কৃষি সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত, তবে সন্তান কিংবা পরিবারের কর্তা সমাজের সকলে তা জানুক-এমনটি প্রত্যাশা করেন না। নারী এই কৃষাণীরা নিজ বাড়িতে কাজ করা অবস্থায় অন্য বাড়ির কেউ আসলে নিজেকে লুকিয়ে নেন। শুধু ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে এই আচরণ নয়, নারী হয়ে কাজ করছি, আর তা দেখানোর কি আছে? - এমন মানসিকতা! আম্বিয়া খাতুন, রুপালী বেগম, রওশুনাসহ বেশ কয়েকজন মহিলার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। তবে, নারী কৃষাণী হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির কথা উঠলে সবই হ্যাঁ সূচক ঈশারা করেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, মানব জাতির আদি পেশা কৃষির উৎপত্তি নারীদের হাত ধরেই। আদিকালে মানুষ প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। নারী-পুরুষ সবাই মিলে খাবার সংগ্রহ করত, তবে পশু পাখি শিকারে পুরুষই ছিল দক্ষ। পুরুষের শিকারের সময়টা নারীরা গৃহের কাজে ব্যস্ত থাকত; আর সেই সময়ে নারীদের হাত ধরেই বন থেক সংগৃহীত বীজ থেকে অঙ্কুরোদগমন ঘটে। আর এভাবেই নারীর হাত ধরে কৃষি কাজের আবিষ্কার ঘটে।
বর্তমান সময়ে নারীদের অধিকাংশ একই সঙ্গে কৃষিক্ষেত্র ও গৃহের কাজে জড়িত। তাঁরা সন্তানের লালন পালন ও গৃহস্থালির কাজ শেষে অবসর সময়ের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে ব্যয় করেন। বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত জায়গাটুকু নারীর আলতো হাতের নিবিড় স্পর্শে শাকসবজি, শিম, কুমড়ো, লাউ, শসা ইত্যাদি ফসলাদিতে সবুজে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। দেশের অনেক এলাকায় নারীরা বপন, রোপণ, নিড়ানীসহ ফসল পরিচর্চার কাজে সারাসরি নিয়োজিত আছেন। জানা যায়, নৃগোষ্ঠী নারীরা আঞ্চলিকভাবে নিজ নিজ এলাকায় কৃষি শ্রমিক হিসাবে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে নারীরা গৃহপালিত পশু, হাঁস-মুরগির খামার, ধানভানা, সিদ্ধ করা, শুকানো, ঝাড়া ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। কৃষি অর্থনীতিতে নারীদের এতো অবদান থাকা সত্ত্বেও পরিমাণগত স্বরূপ নির্ধারণ করা যায়নি।
কৃষি ক্ষেত্রে নারীদের অবদান ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চললেও এখনও স্বীকৃতি মেলেনি তাঁদের। আধুনিক এই যুগেও রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী কৃষাণীদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়নি। বাংলাদেশে ১৯৯৫-৯৬-এর শ্রমজরিপে প্রথমবারের মত “নারী যে কৃষক” তা বিবেচনা করা হয়। তবে আজ এতো বছর পরও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) তাদের অবদান অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। নারী এই কৃষাণীদের নিয়ে আলাদা কোন পরিসংখ্যান নেই। কৃষকদের জন্যে কৃষি কার্ডের ব্যবস্থা থাকলেও নারী কৃষাণী হিসাবেই তাদের স্বীকৃতি মেলেনি, ফলে খুব সহজেই কৃষাণী কার্ড প্রণয়ন করা যাচ্ছে না। পরিসংখ্যান ও স্বীকৃতিগতভাবেই বৈষম্য নয়, কৃষি ক্ষেত্রে কর্মরত নারীদের শ্রমমূল্য পুরুষের অর্ধেক! আবার একই সময়ে নারীর প্রদত্ত শ্রমঘণ্টার পরিমাণও বেশি হয়ে থাকে।
কৃষকদের নিয়ে কাজ করা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হাতে নারী কৃষক কিংবা কৃষাণীদের নিয়ে তেমন কোন তথ্য নেই। খোদ এই অধিদফতরের হাতে কৃষি ক্ষেত্রে নারীর অবদান নিয়ে সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা নেই। তবে একাধিক তথ্যমতে, গত এক দশকে অবৈতনিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির ৫০ লক্ষ্যই নারী। যাদের ৭৭ শতাংশ কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশে ১৯৯৫-১৯৯৬ সালের শ্রম জরিপে প্রথমবারের মতো নরী যে কৃষক তা বিবেচনা করা হয়। কৃষিকাজের সঙ্গে নরীদের সংশ্লিষ্টতার প্রথম স্বীকৃতি এটিই। ২০০৫-০৬ সালের শ্রম জরিপ অনুযায়ী, ১৫ বছরের উপরের জনশক্তির ৪৮.১ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। ওই শ্রমশক্তির ৪১.৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৬৮.১ শতাংশ নারী সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত। এই জরিপ অনুযায়ী কৃষি ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর অবদান ২৬.৩ শতাংশ বেশি। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংক পরিচালিত আরেক জরিপে থেকে জানা যায় বাংলাদেশে কৃষিতে নারীর অবদান ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ। অথচ এই সময়ে এসেও অনেক পুরুষ বুক ফুলিয়ে বলেন, ‘নারীরা শুধু রান্নার কাজেই সীমাবদ্ধ!’
এফএও-এর এক প্রতিবেদন দেখা যায়, বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ নারী সরাসরি কৃষি শ্রমিক, ৮০ শতাংশ নারী খাদ্য উৎপাদক, ১০ শতাংশ নারী খাদ্যশস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াও ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ নারী গ্রামীণ বাজারজাতকরণের সঙ্গে সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। কৃষি ক্ষেত্রে নারীর অবদান কোন অংশে কম নয়। তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও দিন দিন তাদের অবদানের কথা অকপটে স্বীকার করছেন কৃষিতে জড়িত পুরুষগণসহ সমাজের সর্বস্তরের লোকজন।