ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ত্রিদেশীয় সিন্ডিকেট ॥ বিমানে সোনা পাচার ॥ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৭ ডিসেম্বর ২০১৪

ত্রিদেশীয় সিন্ডিকেট ॥ বিমানে সোনা পাচার ॥ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

আজাদ সুলায়মান ॥ স্মরণকালের বিশাল চালানে আনা ১২৪ কেজি সোনা আটকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ত্রিদেশীয় সিন্ডিকেটের নাম। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের চোরাচালানিদের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেট গত এক দশকে এক হাজার মণ স্বর্ণ পাচার করার আভাস ও লক্ষণ পেয়েছে তদন্তকারীরা। বাংলাদেশ বিমানের একটি ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেটের সহায়তায় বছরের পর বছর এ ধরনের বিশাল চালান আনা হচ্ছে। এক বছরেরও অধিক সময় ধরে চালানো এই তদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদন শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ গত অক্টোবরের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেবার পর সর্বশেষ শুক্রবার রাতে বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। এতে আসামি করা হয় বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১৪ জনকে। বিমানের এমডি মোসাদ্দিক আহমেদ বলেছেন-নিয়ম হচ্ছে কোন কর্মচারী-কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হলে তাকে প্রাথমিকভাবে বরখাস্ত করা। তারপর বিভাগীয় তদন্ত শেষে চূড়ান্ত ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে তাই হবে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক মইনুল খানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি কমিটি চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার বিভাগীয় তদন্ত করে। তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের ২৪ জুলাই বিমানের এয়ারবাসে আনা ওই সোনার চালান আটক করা হয়। এয়ারবাসটি প্রথমে দুবাই থেকে সিলেট হয়ে ঢাকায় আসে। তারপর সেটা নেপালের কাঠমান্ডু হয়ে ফিরে আসার পর হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ১নং বোর্ডিং ব্রিজের কাছে থামে। খবর পেয়ে শুল্ক গোয়েন্দা, এপিবিএনসহ অন্যান্য এজেন্সির সদস্যের উপস্থিতিতে ওই ফ্লাইটে তল্লাশি চালানো হয়। এতে উড়োজাহাজের ফ্রন্ট কার্গো হোল্ডের স্টেট বক্স থেকে উদ্বার করা হয় কালো কাপড়ে মোড়ানো ১০৬৪টি সোনার বার। যার ওজন ছিল ১২৪ কেজি। ঘটনাস্থল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে আটক করা যায়নি। এতে কাস্টমস আইনে একটি বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। তারপর মইনুল খানের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর সদস্যরা ছিলেনÑকেএম অহিদুল আলম- কমিশনার মংলা কাস্টমস হাউস, কামারুজ্জামান-সহকারী পরিচালক, উম্মে নাহিদ আক্তার-সহকারী কমিশনার, নুরুজ্জমান ম-ল-ম্যানেজার বিমান ও ইফতেখার সিএসও শাহাজালাল এয়ারপোর্ট। কমিটি ঢাকায় প্রাথমিক তদন্তের পর দুবাই বিমানবন্দর পরিদর্শন করে। কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়, দুবাইয়ে বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ আহমদ কাজীর সহযোগিতা ছাড়া এই বিশাল চালান বিমানের ফ্লাইটে ওঠানো সম্ভব নয়। কমিটি তাকেসহ অন্য বিমানকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। জানা যায়, দুবাই, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ সিন্ডিকেট অত্যন্ত সূক্ষ্ম কায়দায় সেদিন এতবড় চালান ঢাকায় আনে। বিমানের প্রকৌশল শাখা দিয়ে ওই সোনার চালান বাইরে খালাস করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নিরাপদ পরিবেশ না থাকায় এয়ারবাসটি দুবাই থেকে সিলেট হয়ে ঢাকায় আসার পর সোনার চালান খালাস করতে পারেনি। তারপর এয়ারবাসটি নেপাল হয়ে ফিরে আসার পর হ্যাঙ্গারে নেয়ার পর শুল্ক গোয়েন্দারা জানতে পারে, সোনার বিশাল চালান নিয়ে এয়ারবাসটি ঘুরছে। তখনই চালানো হয় অভিযান। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, নেপালের গৌরাঙ্গ রোসান, ভারতের মি. জ্যাসন প্রিন্স, বাংলাদেশের জসিম উদ্দিন ও মিলন শিকদার নামের চার প্রভাবশালী এ চালানের নেপথ্য নায়ক হিসেবে মূল ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়া বিমানের আরও দশ জনের নাম উঠে আসে। তারা হলোÑবিমানের জুনিয়র সিকিউরিটি অফিসার মোঃ কামরুল হাসান, সুইপিং সুপারভাইজর মোঃ আবু জাফর, এয়ারক্রাফট মেকানিক মোঃ মাসুদ, এ্যাসিস্ট্যান্ট এয়ারক্রাফট মেকানিক মোঃ আনিস উদ্দিন ভুঁইয়া, প্রকৌশল হ্যাঙ্গারের মেকানিক ওসমান গণি, ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার সালেহ আহমেদ, মজিবর রহমান- জুনিয়র ইন্সপেকশন অফিসার, মোঃ শাহাজাহান সিরাজ, রায়হান আলী ও মাকসুদ। তাদের সবাইকে মামলায় আসামি করা হয়েছে। মামলার নং ১৩ (১২) ২০১৪। মামলার বাদী ঢাকা কাস্টমস হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোস্তফা জামাল। জানতে চাইলে শুল্ক বিভাগের মহাপরিচালক মইনুল খান জনকণ্ঠকে বলেন, বিভাগীয় তদন্ত শেষে এয়ারপোর্ট থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে অনেক কিছুই পাওয়া গেছে। যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের পুলিশী কায়দায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে আরও রহস্য বের হয়ে আসবে। বিশেষ করে ওই ফ্লাইট (এয়ারবাসের) ক্যাপ্টেন আবদুল বাসিত মাহতাব,ফার্স্ট অফিসার আসিফ ই্কবাল ও চীফ পার্সার সাইদুল সাদিরও এতে জড়িত থাকতে পারে বলে মনে হয়। তাদের পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়ত প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। তাদের সহযোগিতা ছাড়া এয়ারবাসটিতে চোরাচালানিরা এতটা নিরাপদে সোনা ওঠাতে পারত না। তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ওই সোনার চালান আটক করার কয়েকদিন নেপালের গৌরাঙ্গ রোসান নামের এক ব্যক্তি তার মালিকানা দাবি করে ঢাকা কাস্টমস হাউসে একটি আবেদন জমা দেন। আর মিলন শিকদার নামের এসএস কার্গোর চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়ে, ৯৯ কুড়াতলী, ক/৯০/১ খিলক্ষেত ঠিকানা উল্লেখ করে ওই সোনার চালান খালাস করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তদন্তকারীরা বার বার ওই ঠিকানায় গিয়ে তাকে পায়নি। তার কোন বক্তব্য রেকর্ড করতে পারেনি। একই অবস্থা হয় নেপালের নাগরিক গৌরাঙ্গের বেলায়ও। তারও কোন হদিস পায়নি তদন্তকারীরা। ভারতের নাগরিক মিঃ জ্যাসন প্রিন্স ওই ফ্লাইটে চেক ইন লাগেজ ব্যতীত যাত্রী হিসেবে ঢাকায় আসেন। এম্বারকেশন কার্ডে ঢাকায় তার ঠিকানা উল্লেখ ছিল হোটেল ওয়েস্টিন। কিন্তু তারও কোন হদিস মিলেনি। সূত্র জানায়, অপর আসামি জসিম উদ্দিনের ব্যাপারে জানা যায়, তার পাসপোর্ট নং এ, ই, ৫১৬৬৩০৩। গত ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত তিনি মোট ৩১ বার দুবাই ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ঢাকায় যাতায়াত করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তিনিই এ সিন্ডিকেটের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের গডফাদার। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নেপালী নাগরিক গৌরাঙ্গ রোসান তার আবেদনপত্রে স্বীকার করেন, এই ১২৪ কেজি সোনার মালিক তিনি। ঢাকায় আটকের সময় তার কাগজপত্র সাবমিট করা হয়নি। পরে তিনি মিলন সিকদারের কাছেই সোনা বিক্রি করে দেন। তাই মিলনকেই এ সোনার চালান বুঝিয়ে দেয়ার আবেদন জানান তিনি। তদন্তকারীরা বার বার রোসান ও মিলনকে নোটিস দেয়া সত্ত্বেও তারা হাজির হয়নি। এদিকে এয়ারপোর্ট থানার পুলিশ জানায়, মামলার তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। একে একে সবাইকে জিজ্ঞাসা করা হবে। প্রয়োজনে ক্যাপ্টেন মাহতাব ও ফার্স্ট অফিসার আসিফ ইকবালকেও আটক করা হবে। ইতোমধ্যে বিমানের অন্যান্য কর্মচারী গা-ঢাকা দিয়েছে। অপর একটি সূত্র জানায়, এই ত্রিদেশীয় সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্প্রতি গ্রেফতারকৃত পাইলট আবু আসলাম শহিদ, ডিজিএম এমদাদ, পলাশ ও তোজাম্মেল জড়িত কিনা সেটাও খতিয়ে দেখবে ডিবি পুলিশ।
×