ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যাশলেস বাংলাদেশ 

বিনির্মাণে প্রয়োজন জনসচেতনতা ও সবার সমষ্টিগত অংশগ্রহণ

প্রকাশিত: ০২:১০, ১ এপ্রিল ২০২৪

বিনির্মাণে প্রয়োজন জনসচেতনতা ও সবার সমষ্টিগত অংশগ্রহণ

মো. মৌলুদ হোসেন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার  স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড প্রোডাক্ট, উপায়

২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। আর এক্ষেত্রে স্মার্ট বাংলাদেশের যে চারটি স্তম্ভ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা হলো: স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট। আর এ চারটি স্তম্ভের সঙ্গেই যুক্ত আমাদের দৈনিক আর্থিক লেনদেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কত দ্রুত আমাদের আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থাকে ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তর করতে পারব এবং নগদ অর্থবিহীন লেনদেনকে নিত্য সাধারণ প্রথায় পরিণত করতে পারব। 
এ ক্ষেত্রে, সরকার ইতোমধ্যে বহুমুখী নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যেমনÑ গত বছরে ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ক্যাশলেস লেনদেন সেবা উদ্বোধন করে। বাংলা কিউআর পেমেন্ট ব্যবস্থায় কিউআর কোডের মাধ্যমে পেমেন্ট পরিশোধসহ ডিজিটাল লেনদেনের সুফল সম্পর্কে সবাইকে জানাতে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সচেতনতা বৃদ্ধিতে এ উদ্যোগ যেমন ভূমিকা রাখবে, তেমনি ক্যাশলেস বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সরকারও ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে সকল ধরনের লেনদেনের ৩০ শতাংশ ক্যাশলেস বা ডিজিটাল করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।      
উন্নত বিশ্বের দেশগুলো ইতোমধ্যেই ক্যাশলেস সোসাইটিতে পরিণত হওয়ার যাত্রায় অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে; যে তালিকায় এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো উন্নত দেশ। নরওয়েতে যেমন প্রায় মাত্র ২ শতাংশ পেমেন্ট হয় নগদ অর্থ দিয়ে; অন্যদিকে, ব্যাংক অব ফিনল্যান্ড ধারণা করেছে, আগামী ২০২৯ সালের শেষের মধ্যে ফিনল্যান্ডে ব্যাংক নোটের ব্যবহার আর থাকবে না। চীনের মানুষ যেমন নগদ অর্থের ওপর নির্ভরশীল। তাই ২০২২ সালে চীন সরকার ডিজিটাল অর্থ নিয়ে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালু করে। এবং ক্রমশই চীনে ডিজিটাল অর্থ জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। এর মাধ্যমেই প্রতীয়মান, বিশ্ব এখন ক্যাশলেস লেনদেনের দিকে ঝুঁকছে।  
নগদ অর্থবিহীন বা ক্যাশলেস বলতে সহজে বলা যায় নগদ অর্থের বিপরীতে মোবাইলে এমএফএস ওয়ালেট, ক্রেডিট-ডেবিট কার্ড ও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে লেনদেন করা। দৈনিক লেনদেনের ক্ষেত্রসমূহ, যেমন: পণ্য কেনা বা সেবাগ্রহণের পেমেন্ট পরিশোধ এবং যাতায়াতসহ আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মানুষ ক্রমশই ক্যাশলেস লেনদেনে অভ্যস্ত হচ্ছেন। কোভিডের বৈশ্বিক মহামারি আবির্ভাবের পর ক্যাশলেস লেনদেনে অভ্যস্ততা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

অনলাইনে বা দোকান থেকে পণ্য কেনা, মোবাইল রিচার্জ, রেস্টুরেন্টের বিল দেওয়া, নানা ক্ষেত্রে এমএফএসের মাধ্যমে দাম পরিশোধ করা হচ্ছে। ক্যাশলেস ব্যবস্থার সুবিধাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গা থেকে সহজে ও দ্রুত লেনদেন সম্পন্ন করা এবং অতিরিক্ত টাকা সঙ্গে না রাখার জন্য আর্থিক নিরাপত্তাও বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখে ক্যাশলেস লেনদেন- এতে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা কমে যায় এবং জাল টাকা থেকেও সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ দেশব্যাপী ডিজিটাল লেনদেন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখছে এমএফএস। দেশে ২০১৯ সালে এমএফএস অ্যাকাউন্ট ছিল ৮.৪৩ কোটি, চার বছরে এমএফএস অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২২ কোটি (নভেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত)। দেশজুড়ে ডিজিটাল কানেক্টিভিটির প্রসার এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে- যা ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে বাংলাদেশের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করছে। মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) কল্যাণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও সহজে দৈনন্দিন লেনদেন সম্পন্ন, সঞ্চয় ও পেমেন্ট পরিশোধ করতে পারছেন। লেনদেনে স্বাচ্ছন্দ্য থেকে অ্যাকাউন্টের নিরাপত্তা, অর্থের সুরক্ষা এবং সহজে সঞ্চয় সুবিধার কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে এমএফএস সেবা। বিশেষ করে, সুবিধাবঞ্চিত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষরা বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছেন। গ্লোবাল ফিনডেক্স ডেটাবেইজ অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মাঝে ডিজিটাল ওয়ালেট কিংবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার ২২ শতাংশ (৩১-৫৩ শতাংশ) বৃদ্ধি পেয়েছে।  বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি মাসে এমএফএসের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে মোট ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৪৫ দশমিক ৪৭ কোটি টাকার; বেশি পেছনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই- ডিসেম্বর ২০২৩ মাসের চেয়ে যা ৩.৯৩ শতাংশ বেশি।    
এক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে এমএফএস সেবার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে এবং উদ্ভাবনী সব সেবা নিয়ে আসছে। এমএফএস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান উপায় যেমন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) পিএলসির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে চালু করেছে এমএফএস কো-ব্র্যান্ডেড প্রিপেইড কার্ড, যার মাধ্যমে গ্রাহকরা নানারকম সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করতে পারছেন। ডুয়াল কারেন্সি সমর্থন করার কারণে দেশে বিভিন্ন সুবিধা উপভোগের পাশাপাশি, কারেন্সি কনভার্সন করা ছাড়াই দেশের বাইরেও এ কার্ড ব্যবহার করা যাবে; পাশাপাশি, ফ্রিল্যান্সিংকেও সহজ করে তুলবে এ কার্ড। এ ছাড়া গ্রাহকরা এই কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটার সময়েও উপভোগ করতে পারবেন দুর্দান্ত সব অফার।        
তবে, জাতীয়ভাবে ক্যাশলেশ সোসাইটির লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ। প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ দেশজুড়ে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আরও বেশি বিনিয়োগ এবং ডিজিটাল লেনদেনবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করা। আরেকটি বিষয় এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে দেশের নাগরিকদের স্মার্টফোন ও অ্যাপ ব্যবহারে উৎসাহিত করা, কারিগরি জটিলতা হ্রাসে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যূথবদ্ধভাবে কাজ করা এবং গ্রাহক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর এসব ক্ষেত্রে সব পক্ষ একসঙ্গে এগিয়ে এসে সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলেই সম্ভব ক্যাশলেস বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
 

×