ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

যেমন ছিল আমার ২৬ মার্চ, ১৯৭১

খুররম মমতাজ

প্রকাশিত: ০০:৪৮, ২৬ মার্চ ২০২৪

যেমন ছিল আমার ২৬ মার্চ, ১৯৭১

কেমন ছিল সেই দিনটি আমার জন্য

কেমন ছিল সেই দিনটি আমার জন্য? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে অনিবার্যভাবে এসে যায় এর আগের দিনের কথা- ২৫ মার্চ, ১৯৭১, যেদিন জেনোসাইড শুরু করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ঢাকা শহরে ত্রিমুখী আক্রমণ করেছিল তারা- পিলখানায় (বর্তমান বিজিবি হেড কোয়ার্টার), রাজারবাগে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। 
সেদিন আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবসিক এলাকা ফুলার রোডে, মা-বাবা-ভাই-বোনের সঙ্গে। সারারাত আমরা বিরামহীন গোলাগুলোর শব্দ শুনলাম। দেখলাম মাঠের পূর্ব দিকে রেললাইনের বস্তি পুড়িয়ে দিচ্ছে সৈন্যরা, নির্বিচারে হত্যা করছে বস্তিবাসীদের। ফুলার রোডের তিন পাশে ছাত্রদের তিনটা হল। পশ্চিমে ইকবাল হল (এখন জহুরুল হক হল), পূবে জগন্নাথ হল ও দক্ষিণে সলিমুল্লাহ হল। সারারাত এই হলগুলোতে ঢুকে রুমে রুমে সার্চ করে ছাত্রদের হত্যা করেছে সৈন্যরা। পরদিন সকালে ফুলার রোডে ঢুকলো খুনের নেশায় উন্মত্ত হায়েনার দল। 
২৬ মার্চ, সকাল আটটা। মা রান্নাঘরে নাস্তা তৈরি করছে। হঠাৎ ছুটে এলো বড় ঘরে। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে মা দেখেছে সারি সারি সৈন্য ঢুকছে আমাদের পাড়ায়। বাবা দাড়ি কাটছিল। গালে সাবান মাখা অবস্থায় এসে দাঁড়াল জানালার পাশে। আমরা দেখলাম সৈন্যরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল গেল ডানে, একদল বাঁয়ে আর তৃতীয় দলটা সোজা এগিয়ে এলো আমাদের আঠারো নম্বর বিল্ডিংটার দিকে।

আলগোছে জানালার পর্দা ছেড়ে দিয়ে আড়ালে সরে গেল মা। আমাদেরও সরে যেতে বলল। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সৈন্যগুলো, বোধহয় ভাবছে কোনো বাড়িতে ঢুকবে। খুব কাছেই ওরা। এত কাছে যে ওদের হেলমেটের গায়ে লাগানো জালের সুতো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। প্রত্যেকের হাতে রেডি অস্ত্র। ভীষণ বিপজ্জনক কয়েকটা মুহূর্তÑ জানালার পর্দা একটু কাঁপলেই গুলি করবে। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এমন সময় গেটের দিক থেকে একজন খাকি পোশাক এই খাকি পোশাকগুলোকে ডাকলো। এরা ঘুরে চললো গেটের দিকে।

ডানদিকে বারো নম্বর বিল্ডিংয়ের দিকে গিয়েছিল একটা দল। সেদিক থেকে কয়েকটা গুলির শব্দ ভেসে এলো। একটু পরে একজন মৃত মানুষকে দুটো সৈন্য মিলে ধরাধরি করে এনে রাখলো মাঠের মাঝখানে। এরপর একইভাবে নিয়ে এলো আরেকজনকে। তার পর আরও একজন। এভাবে তিনজন সদ্যমৃত মানুষকে তারা মাঠের মাঝখানে নিয়ে এসে সার দিয়ে রাখলো।
একটা ট্রাক এসে দাঁড়ালো। মৃত মানুষগুলোকে তারা বালুর বস্তার মতো ছুঁড়ে দিল একে একে ট্রাকের ওপর। তারপর নিয়ে চলে গেল। মৃতদেহ বহন করে আনছিল যারা, তাদের মধ্যে একজন সাধারণ মানুষকে দেখলাম। দূর থেকে তাকে চিনতে পারিনি আমি। পরে জানলাম তিনি আমাদের পাড়ার বাসিন্দাÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার মোহম্মদ মোর্তজা। সেদিন একটা ছাত্রকে বাঁচানোর জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন ডাক্তার।
খুব ভোরে যখন প্রচ- গোলাগুলি চলছে, হল অক্রমণ করেছে সৈন্যরা, ছাত্রটা ইকবাল হল আর ফুলার রোডের মাঝখানের উঁচু দেয়াল টপকে এপাশে লাফিয়ে নামে। নামার সময় বেকায়দায় পড়ে তার পা ভেঙে যায়। সে আর নড়াচড়া করতে পারছিল না। একতলার জানালা দিয়ে দৃশ্যটা দেখতে পান ডাক্তার মোর্তজা। গোলাগুলির ভিতরেই তিনি ছেলেটাকে উদ্ধার করতে বেরিয়ে পড়েন। সবচেয়ে কাছে বিশ নম্বর বিল্ডিং। ছেলেটা হাঁটতে পারছে না, তাকে তিনি ধরে ধরে ঐ বিল্ডিংয়ের একতলার ফ্ল্যাটে নিয়ে যান।
আহত ছেলেটাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ফিরে আসছিলেন ডাক্তার। সে সময় সৈন্যদের নজরে পড়ে যান তিনি। দূর থেকে রাইফেল তাক করে তারা চিৎকার দেয়Ñ হ্যান্ডস আপ! ইধার আও।
দু’হাত উপরে তুলে ডাক্তার চেঁচিয়ে বলেন, ‘ডোন্ট শ্যূট...ডোন্ট শ্যূট! আই এম এ ডক্টর।’ সৈন্যরা তাকে দিয়ে নিথর দেহগুলো চেক করায় কেউ বেঁচে আছে কিনা। ডাক্তার বলেন কেউ বেঁচে নেই। তারা বলে ঠিক আছে এবার হাত লাগাও, এদের বয়ে নিতে হবে। ডাক্তার নীরবে সৈন্যদের নির্দেশ পালন করেন। সেদিন ভাগ্য জোরে তিনি বেঁচে যান। তাঁর আয়ু ছিল আর মাত্র নয় মাস। চৌদ্দই ডিসেম্বর ফুলার রোডের শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁকেও তুলে নিয়ে যাবে আলবদর বাহিনী। তিনি আর ফিরে আসবেন না।
সেদিন মৃতদেহ ভর্তি ট্রাক আর সৈন্যরা চলে গেল। আমরা তখনো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আব্বা নিজের ঘরে চলে গেছে। এমন সময় দেখা গেল গেট দিয়ে আবার কারা যেন ঢুকছে। না সৈন্য নয়, খাকি পোশাক নয়, সাধারণ মানুষ। একটু এগিয়ে আসতেই আমি চিনতে পারলামÑ আমার বন্ধু মোমিন আর তার মা। সঙ্গে তাদের কাজের ছেলে মান্নান। মান্নানের মাথায় একটা ট্রাংক। পাড়ার রাস্তাটা ধরে তারা সোজা এগিয়ে আসছে আর বিভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।

মা ওদের ডাক দিল। তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে হাঁপাতে লাগলো ওরা তিনজন। তিনজনের চোখেমুখেই ফুটে আছে ভয় আর আতংকের ছাপ। হাঁপাতে হাঁপাতে মোমিন বললো আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়া। মোমিন আমাদের জানালো রাত তিনটার দিকে আর্মি ঢোকে ওদের বাড়িতে। ঢুকে বলে কে নাকি গুলি ছুঁড়েছে, তাই বাড়ি তল্লাশি করবে ওরা। মোমিনের আব্বার একটা শিকার করার দোনলা বন্দুক ছিল। তল্লাশির সময় বন্দুকটা বেরিয়ে পড়ে এবং সৈন্যরা মোমিনের মামা, বাবা আর মোমিনকে ধরে নিয়ে যায় হলের মধ্যে।
মোমিনের বাবা কিছুদিন পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরি করেছেন। সেজন্য মোমিনের মা ভালো উর্দু বলতে পারতেন। তিনি সৈন্যগুলোকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন- এই বাড়ি থেকে কেউ গুলি ছোঁড়েনি, এটা একজন শিক্ষকের বাড়ি এবং তারা নিরীহ নিরপরাধ মানুষ। কথাবার্তার ফাঁকে একজন বালুচ সৈন্য পানি খেতে চাইলে তাকে কয়েকটা বিস্কুট এবং একগ্লাস পানি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
সৈন্যগুলো যখন মোমিন, মোমিনের বাবা আর মামাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো, মোমিন দেখতে পায় হলের মধ্যে আগুন জ্বলছে। সৈন্যরা রুমে রুমে ছাত্রদের খুঁজছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে দোতলার গরাদবিহীন জানালা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে নিচে। মোমিনদের তিনজনকে দারোয়ানের ছোট্ট ঘরে নিয়ে আটকে রাখে সৈন্যরা। দরজায় তালা মেরে চলে যায়। এদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে চারদিকে।

একটু পরে দুজন সৈন্য এসে দরজার তালা খুলে তাদের বাইরে বের হতে বলে। সৈন্যদের একজন মোমিনকে বলে, ‘তুম ভাগ যাও।’ এই বলে ওর বাবা আর মামাকে নিয়ে চলে যায়। মোমিন তখন দৌড়ে বাসায় ফিরে আসে। সকাল হলে তারা ট্রাংকের মধ্যে দু’একটা দরকারি জিনিস ভরে এক কাপড়ে বেরিয়ে চলে আসে আমাদের পাড়ায়। মোমিনের আম্মা ফিসফিস করে আমার মাকে বললেন, ‘ভাগ্যিস মেয়েদের আগেই দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, নাহলে আজকে কী হতো কে জানে।’
সারাদিন আতংকের মধ্যে কাটলো। সকালে রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষণা হলো অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউÑ কেউ বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না, বেরোলেই গুলি। পঁয়ষট্টি সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় একটা ট্রানজিস্টার কেনা হয়েছিল খবর শোনার জন্যÑ  সেটাতে কান লাগিয়ে বসে আছি আমরা। মোমিন নিঃশব্দে কাঁদছে। ওর বাবা মামা বেঁচে আছেন কিনা আমরা কেউ জানি না। একটু পরে আমি আর মোমিন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ও একটু স্বাভাবিক হলে জানতে চাইলাম, ‘আর্মিরা তোদের একতলা সার্চ করেছিল?’
‘হ্যাঁ করেছিল।’
‘মলোটভ ককটেলগুলো দেখতে পায়নি?’
ঘটনা বললো মোমিন। সৈন্যরা যখন দোতলায় সার্চ করছিল, দুজন সৈন্য ওকে নিয়ে নিচ তলায় নেমে আসে। উঠোন পেরিয়ে স্টোররুমের সামনে চলে আসে তারা। প্রথম ঘরটায় উঁকি মারে একজন, অন্যজন উঠোনে দাঁড়িয়ে বন্দুক তাক করে থাকে। দ্বিতীয় ঘরটা যখন সার্চ করতে এগিয়ে এলো- মেমিন বুঝলো এবার সব শেষ। আগের দিন আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে অনেকগুলো মলোটভ ককটেল বানিয়ে এখানে রেখেছিলাম। অসহযোগ আন্দোলন চলছিল মার্চের এক তারিখ থেকে।

আমাদের প্ল্যান ছিল এই ককটেলগুলো আমরা সুবিধা মতো ব্যবহার করবো আর্মি ট্রাকের ওপর। কিন্তু তার আগেই পঁচিশে মার্চের গজব নেমে এসেছেÑ শুরু হয়েছে জেনোসাইড।
ভিতরে ভিতরে কাঁপছে মোমিন। এখন যদি সৈন্যরা ঢোকে এই ঘরে, মলোটভ ককটেলের বোতলগুলো দেখতে পাবেÑ তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই ওকে গুলি করে মারবে। হয়তো এ বাড়ির সবাইকেই মরতে হবে। দরজার সামনে গরুটা শুয়ে আছে। গত রাতে উঠোনের কোনায় গাছের সঙ্গে বাঁধা ছিল গরু, যেমন প্রতিদিন থাকে। রাতে  গোলাগুলির ভিতরে মোমিন নেমে এসেছিল নিচে। গরুটাকে সে উঠোন থেকে এনে দরজার সামনে বেঁধে রেখেছিল। কড়ার সঙ্গে দড়িটা বাঁধা।
দড়ি খুলতে বললো সৈন্যটা। এত মানুষ দেখে গরুটা ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়েছে। দরজার সামনে গোবর। গোবর ডিঙিয়ে মোমিন দরজার কাছে গিয়ে দড়ি খুলে একপাশে সরে দাঁড়ালো। বন্দুকের নল দিয়ে দরজাটা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিল সৈন্যটা। ভেতরে ঢুকবে, এমন সময় দোতলা থেকে একটা সৈন্য চিৎকার দিয়ে ডাকলো, ‘আসলাম আ যাও। যানা পড়ে গা।’ সৈন্য দুটো ফিরে গেল। মোমিন বলে, ‘অল্পের জন্য বেঁচে গেলাম।’
দুপুরের দিকে খটখট করে উঠলো দরজার কড়া। খুলে দেখি মোমিনের আব্বা। তাঁকে মারেনি সৈন্যরা, দয়া করে ছেড়ে দিয়েছে। তিনি ঘরে ঢুকেই আগে নামাজ পড়লেন। দোয়া শেষ হলে একটা মাত্র কথা বের হলো তাঁর মুখ দিয়ে- ‘মুন্সিকে নিয়ে গেছে।’ মুন্সি হচ্ছে মোমিনের মামা। সে রাতটাও গেল আতংকের মধ্যে দিয়ে। সে রাতেও গোলাগুলির শব্দ শুনলাম। ভাঙা ভাঙা ঘুম আর দুঃস্বপ্নের ভিতর দিয়ে কেটে গেল আরেকটা রাত। সকালে যে জিনিসটা আমি প্রথমে লক্ষ্য করলামÑ আব্বার মাথার চুল অনেকগুলো সাদা হয়ে গেছে। এক রাতেই যে মানুষের বয়স এমন বেড়ে যেতে পারে আব্বাকে না দেখলে আমি বুঝতে পারতাম না।
রেডিওর ঘোষণা থেকে আবার জানা গেল কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছে কিছু সময়ের জন্য। আমি আর মোমিন মুন্সি মামাকে খুঁজতে বের হলাম। প্রথমে গেলাম হলের দিকে। বাস্কেটবল কোর্টের পাশে একটা জটলা। সেদিকে গিয়ে দেখি সাতÑআটটা মৃতদেহÑ গুলির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। ফুলে উঠেছে দেহগুলো। তার ভিতরে মুন্সি মামাকে খুঁজতে থাকলো মোমিন। তাকে সেখানে পাওয়া গেল না। ফুলার রোডে যাদের হত্যা করেছে ছাব্বিশে মার্চ সকালে, তাদের মৃতদেহ দেখলাম এখানে। ক্যান্টিনের পাশে কিচেন আর ছাত্রদের লন্ড্রি। সেখানে থাকে কর্মচারীরা। দুজনের মৃতদেহ পড়ে আছে।
আমরা গেলাম হলের প্রধান গেটের দিকে। গেটের উল্টো পাশে অডিটোরিয়াম। হলের পাশে পানির পাম্প। সেখানে কয়েকটা মৃতদেহÑ লাকড়ির মতো স্ট্যাক দিয়ে রাখা। সেগুলো পেট্রোল দিয়ে পোড়ানো হয়েছে। বীভৎস দৃশ্যÑ তাকানো যায় না। আমরা এবারে গেলাম আরও দূরে নীলক্ষেতের দিকে। রেললাইন পার হতেই দেখি পেট্রোল পাম্পের মধ্যে একটা লোক শুয়ে আছে। কাঁচ ঘেরা ঘরের মধ্যে লোকটাকে দেখাচ্ছে মোমির মতো। তার বুকের কাছে বুলেটের চিহ্ন লাল হয়ে আছে।

মেঝেতে খানিকটা রক্ত গড়িয়ে পড়েছে। কাঁচের দেয়ালে দেখলাম একটা ফুটো- এদিক দিয়ে গুলিটা ঢুকেছে। মোমিন বললো, ‘চল ফিরে যাই।’ ফেরার পথে জটলা দেখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের পেছনটা ঘুরে গেলাম। দালানের পেছনে চাতালে পাঁচ-ছয়জন মানুষ, গৃহহীন নিঃস্ব মানুষ। রাতে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। একটি ভিক্ষুক পরিবারÑ বাবা-মা, ছোট ছোট দুটো ছেলেমেয়েÑ বাবার হাঁটু ভাঁজ হয়ে দেয়ালে ঠেস দেওয়া। তাদের গুলিবিদ্ধ দেহগুলো পড়ে আছে।
দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় ফিরলাম আমি আর মোমিন। এদিকে তখন বাঁধাছাদা চলছে। একটা টিনের মধ্যে আটা আর বস্তায় চাল নেওয়া হয়েছে। ট্রাংকের মধ্যে কাপড় গোছাচ্ছে মা। পুরানা পল্টনে থাকেন আমাদের এক মামা। আসলে রক্তের সম্পর্ক কিছু নেই। কিন্তু রক্তের সম্পর্কটাই তো সব নয়, তার চেয়েও গাঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে মানুষে মানুষে। তেমনি এক মামা এসেছেন আমাদের খোঁজ নিতে এই দারুণ দুঃসময়ে। আমরা তাঁকে ছোটবেলায় ডাকতাম ‘মোটকা মেজোমামা।’

অনেক পরে ডায়াবেটিস হয়ে তিনি যখন শুকিয়ে গিয়েছিলেন, তখনো তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় মোটকা মেজোমামা। তিনি তাঁর গাড়িতে লিফট দেবেন, যেখানে আমরা যেতে চাই। তাঁর ফোক্স ওয়াগেন গাড়িটা দেখতে বিরাট একটা কচ্ছপের মতো।
সেই গাড়িতে চালের বস্তা, আটার টিন, ট্রাংক সব তোলা হয়েছে। আব্বা দরজায় তালা দিয়ে নেমে এলেই রওনা দেব আমরা। সময় নাই। কয়েক ঘণ্টা পরেই আবার শুরু হবে কারফিউ, আবার গুলি, আবার হত্যা। তার আগেই পালাতে হবে এই হত্যাপুরী ছেড়ে। কিন্তু কোথায় যাবো আমরা, কোথায় পালাবো? মা বললো, ‘আগে তো এখান থেকে বের হই। তারপর ভাবা যাবে।’ গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে।

দূর থেকে একজন মানুষ এদিকে আসছে। তার কাপড়Ñচোপড় ছেঁড়া, চুল উস্কোখুস্কো, পাগলের মতো দেখাচ্ছে তাকে। দু’হাতে বুক চাপড়াচ্ছে লোকটা আর বলছে, ‘আমার বোন কই? আমার বোন কই?’ মোমিন চিৎকার দিয়ে ডাকলো, ‘মুন্সি মামা!’
মুন্সি মামা ছুটে এলেন আমাদের দিকে। তাকে হত্যা করার দায়িত্ব পড়েছিল বালুচ সৈন্যটার ওপর, যাকে পানি খেতে দিয়েছিলেন মোমিনের মা। মুন্সি মামাকে মারেনি সৈন্যটা। তার পাশে ছিল পাঞ্জাবি সৈন্য। সে গুলি করবেই। বালুচ সৈন্যটা তাকে বোঝালো, ‘ইয়ে নওজোয়ান হ্যায়, ইসকো ছোড় দো।’ তারপর মুন্সি মামাকে বললো, ‘তোমার হাতের ঘড়ি আর আংটি ওকে দিয়ে দাও।’ মুন্সি মামা শৌখিন মানুষ।

তার হাতে দামি ঘড়ি, অনেকগুলো সোনার আংটি। দ্রুত কাঁপা কাঁপা হাতে সব খুলে তিনি পাঞ্জাবি সৈন্যটাকে দিয়ে দিলেন। পকেট থেকে দামি মানিব্যাগ বের করলেন, সেটাও দিলেন। বিনিময়ে ফিরে পেলেন জীবন। বালুচ বললো, ‘এবার পালাও। আমি গুলি করবো, তোমার গায়ে লাগাবো না, পালাও!’ মুন্সি মামা পালিয়ে একটা ড্রেনের মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন একদিন দুইরাত।
 মোমিনরা তাদের মতো চলে গেল। মুন্সি মামার গল্প শুনে সবাই কেমন থম মেরে আছে। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেজোমামাকে বললো, ‘ভাই, গাড়ি ছাড়েন।’
গাড়ি ছুটে চললো অজানার উদ্দেশ্যে।

×