মোরসালিন মিজান ॥ শিল্প কাব্যে কোথায় আছে হায়রে/এমন সোনার দেশ...। সোনার এ দেশটিকেই এঁকে চলেছেন সোহাগ পারভেজ। অনেকদিন ধরে আঁকছেন। আর তারপর ষষ্ঠ একক প্রদর্শনী। গত ২২ আগস্ট রাজধানীর এ্যাথেনা গ্যালারিতে শুরু হয়েছিল। এখনও চলছে। প্রদর্শনীর শিরোনাম- আমার সোনার দেশ। এখানে শিল্পীর পূর্বের কাজের ধারাবাহিকতা। খুব প্রিয় অরণ্য, পাহাড়, নদী, নদীর পাশে বেড়ে ওঠা জীবন- সবই আপন সৌন্দর্য নিয়ে দৃশ্যমান হয়। শিল্পী স্বদেশের সবটুকু সবুজ চোখে মেখেছেন। আরও যত ছিটেফোঁটা রং খুঁজে নিয়েছেন প্রকৃতি থেকে। নিসর্গের অংশ হয়েই এঁকেছেন নিসর্গকে। এভাবে রঙের, রূপের হয়ে উঠেছে ক্যানভাস। ছবিগুলো দেখতে দেখতে ‘সবুজের বুক চেরা মেঠো পথে’ হাঁটা হয়ে যায়। এই হেঁটে চলার আনন্দ উপভোগ করার মতো বৈকি!
নাগরিক জীবনের যে কোলাহল, ক্লান্তি সব নিয়েই প্রবেশ করতে হয় গ্যালারিতে। তবে সেখানে প্রবেশের পর খুব দ্রুতই মন বদলে যেতে থাকে। সবুজের মায়ায় পেয়ে বসে। মনকে রাঙিয়ে দেয়ার উৎসব শুরু হয়। রঙের ছড়াছড়ি থেকে উজ্জ্বল রঙগুলো বেছে নেন শিল্পী। সুন্দর ব্যবহার করেন। নিজের মতো করে ভাষা দেন। বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করলেও বিষয় অভিন্নÑ চিরায়ত বাংলার রং ও রূপ। শিল্পী এখানে রিয়েলিস্টিক। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। অনেকটা ক্লাস স্টাডির ঢঙে এঁকেছেন। যেন প্রকৃতির তিনি বাধ্যগত ছাত্র। কখনও বিস্তীর্ণ বন, যতদূর চোখ যায় শিল্পী জলরঙে ফুটিয়ে তুলেছেন। কখনও বিপুল সবুজ থেকে ছোট করে নিজের চিত্রভাষা খুঁজে নিয়েছেন। বেশিরভাগ কাজ জলরঙে। জলরঙের ছবিতে কলমে আউট লাইন টেনেছেন। দারুণ দক্ষ হাতে।
বাংলাদেশ যেহেতু, নদী চিনতে হবে। নদী দিয়ে চিনতে হবে। এমন উপলব্ধি থেকেই হয়ত প্রবহমান নদীকে আপন করে নেন শিল্পী। তার ছবির জরুরী অনুসঙ্গ হয়ে আসে নৌকো। নদী ও নৌকোকেন্দ্রিক জীবনজীবিকার খোঁজ করতে শিল্পী পৌঁছে যান চট্টগ্রামের চাকতাই খালে। আর তখন নদী কেন্দ্রীক ব্যবসাবাণিজ্যের চিরচেনা দৃশ্যটি তার নিজস্ব ভাষায় কথা বলে ওঠে। এখানে নৌকো মানে, মাছ ধরার ট্রলার। মালামাল পরিবহন। নদীর দুইপারে সবুজ গ্রাম। হাট। রেফারেন্স থেকে জলরঙে চমৎকার আঁকেন শিল্পী। ডিটেইল করেন। একাধিক চিত্রকর্মে বেদে জীবন। নদীর ওপর স্থির হয়ে আছে নৌকো। ডাঙায় শাপ খেলা দেখানো শেষে অস্থায়ী নীড়ে ফিরতে দেখা যায় বেদে মেয়েদের। এসব ছবি আঁকতে শুধু উজ্জ্বল নয়, অত্যুজ্বল রঙের ব্যবহার করেছেন শিল্পী।
সোহাগ পারভেজ সমতলে যেমন তেমনি ছুটে যান পাহাড়ে। পার্বত্য এলাকার ঘন সবুজ বন-পাহাড় তার রং তুলির ছোঁয়ায় যেন নতুন প্রাণ পায়। বান্দরবানের রাখাইন পাড়ার ছবি দেখে তো চোখ জুড়িয়ে যায়। এখানে রিয়েলিস্টিক এবং একই রকম ডিটেইল। জলরঙে আঁকা ছবির কলমে টানা আউটলাইন মুগ্ধ পাঠকের মতো পড়া যায়। অধিকাংশ ছবিতেই পেপারের ওপর জলরঙ এবং তাতে কালো কালির কলম দিয়ে আউটলাইন এঁকে গতানুগতিক এবং পুরনো দেখা থেকে মুক্তি দিয়েছেন শিল্পী। প্রদর্শনীর ছবিতে স্থির প্রকৃতি যেমন আছে তেমনি দৃশ্যমান গতিশীলতা। তুমুল বৃষ্টি, ঝড়, ঝড়ের কবলে খেই হারানো নৌকো গতির সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয়।
গ্যালারিতে জলরঙে আঁকা ছবি ৬২টি। এ্যাক্রেলিকে করা কাজ আছে ৭টি। একটি পেস্টাল। পোস্টার একটি। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি ৭১। সব ছবি একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিত। দেখতে দেখতে বাংলাদেশ দেখা হয়ে যায়। প্রদর্শনী ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
সোহাগ পারভেজের ‘আমার সোনার দেশ’
জলরঙে জলের ছবি চিরায়ত বাংলার অত্যুজ্জ্বল মুখশ্রী
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: