ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা ॥ বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি

ড. মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ২৬ অক্টোবর ২০২৩

মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা ॥ বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলের মুহুর্মুহু বিমান, স্থল এবং নৌপথে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলের মুহুর্মুহু বিমান, স্থল এবং নৌপথে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়া এবং প্রাণহানির সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য দেশগুলোর প্রত্যক্ষ মদত ও সহায়তায় ইসরাইলের এমন বর্বর হামলায় মধ্যপ্রাচ্যের আরও কয়েকটি দেশের জড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কায় সবাই এখন ওই অঞ্চল থেকে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছে, যার লক্ষণ ইতোমধ্যেই ফুটে উঠেছে। ৭ অক্টোবর ইসরাইলিদের ওপর হামাসের আকস্মিক আক্রমণের পর থেকে বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারে দাম টানা দুই সপ্তাহ ধরে ঊর্ধমুখী। ৭৭ ডলারের ব্যারেলপ্রতি তেল এখন ৯৪ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে।

তেল ব্যবসায়ী, জ্বালানি বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে আরও ঊর্ধমুখী হতে থাকবে। নিরাপত্তার কারণে ইসরাইল তার দেশে মার্কিন কোম্পানি শেভরনকে প্রাকৃতিক গ্যাসফিল্ড বন্ধ করে দিতে বলেছে। ফলে সেখান থেকে মিসরে গ্যাস সরবরাহ কমেছে ২০ শতাংশ। অন্যদিকে, আরব দেশগুলোর সাধারণ মানুষ তাদের সরকারের ওপর পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে ‘তেল অস্ত্র’ প্রয়োগের জন্য ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব তেল বাজারের মূল কেন্দ্র মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা আরও জটিল হলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী দেশ, যারা মূলত জ্বালানিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তারা গুরুতর সংকটে পড়বে।

তারা বলছেন, বর্তমানে জ্বালানি সংকটে থাকা বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য ও বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি জ্বালানি আমদানিনির্ভরতা কমাতে আরও দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা, বাংলাদেশের উন্নয়নের মূলেই রয়েছে উল্লেখ করার মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্প্রসারণ, যার শক্ত ভিত্তি নির্ভর করছে আমদানিকৃত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর। ১৯৯১ সালে দেশের ১৪ শতাংশ বিদ্যুতের আওতায় ছিল। ২০২০ সালে মোট জনসংখ্যার ৯৬ শতাংশই বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় এসেছে। বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ কতটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠেছে। 
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। গত বছরের জুনে এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ১২০ ডলারের ওপরে উঠে যায়। যদিও পরে তা পর্যায়ক্রমে কমতে থাকে। চলতি বছরের মে মাসে তা কমে ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলারের কাছাকাছি নামে। কিন্তু ওপেক প্লাসের তেল উৎপাদন কমানোর ঘোষণায় আবারও ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে অপরিশোধিত জ্বালানির দাম। যার কারণে এক পর্যায়ে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেল ৯৫ ডলারের কাছাকাছি উঠে যায়। ওই সময়ে বাংলাদেশে তেলসহ অন্যান্য জ্বালানির দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় দেশে যে মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয় তা এখনো কমানো যায়নি।

বর্তমানে সবদিক থেকেই বাংলাদেশের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি, যা সামনের দিনগুলোয় আরও জটিল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। উচ্চমূল্যের কারণে জীবাশ্ম জ্বালানি, বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশকে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশ বরাবরই প্রাকৃতিক গ্যাসকে প্রধান জ্বালানি উৎস হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প, গৃহস্থালি, কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস (সিএনজি) ফিলিং স্টেশন এবং বাণিজ্যিক ভোক্তাদের ভোগান্তি বাড়তে থাকে। ঘনঘন লোডশেডিংয়ের ফলে শিল্প-কারখানায় চাপ সৃষ্টি হয়। যার প্রভাব গিয়ে পড়ে কর্মীদের মজুরি থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যের ওপর।

সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি নিয়ে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়ে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ধারায় আনার চেষ্টা করার মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতে নতুন উদ্বেগ বয়ে এনেছে। এ অবস্থায় বিশ্ব জ্বালানি বাজারে অনিশ্চয়তা নিরসনে যেহেতু আমাদের তেমন কিছু করার নেই, সেহেতু নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগানো জরুরি হয়ে পড়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির অনিশ্চয়তা ও আমদানি খরচ কমাতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের প্রতি সব দেশই গুরুত্ব আরোপ করছে। এক্ষেত্রে সবাই জোর দিচ্ছে সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি, বর্জ্যসহ প্রাকৃতিক উৎস থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনের ওপর। 
আধুনিক উন্নয়ন বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রকৃতি, পরিবেশ, উন্নয়নের সম্মিলনেই যে কোনো জনগোষ্ঠীর আগামীর টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নির্ভর করছে। যেখানে পরিবেশ শুধু পরিবেশ নয়, উন্নয়ন শুধু উন্নয়ন নয়; পরিবেশ প্রকৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং মানুষ সেখানে অনুষঙ্গ। প্রকৃত অর্থে একমাত্র প্রকৃতিই অসীম, যার কোনো শুরু ও শেষ নেই। অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির মতো মানুষের নিত্যব্যবহার্য প্রচলিত অধিকাংশ শক্তি বা জ্বালানি অনুষঙ্গই সসীম। সে কারণে ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য শক্তিই মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের প্রধান উৎস ও চালিকাশক্তি। সাধারণত বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস বিশেষত সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি, ভূ-তাপ, সমুদ্র তরঙ্গ, সমুদ্র-তাপ, জোয়ার-ভাটা, শহরের ময়লা-আবর্জনা, হাইড্রোজেন ফুয়েল নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। সভ্যতার প্রয়োজনেই এখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে জীবাশ্ম জ্বালানির বিপরীতে নবায়নযোগ্য শক্তি বর্তমানে বিশ্বে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। 
অধিকাংশ দেশ তাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ঝুঁকছে। বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌরশক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। পাশাপাশি রয়েছে বায়োগ্যাস ও বায়োমাস। বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। পানি থেকে বিদ্যুৎ, সোলার পিভি ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ, পৌর বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ, গোবর ও পোল্ট্রি বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস ছাড়াও সম্ভাবনার বিকল্প জ্বালানির অন্যতম সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হলো বাতাসের গতি, ধানের তুষ, আখের ছোবড়া, বর্জ্য, শিল্ট প্রক্রিয়ার অব্যবহৃত তাপ থেকে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি উৎপাদন।

বৈশ্বিকভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশের কথা বিবেচনা করলে আপাতদৃষ্টে মনে হবে, বাংলাদেশ খুব কম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে, বৈশ্বিকভাবে যা মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু এখন বিকল্প শক্তি উৎপাদনের পথে না গেলে এই অংশ ভবিষ্যতে আরও বাড়াবে, যা বাংলাদেশের জন্য পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হবে। উল্লেখ্য, নবায়নযোগ্য শক্তি বলতে যে শক্তিকে বারবার ব্যবহার করা যায় এবং ব্যবহারের পরও নিঃশেষ হয়ে যায় না এমন সব উৎসকে বোঝানো হয়, যা বাংলাদেশের মতো বিপুল জনগোষ্ঠী ও কম ভূখ-ের দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণেই সৌরবিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশ বেশ উপযুক্ত। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় ১১ ঘণ্টা সূর্যের উজ্জ্বল কিরণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সৌর হোম সিস্টেম বা এসএইচএস খাতের দিকে ঝুঁকেছে, যা ইতিবাচক লক্ষণ। ২০০৯ সাল থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টিএসএইচএস স্থাপন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল সৌর হোম সিস্টেম কার্যক্রম হিসেবে অভিহিত করেছে।

এই কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া গেলে বলা যায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি হবে আমাদের আগামীর শক্তি উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি ও আধার। বর্তমান সময়ে নবায়নযোগ্য শক্তির একটি বড় অংশের ব্যবহারকারী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের, যারা বিভিন্ন ধরনের নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের উন্নয়ন গতিধারা বেগবান করছে। এক্ষেত্রে সরকারের আরও জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন। কারণ, এ ধরনের বিদ্যুৎ বা শক্তি উৎপাদন আমাদের বিকল্প উৎস থেকে বিদ্যুৎ খাতকে আরও সমৃদ্ধ ও উন্নত করবে। দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

আশার কথা এই যে, সোলার হোম সিস্টেমের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সরকার সৌর সেচ, সৌর মিনি/মাইক্রো গ্রিড, সোলার পার্ক, সোলার রুফটপ, সোলার বোটিং ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম লক্ষ্য হলো গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করে ডিজেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো। এর ফলে বাংলাদেশের জ্বালানি শক্তি আমদানিনির্ভরতা, এই খাতে সরকারি ভর্তুকি ও কার্বন নিঃসরণ পরিমাণও কমে আসবে। সবচেয়ে বড় কথা, জীবাশ্ম জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ধরন ও এর ক্রমবর্ধমান খরচ বাংলাদেশের মানুষের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রয়োজনীয়তাকে তীব্র করেছে।
প্রচলিত হিসাবে বাংলাদেশে ১৪৬টি পাওয়ার প্লান্ট এবং অন্যান্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে মাত্র ৭৭৬ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন হচ্ছে। অর্থাৎ নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহার করে বাংলাদেশের উৎপাদন সক্ষমতা মাত্র ৩ শতাংশের মতো। নবায়নযোগ্য জ্বালানি এমন এক শক্তির উৎস যা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আবার ব্যবহার করা যায়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে এগিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। এ কারণে নবায়নযোগ্য শক্তি সব দেশের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি পরিবেশবান্ধব।

পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে কার্বন নিঃসরণমুক্ত উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে ভারতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সোলার পাওয়ার প্লান্ট রয়েছে। ইউরোপের জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল রয়েছে। বঙ্গোপসাগর উপকূলে এবং হিমালয় পর্বতের সর্বশেষ সীমানার সমতল ভূমি হিসেবে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের অন্যতম ক্ষেত্র হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিই হতে পারে বাংলাদেশের আগামীর উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। এখন পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান থেকে বেশ পিছিয়ে আছে।

বাংলাদেশ যেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মাত্র ৩ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, সেখানে ভারত উৎপাদন করে তার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ২৪ দশমিক ১৬ শতাংশ বা প্রায় ৯০ হাজার ৩৯৯ মেগাওয়াট। পাকিস্তান তার ৩৭ হাজার ৪০২ মেগাওয়াটের বিপরীতে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৫ শতাংশ বা ১ হাজার ৮৭০ মেগাওয়াট উৎপাদন করে। 
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার এবং এর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা কার্যকর হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি হ্রাস এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার, আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প খাতে জ্বালানি সাশ্রয়, সংরক্ষণ ও দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানির অপচয় রোধকল্পে ২০১২ সালে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) গঠিত হয়। ২০১৪ সালের ২২ মে স্রেডার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।

বাংলাদেশ সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলশক্তি, বায়োমাস, বায়োফুয়েল, জিওথার্মাল, নদীর স্রোত, সমুদ্রের ঢেউ প্রভৃতিকে শনাক্ত করেছে। ২০১৬ সালে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান (পিএসএমপি) নবায়নযোগ্য শক্তির শেয়ারের ক্ষেত্রে ২০২১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ১০ শতাংশে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও সে লক্ষ্য অর্জন হয়নি। 
উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে আমাদের এই অবস্থা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য হারে কমানোর জন্যই মূলত এই উদ্যোগ। এই উৎপাদনের অর্ধেক অর্থাৎ ২ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট আসবে সৌরশক্তি থেকে। পানি ও বায়ু ব্যবহার করে উৎপাদন হবে যথাক্রমে ১ হাজার ও ৫৯৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। তাতে সরকারের সদিচ্ছা ও পরিকল্পনা নির্ভর করে যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর। সেক্ষেত্রে সরকারকে আরও মনোযোগী ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের অনেক ভালো ভালো আইন ও পরিকল্পনা আছে, কিন্তু বাস্তবায়নের অভাবে অনেক সম্ভাবনা অধরাই থেকে যায়। কঠিন ও অনিশ্চয়তাপূর্ণ বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় আমাদের এ ধরনের নেতিবাচক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। 

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, 
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

×