ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

খেলাপি ঋণ ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ১০ অক্টোবর ২০২৩

খেলাপি ঋণ ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার

আশঙ্কাজনক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)

আশঙ্কাজনক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জিরো টলারেন্স নীতির কথা জানান। পদক্ষেপের অংশ হিসেবে খেলাপির ওপর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে ইতোমধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের কথা জানানো হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে সব খেলাপির জন্য নতুন ঋণ অনুমোদন বন্ধ ও বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও জানিয়েছে। পাশাপাশি খেলাপিদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধনকে (আরজেএসসি) নতুন করে তালিকাভুক্তির সুযোগ বন্ধ রাখার প্রস্তাব দিয়েছে

সম্প্রতি খেলাপি ঋণ নিয়ে যত আলোচনা চলছে, তাতে সমাধানের তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নানা ধরনের ছাড় দিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এপ্রিল-জুনে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে, জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। অথচ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এখন তা দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়াল। অর্থাৎ ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ। এই সময়টা ছিল ঋণ খেলাপিদের জন্য সুবর্ণ সময়। 
বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা প্রকৃত তথ্য নয়। কারণ, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপির হিসাবে নেই। কিছু কিছু ব্যাংক ঋণ পুনঃ তফসিল করতে পারেনি। আবার কিছু ব্যাংকের ঋণ পুনঃ তফসিল করার পর আবার খেলাপি হয়েছে। মূলত সরকার ২০১৫ সাল থেকে ঋণ খেলাপিদের জন্য বড় বড় ছাড় দিয়ে আসছে। ফলে, খেলাপিরা বারবার ঋণ পুনঃ তফসিল করে নিয়মিত দেখাচ্ছেন। এর মাধ্যমে তারা নতুন করে ঋণও নিচ্ছেন এবং নতুন করে খেলাপি হচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক গত আগস্টে আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপির চেয়ে পুনঃ তফসিল ঋণের পরিমাণ বেশি।

যেভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ 
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিগত ২০২০ ও ২০২১ সালে কোনো ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত ছিলেন গ্রাহকরা। ২০২২ সালে এসব নীতি ছাড় তুলে দেওয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার প্রবণতা দেখা দেয় চলতি বছরের শুরু থেকেই। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুনে ব্যাংক ঋণ পরিশোধে আবার ছাড় দেয়। ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আগামী জুন মাসের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিলেই একজন গ্রাহককে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের ফলে যেসব ঋণ গ্রাহক খেলাপি হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, তারা অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে থাকার সুযোগ পান। এই সুবিধা দেওয়া হয় শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে। ব্যাংক খাতের ১৫ লাখ কোটি টাকা ঋণের প্রায় অর্ধেকই মেয়াদি ঋণ। এত সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি কেবল বাড়ছেই। বারবার ছাড় দেওয়ার কারণে ভালো গ্রাহকরাও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তাদের মতে, এতে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ছে এবং নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে।

খেলাপি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন
বাংলাদেশ ব্যাংক গত আগস্টে আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপির চেয়ে পুনঃ তফসিল ঋণের পরিমাণ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশে পুনঃ তফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ দশমিক ১১ শতাংশ দেখালেও প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ অনেক বেশি। এর বাইরেও মামলার কারণে আটকা আছে আরও প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি, শতাংশ হারে যা প্রায় ৩০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পুনঃ তফসিল করা ঋণ ও আদালতের স্থগিতাদেশ দেওয়া ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখানোর পক্ষে। আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়ে রেখেছে। এ শর্তও আপাতত পূরণ হচ্ছে না বলেই দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক-আইএমএফ বৈঠক
আশঙ্কাজনক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জিরো টলারেন্স নীতির কথা জানান। পদক্ষেপের অংশ হিসেবে খেলাপির ওপর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে ইতোমধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের কথা জানানো হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে সব খেলাপির জন্য নতুন ঋণ অনুমোদন বন্ধ ও বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও জানিয়েছে। পাশাপাশি খেলাপিদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকে (আরজেএসসি) নতুন করে তালিকাভুক্তির সুযোগ বন্ধ রাখার প্রস্তাব দিয়েছে।

আইএমএফ অনেক বিষয়ে নির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। এই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ফেব্রুয়ারিতে পায় বাংলাদেশ। দেশে এখন ডলার সংকট চলছে। এই সময়ে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নভেম্বরে এই কিস্তি পাওয়ার কথা। তবে তা নির্ভর করছে ঋণের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া শর্ত পরিপালনের ওপর। তাই সরকারি বিভাগগুলো শর্ত পূরণে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, সে সব বিষয় নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করবে আইএমএফ। আর্থিক খাতের স্থায়িত্ব, ব্যাংক খাতের সংস্কার, তারল্য ব্যবস্থাপনা, ডলারের বাজারভিত্তিক লেনদেন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন, ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি, সুদের হার ও মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।

এরই অংশ হিসেবে প্রথমদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় বসে সংস্থাটির বিশেষ প্রতিনিধি দল। বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইএমএফের ঋণের যেসব শর্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পূরণ করার কথা, তার মধ্যে বেশিরভাগ পূরণ হয়েছে। তবে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখার শর্ত দেওয়া হয়েছিল, সেই পরিমাণ রিজার্ভ রাখতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফের শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল জুনে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার রাখা, সেপ্টেম্বরে তা ২ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার রাখতে হবে। এখন রিজার্ভের তিন ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেমন- মোট রিজার্ভ, বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ও প্রকৃত রিজার্ভ। দুই ধরনের হিসাব (মোট রিজার্ভ, বিপিএম ৬) বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করলেও প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে না। তবে প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য নিয়মিত আইএমএফকে জানাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য বলছে, জুনে দেশের মোট (গ্রস) রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার।

আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ (ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) অনুযায়ী জুনে রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলার। সর্বশেষ ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৭০৫ কোটি ডলার আর বিপিএম ৬ অনুযায়ী আছে ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলার। এর বাইরেও প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি তথ্য আছে, যা প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ২০ বিলিয়ন ২ হাজার কোটি ডলারের মতো, যা আইএমএফকে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রকৃত এ রিজার্ভ দিয়ে এখন ৩ মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করতে পারবে বাংলাদেশ।

কেন খেলাপি
সরকার উদার হস্তে ঋণ খেলাপিদের ছাড় দেওয়া শুরু করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর। নতুন করে ক্ষমতায় এসে ২০১৫ সালে সরকার প্রভাবশালী ঋণ খেলাপিদের জন্য ঋণ পুনঃ তফসিলের বিশেষ এক স্কিম হাতে নেয়। তখন তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃ তফসিল করা যেত না। কিন্তু বেশিরভাগ প্রভাবশালী উদ্যোক্তাই তিনবার সুযোগটি নিয়েও খেলাপি হয়ে পড়েছিলেন। ফলে, ঋণ পুনর্গঠন নামে নতুন এক সুবিধা দেওয়া হয়। ওই সুবিধার আওতায় দেশের বড় ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তার পরও এসব গ্রুপের বেশিরভাগই ঋণের কিস্তি আর পরিশোধ করেনি। আবার বড় ছাড় দেওয়া হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর। ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে ঋণ খেলাপিদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধাটি দেন।

সে সময় ২ শতাংশ কিস্তি দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ রাখা হয়। নতুন নিয়মে ঋণ পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম এক বছর কোনো কিস্তি দিতে হয়নি। সুযোগ নেওয়া বেশিরভাগই পরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। অথচ অর্থমন্ত্রী ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসেই এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। তখন দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। সেই খেলাপি বেড়ে এখন দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কেবল পরিমাণে নয়, শতাংশ হারেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ। আইএমএফের দেওয়া পদ্ধতি অনুযায়ী পুনঃ তফসিল ও মামলায় আটকে থাকা ঋণের হিসাব নিলে পরিমাণ ও শতাংশ হারে খেলাপি ঋণ বেড়েছে বহুগুণ।

খেলাপি ঋণ ও অর্থনৈতিক সংস্কার
খেলাপি ঋণ ঠেকাতে বড় ছাড় দিয়ে নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ঋণ আদায় না বাড়লেও সাময়িকভাবে কমবে খেলাপি ঋণ। আর বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এই নীতিমালা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত। গণহারে এমন সুবিধা কখনোই ভালো ফল দেয় না। খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। নতুন নীতিমালার ফলে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে যা ছিল ১০-৩০ শতাংশ। পাশাপাশি এসব ঋণ ৫-৮ বছরে পরিশোধ করা যাবে। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ ২ বছর সময় দেওয়া হতো। আবার নতুন করে ঋণও পাওয়া যাবে।

পাশাপাশি খেলাপি ঋণে কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পুরো ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাংক মালিকরাই ঠিক করবেন, কী সুবিধা পাবেন ঋণ খেলাপিরা। আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত, যা স্বয়ং গভর্নর অনুমোদন করতেন। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে সেই ক্ষমতার পুরোটাই ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দিয়েছেন। নতুন নীতিমালার ফলে ব্যাংকের ঋণ আদায় আরও কঠিন হয়ে পড়বে। ঋণ নিয়মিত করার আগে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই ও খেলাপি হওয়ার কারণ পরীক্ষা করতে হবে। কেউ অভ্যাসগত খেলাপি হলে তার ঋণ নিয়মিত করা যাবে না। এসব গ্রাহকের ঋণ আদায়ে ব্যাংককে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্যবসায়ীদের চাপে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই ব্যবসায়ীরা এতে লাভবান হবেন। তবে ব্যাংকের জন্য বড় চাপ তৈরি করবে। ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়বে। এতে নতুন ঋণ কমে যাবে, নতুন উদ্যোক্তারাও ঋণ পাবেন না। বিদেশী ব্যাংক ও ঋণদাতা সংস্থাগুলো এসব ছাড় ভালোভাবে নেয় না। এর ফলে দেশীয় ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক ব্যবসায় কোনো প্রভাব পড়ে কিনা, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃ তফসিল করতে বিভিন্ন তদবির আসত। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর সেই সুবিধা দেওয়ার ক্ষমতা ব্যাংকগুলোকে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, করোনার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব, বহির্বিশ্বে সম্প্রতি যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ার কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলছে। আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও  শ্রেণিকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা জারি করা হলো।
বর্তমানে অনেক দেশ সমস্যায় পড়ে গেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আগ বাড়িয়ে এমন সুবিধা দিয়েছে। যারা ভালো গ্রাহক হিসেবে পরিচিত, ছোট ও মাঝারি গ্রাহকÑ তাদের এসব সুবিধা দিলে ভালো হতো। গণহারে এমন সুবিধা কখনোই ভালো ফল দেয় না। খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। ঋণ নীতিমালায় এমন ছাড়কে আইএমএফ কী ভাবে নেবে, এটাও দেখার বিষয়। করোনাসৃষ্ট এ বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। এসব প্যাকেজের আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হয়েছে স্বল্প সুদে ঋণ। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকার করোনা মহামারির শুরু থেকেই সচেষ্ট।

দেশের বড়, মাঝারি ও ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য সঙ্গত কারণে দ্রুতই আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। দুঃখজনকভাবে শর্ত ভঙ্গ করে অনেক অর্থ চলে গেছে ভিন্ন খাতে। এটা স্পষ্টতই অপব্যবহার ও অনিয়ম। বিশেষ এক পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সচল রাখতে দেওয়া হয়েছিল প্রণোদনার অর্থ। এর অপব্যবহার কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য উজ্জীবিত রাখতে সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। দেশের উদ্যোক্তাদের পরিত্রাণে দিয়েছে সাশ্রয়ী হারে ঋণ। এটা তাদের জন্য বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা অবশ্যই। এতে তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছেন, যা অর্থনীতির জন্য সুখবর। তবে এর অপব্যবহার কাম্য নয়।

লেখক : অধ্যাপক, ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য,
সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

×