ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু হত্যা ও বহিঃসমর্পণ

ড. রেবা মণ্ডল

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১২ আগস্ট ২০২৩; আপডেট: ২১:২৪, ১২ আগস্ট ২০২৩

বঙ্গবন্ধু হত্যা ও বহিঃসমর্পণ

ড. রেবা মণ্ডল

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গের হত্যাকারীদের রাজনৈতিক অপরাধ বলে অপপ্রচারের বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও দুরভিসন্ধিমূলক। খুন (গঁৎফবৎ) কোনো রাজনৈতিক অপরাধ নয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইনে ‘খুনি’ কোনো দেশের আশ্রয়ে থাকলেও তার বহিঃসমর্পণ আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা-স্থপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে জঘন্য-নৃশংসভাবে হত্যা করে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। ঘটনাচক্রে সেদিন আমাদের প্রিয় মানবতাবাদী জননেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী জার্মানিতে অবস্থানের কারণে প্রাণে বেঁচে যান।

হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলে মৌলবাদী রুগ্ন সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমূলে নির্মূল করা এবং ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার দুর্বার বাসনা এবং বিদেশী শক্তিধর রাষ্ট্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছাকে, শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলসহ পরিবারবর্গকে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক, যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের জন্য মার্কিন মুল্লুুকে যোগসাজশ করেছিলেন, তিনিই ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ৪২ দিনের দিন হত্যাকারীদের বিচার না করার জন্য, শাস্তিবহির্ভূত রাখার জন্য, নিজেকে বাঁচানোর জন্য পৃথিবীর অন্যতম কুখ্যাত কালো আইন-‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি করেন।

বঙ্গন্ধুর হত্যাকা-ের পর সেনাপ্রধান হয়েছিলেন  জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং মুখ্যসচিবের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন মাহবুবুল আলম চাষী। উক্ত ২ জনও মুক্তিযুদ্ধ চলমান থাকা অবস্থায় কনফেডারেশন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল জাতীয় সংসদে জিয়াউর রহমান সংবিধানের ৫ম সংশোধনী পাসের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত জারিকৃত সব সামরিক আইন ও বিধি বিধান এবং কার্যক্রমকে বৈধতা (Validity) দেন। খুনিদের দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে পুনর্বাাসিত করেন। পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের কালজয়ী ইতিহাস বিকৃতির উদ্যোগ গ্রহণ ও কার্যকরী ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেন। 
জামায়াত-বিএনপি সরকার আইন পাস করে জাতির জনকের হত্যার পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত-১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা এবং তদনুযায়ী জারিকৃত প্রজ্ঞাপন ও সরকারি ছুটি ২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাসীন হয়ে ১৫ আগস্ট ছুটি বাতিল করে, জাতির জনকের আইনি স্বীকৃতি সংসদে রদ করে এবং প্রতিকৃতি টেনে হেঁচড়ে ছিড়ে ফেলে ও নামিয়ে নেয়। এহেন অপরাধ কর্ম সংঘটনে আদেশ-উপদেশদানকারী জাতির শত্রু এবং বিচারের আওতাভুক্ত ও শাস্তিযোগ্য বলে বাংলাদেশের গণমানুষের দাবি। পরাজিত শত্রুরা কখনো থেমে থাকেনি, এখনও থেমে নেই।

জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এই ঘৃণ্য আইন লংঘনকারী মানবতাহীন নরপিশাচদের অনুসারীরা ২১ বার হত্যাচেষ্টা করেছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় ঘটনাটি তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মর্মান্তিকভাবে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরী কানাডায় আশ্রয় নিয়ে দিব্যি সুখের জীবনযাপন করছে। যুক্তরাষ্ট্রে আছে রাশেদ চৌধুরী। এক্ষেত্রে বহিঃসমর্পণ (ঊীঃৎধফরঃরড়হ) ও রাজনৈতিক আশ্রয় (চড়ষরঃরপধষ ধংুষঁস) বিষয় দুটো প্রাসঙ্গিক।
আন্তর্জাতিক আইনবিদ G.J. Starke-এর মতে, দুটি কারণে পলাতক অপরাধীকে বহিঃসমর্পণের ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক আইনে গৃহীত হয়েছে- (১) সভ্য জগতের রাষ্ট্রসমূহের প্রত্যাশা হচ্ছে, যে কোনো অপরাধীকে শাস্তিবিহীন যেতে দেওয়া উচিত নয়। অপরাধী অবশ্যই আশ্রয়গ্রহণকারী রাষ্ট্র কর্তৃক শাস্তিপ্রাপ্ত হবে অথবা অপরাধীকে অবশ্যই ঐ রাষ্ট্রের কাছে সমর্পণ করতে হবে, যে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দিতে পারবে (২) যে রাষ্ট্রে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে সে রাষ্ট্রই হবে অপরাধীর বিচারের প্রকৃত স্থান।
উল্লেখ্য, এক রাষ্ট্রের পলাতক অপরাধীকে অপর রাষ্ট্র কর্তৃক তার নিজ রাষ্ট্রের আইনগত কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর বা সমর্পণ করাকে সাধারণভাবে বহিঃসমর্পণ বলে। সংশ্লিষ্ট দুটি রাষ্ট্রের মধ্যকার চুক্তির (Bilateral Treaty) শর্ত মোতাবেক সমর্পণ বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে অপরাধীর আশ্রয়দানকারী রাষ্ট্র চুক্তির অবর্তমানে অপরাধীকে সমর্পণ করতে পারে স্বাধীন ইচ্ছায়। বহিঃসমর্পণ ব্যবস্থা গুরুতর অপরাধ দমনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতারই বহিঃপ্রকাশ বলে আন্তর্জাতিক আইনবিদগণ অভিমত দেন। স্বাধীনতা বিরোধীচক্র এখনও প্রকাশ্যে বলে থাকেন যে, নূর চৌধুরী রাজনৈতিক আশ্রয়ে (Political asylum) রয়েছে এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ের অপরাধীর বহিঃসমর্পণ আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত নয়।

সামরিক অপরাধ, রাজনৈতিক অপরাধ এবং ধর্মীয় অপরাধসমূহ সাধারণত বহিঃসমর্র্র্পণযোগ্য অপরাধ (Extraditable offence)  হিসেবে গণ্য নয়। বর্তমান আন্তর্জাতিক আইনে সন্ত্রাসবাদ, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, নারী ও শিশু পাচার, অবৈধ মাদকদ্রব্য ব্যবসা, হাইজ্যাক ইত্যাদি গুরুতর মারাত্মক বহিঃসমর্পণযোগ্য অপরাধ। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গের হত্যাকারীদের রাজনৈতিক অপরাধ বলে অপপ্রচারের বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও দুরভিসন্ধিমূলক। খুন (গঁৎফবৎ) কোনো রাজনৈতিক অপরাধ নয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইনে ‘খুনি’ কোনো দেশের আশ্রয়ে থাকলেও তার বহিঃসমর্পণ আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। 
রাজনৈতিক অপরাধ (চড়ষরঃরপধষ ঈৎরসব) নির্ণয় করতে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হয়Ñ (১) মোটিভ (২) পরিস্থিতি (Circumstances) (৩) অপরাধটি দেশদ্রোহিতার মতো অপরাধ কিনা (৪) অপরাধটি যে রাষ্ট্র বহিঃসমর্পণ দাবি করছে, সে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংগঠনের বিরুদ্ধে পরিচালিত কি না  (৫) অপরাধী কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠানের সদস্য কিনা (৬) অপরাধটি সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মধ্যে পড়লে রাজনৈতিক অপরাধ নয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলো- সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রে (যে রাষ্ট্রে অপরাধ করেছে) একাধিক রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয়যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের জন্য বৈধ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত আছে কিনা বা সংঘটিত অপরাধটি সে দ্বন্দ্বের প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়েছে কিনা। পরিষ্কার বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক আইনে রাজনৈতিক নেতাকে খুন করা হোক বা সাধারণ ব্যক্তিকে খুন করা হোক ‘খুন’ রাজনৈতিক অপরাধ নয় এবং তা বহিঃসমর্পণযোগ্য অপরাধ। 
যে মহান নেতা তাঁর মহানুভবতা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন, নিপীড়ন, দুর্দশা থেকে সাড়ে সাতকোটি নিজ বাঙালিকে বাঁচানোর জন্য, তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের জন্য দুর্বার সংগ্রাম করে স্বাধীনতার সূর্য এনে দিলেন- মুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে দিলেন, তাঁকে এবং তাঁর পরিবারবর্গকে যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে যোগসাজশে ষড়যন্ত্র করে পরিকল্পনামাফিক হত্যা করেছে তারা মানুষ নয়, তারা সভ্যতার দাবিদার নয়, তারা কুলাঙ্গার নরহায়েনা, নরপশু- যাদের কোনো অনুসারীও মনুষ্যত্বের দাবি করতে পারে না। তারা ঘৃণ্য, তারা শাস্তিযোগ্য। অন্যায়কারীকে যে বা যারা সমর্থন দেয় তারাও সমান অপরাধী। 


লেখক : অধ্যাপক, সাবেক ডিন, আইন অনুষদ ও
বর্তমান চেয়ারম্যান, আইন বিভাগ, ইবি, কুষ্টিয়া

×