ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে স্টিম শিক্ষা

ড. মোঃ সাজ্জাদ হোসেন

প্রকাশিত: ২১:১১, ২৪ জুন ২০২৩

শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে স্টিম শিক্ষা

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে আমাদের জীবনযাপন, কাজ এবং অধ্যয়নের পদ্ধতি দ্রুত গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে আমাদের জীবনযাপন, কাজ এবং অধ্যয়নের পদ্ধতি দ্রুত গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নতুন যুগের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য স্টিম (এসটিইএএম-সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্টস, ম্যাথমেটিক্স) শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন বাংলাদেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় স্টিম শিক্ষা পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তার কয়েকটি সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে। ‘ভিশন ২০৪১’ এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ লক্ষ্য অর্জনে স্টিম শিক্ষার মতো একটি আধুনিক এবং ফলপ্রসূ শিখন পদ্ধতি অবিলম্বে প্রণয়ন প্রয়োজন।

স্টিম শিক্ষা কি

২০০০ সালের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের (এনএসএফ) বিজ্ঞানীদের প্রশাসকদের দ্বারা স্টিম (সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাথমেটিক্স) ধারণা তৈরি হয়েছিল, যেটি কেস্টিম এর শুরু হয়েছিল। স্টিম বলতে একটি পদ্ধতিগত পাঠ্য ব্যবস্থা এবং পাঠ্যক্রমকে বোঝায় যা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত শেখানোর ওপর জোর দেয়। সামাজিক সমস্যা দূরীকরণ এবং কর্মসংস্থানের উপযোগী দক্ষ জনশক্তির জন্য, স্টিমভিত্তিক পাঠ্যক্রম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অনেক দেশে প্রসারিত করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, চীন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্য এবং ভারতের মতো দেশগুলোতে এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। স্টেমের গবেষকরা দাবি করেন, এর সঙ্গে মানবিক বিষয়ের সংযুক্তি মানুষকে আরও ভালো সিদ্ধান্ত নিতে, অধিকতর সৃজনশীলতা এবং বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করতে সহায়তা করে।

তারা দাবি করেন, যা একজন মানুষকে সফল করে তোলে, তা গভীর জ্ঞান নয়, বরং বাস্তব বিশ্বের প্রেক্ষাপটে শিল্পকলার প্রয়োগ। ফলস্বরূপ স্টেমের মতো যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। স্টিম শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলিকে উপেক্ষা না করে বৈজ্ঞানিক বিষয়ের ওপর জোর দেয়। অন্য কথায়, স্টিম শিক্ষা হলো প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়ন এবং সমস্যা সমাধানে চিন্তা করার একটি বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়, যা সৃজনশীলতার সঙ্গে একত্রিত হয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের মানবিক ও উদ্ভাবনী হতে সহায়তা করে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং স্টিম শিক্ষা

যান্ত্রিকীকরণ থেকে অটোমেশন, রোবটিক্স থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্ষুদ্রকরণ থেকে ন্যানো প্রযুক্তি, সফ্টওয়্যার থেকে এমবেডেড সিস্টেম এবং ইন্টারনেট থেকে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) সবই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অনুষঙ্গ। অটোমেশন এবং এআই বর্তমান অনেক পেশা প্রতিস্থাপন করতে যাচ্ছে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং বেকারত্ব সংকট সব দেশের জন্য, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি বিরাট সমস্যা হবে, যদি না আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, কলা এবং গণিতকে একত্রিত করে শিক্ষাদানের একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি স্টিম শিক্ষা নামে পরিচিত। এগুলো হলো অধ্যয়নের মৌলিক ক্ষেত্র, যা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনাকে ধারণ করে নতুন তৈরি করে নতুন উদ্ভাবনের ভিত্তি।

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বিগ ডেটা, রোবট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সবই স্টিম ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। স্টিম শিক্ষা কী ভাবে শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হতে সহায়তা করতে পারে, তার উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা প্রাকৃতিক জগত এবং এটি কী ভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, এই জ্ঞানকে ব্যবহার করে নতুন প্রযুক্তির বিকাশ এবং সমস্যা সমাধান করতে পারে। প্রযুক্তি বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিগত সিস্টেমের নকশা, বিকাশ এবং ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং এই জ্ঞান ব্যবহার করে নতুন আইটি পণ্য এবং পরিষেবাগুলো বিকাশ ঘটাতে পারে। ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা মেশিনের কাঠামো ও নকশা নির্মাণ এবং পরিচালনা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং সমস্যা সমাধানের জন্য এই জ্ঞান ব্যবহার করতে পারে।

বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং ব্যবসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের জন্য গণিতের শিক্ষার্থীরা শেখে যুক্তি এবং যুক্তির ভাষা। এ ছাড়াও স্টিম শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক একাডেমিক কৃতিত্বের পাশাপাশি তাদের আত্মবিশ্বাস, প্রেরণা এবং মানসিক সুস্থতা বাড়াতে পারে। ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিস্টিক্সের ভাষ্যমতে, আগামী এক দশকের মধ্যে ঝঞঊঅগ কর্মসংস্থান ১৭% বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা, অন্য সব পেশার গড়ের তুলনায় যথেষ্ট বেশি। 

জাতীয় স্টিম অলিম্পিয়াড

ন্যাশনাল স্টিম অলিম্পিয়াড শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় আয়োজিত হবে। প্রতিযোগিতার ধারণা, পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে আই টেসারেক্ট টেকনোলজিস। আটটি বিভাগে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা যাবে। সেগুলো হলো হলোÑ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটস, ব্লকচেন এবং ক্লাউড কম্পিউটিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স এবং বিগ ডেটা, আইসিটি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা, বিজ্ঞান, গণিত এবং প্রযুক্তি। প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মোট ছয়টি স্তরে শিক্ষার্থীরা এতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। প্রকল্প প্রতিযোগিতা এবং কুইজ প্রতিযোগিতা পুরস্কারের অর্থ বিভিন্ন পরিমাণের।

ন্যাশনাল স্টিম অলিম্পিয়াডের লক্ষ্য  হলো, চতুর্থ শিল্পবিপ্লববের (৪ওজ) চ্যালেঞ্জ এবং পরিবর্তনগুলো মোকাবিলা করার জন্য সব স্তরের শিক্ষার্থীকে প্রয়োজনীয় দক্ষতার সঙ্গে প্রস্তুত করা। এই অলিম্পিয়াডের অন্য উদ্দেশ্য হলো, ব্যবহারিক শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বৃদ্ধি এবং তাদের মধ্যে মানবতা ও দায়িত্ববোধের মতো গুণাবলিকে উৎসাহিত করা। উপরন্তু, এটি স্টিম-সম্পর্কিত বিষয়ের সমস্যা সমাধান, উদ্ভাবন এবং গবেষণার মাধ্যমে ‘ভিশন ২০৪১’ ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে সবাইকে অনুপ্রাণিত করবে।

স্টিম শিক্ষা ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা

বর্তমান সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে। এই রূপকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে একটি সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও উন্নত দেশ হবে। এ জন্য আমাদের প্রয়োজন কর্মসংস্থানের সর্বজনীন প্রবেশাধিকার, দারিদ্র্য দূরীকরণ, ব্যক্তির গড় জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং একটি শক্তিশালী অর্থনীতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ডিজিটাল হয়েছে।

উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ, গ্রামীণ এলাকায় কমিউনিটি ইনফরমেশন সেন্টার (সিআইসি), হাইটেক পার্ক, সাশ্রয়ী প্রযুক্তির প্রাপ্যতা, যুবকদের জন্য আইসিটি প্রশিক্ষণ, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব-এর মতো উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ একটি অসাধারণ প্রযুক্তিগত সাফল্য দেখছে এবং এর সুফল ভোগ করছে। স্কুলগুলোতে আইটি সুবিধা বৃদ্ধি এবং বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এটি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করার পাশাপাশি তাদের একবিংশ শতাব্দীর প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়ক হবে। প্রকল্পভিত্তিক কাজ এবং শেখার গ্যামিফিকেশনের মাধ্যমে, পাঠ্যক্রমটি শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী প্রয়াস এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করবে। পাঠ্যক্রমটিতে স্কুল পড়ুয়াদের জন্য একটি আন্তঃবিষয়ক পদ্ধতিও রয়েছে। এতে বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিষয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য  কলা ও মানবিক বিষয়ে কোর্স গ্রহণ এবং অন্যদের জন্য বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। লক্ষণীয় যে, স্টিম শিক্ষার ধারণা এবং বাংলাদেশের নতুন পাঠ্যক্রমের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ইনোভেটিভ এডুকেশন ইকোসিস্টেম (আইইই) অর্থাৎ উদ্ভাবনী শিক্ষার সমন্বয় ঘটিয়ে আমরা সামনে আরও অগ্রসর হতে পারব।
স্টিম শিক্ষার লক্ষ্য হলো, প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সময়োপযোগী নতুন ধরনের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য দক্ষ, উদ্যোক্তা এবং সৃজনশীল হতে সাহায্য করা। এটা স্পষ্ট যে, সারাদেশের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকদের শুধু সরকারি বা ব্যক্তি উদ্যোগে কর্মস্থানের সঙ্কুলান সম্ভব নয়। এই কারণে স্নাতকদের দেশের সীমানার বাইরে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা থাকতে হবে। বাংলাদেশ আইটি শিল্পে আউটসোর্সিং এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের বাজার দখল করার চেষ্টা করছে বিশ্বে। কারণ, শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের ব্যবসা ও অন্যান্য কাজ করার জন্য কম ব্যয়বহুল আউটসোর্সারদের সন্ধান করে। 
আসলে স্টিম শিক্ষা ভিশন ২০৪১-এর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। স্টিম শিক্ষা আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের একটি দক্ষ কর্মী বাহিনী হিসেবে তৈরি হতে হবে সহায়ক। এটি উদ্ভাবনকে উৎসাহিত, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বৃদ্ধি, সৃজনশীলতাকে প্রসারিত এবং মানবিক বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়। একবিংশ শতকের সুযোগ কাজে লাগানো ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করার পাশাপাশি স্টিম শিক্ষা অদম্য বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা পালন করবে অবশ্যই। সুতরাং, জাতীয় স্টিম অলিম্পিয়াড বাংলাদেশে স্টিম শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে নিঃসন্দেহে একটি উপযুক্ত পদক্ষেপ।

লেখক : অধ্যাপক, সদস্য, বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)
পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)

×