.
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ আয়োজিত ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলার দ্বিতীয় দিনে পঞ্চম শিল্পবিপ্লব ও ফাইভি-জি অবকাঠামো : বাংলাদেশের প্রস্তুতি শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে আমি পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের পটভূমি তুলে ধরি। এমটবের মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম ফরহাদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব-উল আলম, বিটিআরসির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনিরুজ্জামান জুয়েল, হুয়াওয়ের চিফ ট্যাকনিক্যাল অফিসার নিকি মা জিয়ান, রবির প্রতিনিধি শাহেদ আলম এবং ফাইভার অ্যাট হোমের চেয়ারম্যান মইনুল হক সিদ্দিকী বক্তৃতা করেন। বিশ্ব যখন চতুর্থ/পঞ্চম শিল্পবিপ্লব নিয়ে মাতোয়ারা, তখন এমন একটি সেমিনারে বিপুল আগ্রহ ছিল মানুষের।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় আমি বলেছি, পঞ্চম শিল্পবিপ্লব বিশ্বে ব্যাপকভাবে আলোচিত বিষয়। আমরা পঞ্চম শিল্পবিপ্লব নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সেমিনার করেছি। সেমিনারে আমি বলেছি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব একটি যান্ত্রিক সভ্যতা গড়ে তুলবে। ইউরোপ আমেরিকা এটি চায় এজন্য যে, তাদের মানবসম্পদ কমছে। ফলে, তারা যন্ত্র দিয়ে মানুষকে স্থলাভিষিক্ত করতে চায়। কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত মানবসম্পদ আছে। এছাড়া আমি মনে করি যন্ত্র কখনো মানব সভ্যতার নিয়ন্ত্রক হতে পারে না। এ জন্যই মানুষ ও যন্ত্রের মিশেলে দরকার মানবিক শিল্পবিপ্লবের। স্মরণ করা যায় যে, ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধারণা গ্রহণ করে। তবে ২০১৯ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামে উত্থাপিত জাপানের সোসাইটি ফাইভ পয়েন্ট জিরো বা পঞ্চম শিল্পবিপ্লব ধারণাটি বিশ্ববাসী গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবী আজ পঞ্চম শিল্পবিপ্লবে প্রবেশ করেছে। আমি বলেছি, আমাদের একটি মানবিক সভ্যতা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। যান্ত্রিক কোনো শিল্পবিপ্লব হতে পারে না, তা হতে হবে মানবিক। আমরা মানবিক শিল্পবিপ্লব চাই।
তার মানে হচ্ছে, অতীতকে ভেঙে দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করব কিন্তু মানুষকে স্থলাভিষিক্ত করে নয়। আমাদের প্রযুক্তির শেষ উদ্ভাবনে যেতে হবে এবং প্রযুক্তির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি বলেছি, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমরা কাজ করছি। ডিজিটাল বাংলাদেশের শক্তিশালী ভিত্তির ওপর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট নাগরিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের নেতৃত্বের জায়গার ক্ষেত্রে যন্ত্রের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম অত্যন্ত মেধাবী । তাদের পঞ্চম প্রযুক্তির যন্ত্র বানানোর দক্ষতা অর্জনে কাজ করতে হবে। তারা যন্ত্র বানাবে এবং যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যোগ্যতা অর্জন করবে।
মানুষের সভ্যতা মানুষের হাতেই রাখতে হবে বলে আমি উল্লেখ করেছি। ফাইভ-জি অথবা পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের জন্য যে প্রযুক্তি চাইব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তা পড়াতে হবে। নতুন প্রজন্মকে দক্ষতা দিতে না পারলে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সফল হব না। আমার দক্ষতা এখনই এমন যে হুয়াওয়ের রোবট প্রযুক্তিতে বাংলাদেশি তরুণ প্রোগ্রামিং করছে। পাইপের ভিতর পড়ে যাওয়া শিশুটিকে রোবট দিয়ে উদ্ধারের প্রযুক্তি বগুড়ার এক তরুণ আবিস্কার করেছে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির জন্য বোর্ডের বইয়ের ডিজিটাল কনটেন্ট বিজয় ডিজিটালের হাত ধরেই তৈরি হয়েছে। পঞ্চম শিল্পবিপ্লবে মেধাই হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমি এটাও বলি যে, ৫-জি পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের ডিজিটাল সংযুক্তির মহাসড়ক হবে।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক মাহফুজুল ইসলাম বলেন, আমরা পঞ্চম শিল্পবিপ্লব যুগের দিকে যাচ্ছি। পঞ্চম শিল্পবিপ্লব হবে মানবিক। এখানে মানুষ ও যন্ত্র মিলেমিশে এক সঙ্গে কাজ করবে এবং মানুষই যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তিনি এটিও বলেন যে, পঞ্চম শিল্পবিপ্লব গড়ে উঠবে মানুষের দক্ষতার ওপরে।
তিনদিনের বর্ণাঢ্য এ মেলায় দর্শকদের নতুন প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। নতুন প্রজন্মের রোবট, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, আইপিভি সিক্সসহ উচ্চগতির ইন্টারনেট, ফাইভ-জি প্রযুক্তির সর্বশেষ সংযোজন পরখ করে দেখেছেন মেলায় আগত প্রযুক্তিপ্রেমীরা। মেলায় ঢোকার মুখেই ছিল বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ের প্যাভিলিয়ন। হুয়াওয়ের প্যাভিলিয়নে ৫-জি, এন্টারপ্রাইজ বিজনেস সল্যুশন, হুয়াওয়ে ক্লাউড ও ডিজিটাল পাওয়ারের মতো বিভিন্ন যুগান্তকারী উদ্ভাবন প্রদর্শন করা হয়। ছিল সার্ভিস রোবট, স্মার্ট পোর্ট ও ডিজিটাল পাওয়ার সল্যুশন, ডিজিটাল শিক্ষা ও ডিজিটাল স্বাস্থ্য ডেমো সাইট। মেলায় আরও এক চীনা প্রযুক্তি জায়ান্ট জেডটিই প্রদর্শিত রোবট দর্শকদের আকৃষ্ট করে, বিশেষ করে খুদে দর্শক রিমোটচালিত রোবটটির কর্মকা- দেখে অভিভূত হয় সবাই। হুয়াওয়ের মতো জেডটিইও দেখিয়েছে ফাইভ-জি প্রযুক্তির চমক। মেলায় টেলিকম অপারেটর গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি ও টেলিটক তাদের বিভিন্ন পণ্য ও সেবা প্রদর্শন করে। মেলায় বিটিআরসির স্টলে বিভিন্ন অপারেটরের গোল্ডেন নম্বর লটারির মাধ্যমে বিক্রি করা হয়।
মেলায় শীর্ষ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতারাও ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্যাকেজে ছাড় ও অফার ঘোষণার মাধ্যমে অংশ নেয়। ওয়ালটন, টেশিস ও ভিসতার মতো দেশীয় হার্ডওয়্যার পণ্য নির্মাতারাও ছিল এবারের মেলায়। টেলিকম অপারেটর গ্রামীণফোনের প্যাভিলিয়নেও ছিল রোবটিক হাতের প্রদর্শনী। কৃত্রিম বুদ্ধিনির্ভর এ হাত তার সামনে থাকা ব্যক্তির হাতের নড়াচড়াকে নকল করতে পারে। মেলায় মুজিব কর্নারে হলোগ্রাফির পাশাপাশি ভিআর হেডসেটে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ভেতর-বাহির দেখার আনন্দ নিয়েছেন দর্শনার্থীরা। ভিআর হেডসেটে গেম খেলে এবং অজানাকে জানার মাধ্যমে আপ্লুত শিশুরা। অংশগ্রহণকারী অর্ধশতাধিক উদ্ভাবনের মধ্য থেকে তিনটি উদ্ভাবনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। উদ্ভাবনের মধ্যে প্রথম হয়েছে সেলফ ব্যালান্সিং রোবট। দ্বিতীয় হয়েছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জের নকশা এবং তৃতীয় হয়েছে অ্যাডভাইজার বাংলাদেশ। এবারের মেলায় দেশের তরুণ উদ্ভাবকদের আমরা প্রাধান্য দিয়েছি। এখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবকরা তাদের প্রজেক্ট প্রদর্শন করেছেন। মেলায় আগতদের ভোটে সেরা তিন উদ্ভাবনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তি ও সেবা উপভোগের সুযোগ ছিল এবারের মেলায়। মেলা আয়োজনে সরকারের কোনো অর্থ খরচ হয়নি। পুরো টাকাই আমরা স্পন্সর থেকে সংগ্রহ করেছি।
১৯৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে দেশে কম্পিউটার বিকাশের অভিযাত্রা শুরু হয়। কম্পিউটার সাধারণের নাগালে পৌঁছে দিতে এবং দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তি বিকাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের ফলে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির অভিযাত্রা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির ফলে বাংলাদেশ বিশ্বে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গত ১৪ বছরে উন্নয়ন অগ্রগতির প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ’৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব।
আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ২৮ জানুয়ারি শনিবার মেলা প্রাঙ্গণে সকাল ১০টায় শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলা’ ২০২৩ উপলক্ষে অনলাইন রচনা প্রতিযোগিতা এবং শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য উন্মুক্ত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।
‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের (১ম থেকে ৫ম শ্রেণি) এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।
ঢাকা, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট ও কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী
[email protected]
www.bijoyekushe.net