ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের তথ্য

৪১৬ গার্মেন্টসে বেতন বোনাস নিয়ে অস্থিরতার আশঙ্কা

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ০০:১৯, ২৮ মার্চ ২০২৪

৪১৬ গার্মেন্টসে বেতন বোনাস নিয়ে অস্থিরতার আশঙ্কা

৪১৬ গার্মেন্টসে বেতন বোনাস নিয়ে অস্থিরতা

ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে দেশের চার শতাধিক কারখানায় অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরমধ্যে ২৭১টি পোশাকখাত সংশ্লিষ্ট কারখানায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ঈদের আগে এসব কারখানার কর্মরত শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে পারবে না মালিকপক্ষ। ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকা বেশির ভাগ পোশাক কারখানা আশুলিয়া অঞ্চলের। তারপরেই রয়েছে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানা।

এদিকে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী পবিত্র ঈদুল ফিতরের সরকারি ছুটি শুরু হওয়ার আগেই তৈরি পোশাকসহ সব খাতের শ্রমিকদের বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধ করতে মালিকপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছেন। অন্যদিকে পোশাকখাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো ঋণ না দিলে বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যা তৈরি হবে। তাই  ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। 
জানা গেছে, নানামুখী অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ঈদের আগে বেতন-ভাতা পরিশোধে এবার সবচেয়ে বেশি সংকট তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে কারখানা মালিকদের সতর্ক করেছে। এর বাইরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ৪১৬টি কারখানা তাদের শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস ঈদের আগে ঠিক সময়ে পরিশোধ করতে সমস্যায় পড়তে পারে। এ প্রসঙ্গে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (অপরাধ ও অপারেশন) সানা সামিনুর রহমান সম্প্রতি জানান, বেতন ও বোনাস দিতে দেরি হলে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই আমরা কারখানা মালিকদের সতর্ক করে দিয়েছি যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে শ্রমিকদের সময়মতো বেতন দিতে হবে।

জানা গেছে, এই ৪১৬টি কারখানার মধ্যে ১৭১টি বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সদস্য, ৭১টি বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্য এবং ২৯টি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সদস্য। বাকি ১৪৫টি পোশাকখাতের বাইরে অন্যান্য শিল্পকারখানা।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ইতোমধ্যে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএর প্রতিনিধিদের বিষয়টি অবগত করেছে। এ প্রসঙ্গে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের প্রধান মাহাবুবর রহমান বলেন, গোয়েন্দা তথ্য পর্যালোচনা করে আমরা কারখানাগুলো চিহ্নিত করেছি। তিনি বলেন, আগে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কোনো পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের ছাঁটাই না করার জন্য মালিকদের অনুরোধ করা হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে কারখানায় যাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি না হয় সেজন্য আমরা বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছি।

কোনো কারখানায় সমস্যা হলে কার কী করা উচিত, তা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। এদিকে গার্মেন্টস মালিকেরা বলছেন, প্রতি বছর ঈদের আগে বেশকিছু কারখানায় বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়, এবারও হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, যেহেতু ঈদের আগে বাড়তি বেতন ও ভাতা দিতে হয় তাই সমস্যা হতে পারে। তবে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে।

তিনি বলেন, চামড়া শিল্পে কুরবানির আগে ঋণ দেওয়া হয়, কিন্তু গার্মেন্টস খাতে এ ধরনের কোন ব্যবস্থা নেই। অথচ লাখ লাখ শ্রমিককে ঈদের আগে বাড়তি বেতন ও ভাতা দিতে হবে। এ কারণে ব্যাংকগুলোর সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তিনি জানান, বেতন-ভাতা পরিশোধে মালিক পক্ষ আন্তরিক। সরকারি সহযোগিতা পেলে আশা করছি সমস্যা তৈরি হবে না। এদিকে সরকারের প্রণোদনার টাকা না পেলে বেতনভাতা নিয়ে আরও বেশি সংখ্যক কারখানায় সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন গার্মেন্টস খাতের উদ্যোক্তারা।

কারখানার মালিকদের এপ্রিলের শুরুতে ঈদ বোনাস এবং ঈদের ছুটির আগে মার্চ মাসের বেতন পরিশোধ এবং শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমে ঈদের ছুটি দিতে হবে। মালিকদের মতে, এবার তিনটি কারণে সংকট হতে পারে। এর মধ্যে আছে, প্রথমত, গত দেড় বছরে অর্ডার অনেক কমে গেছে। 
এখন কারখানাগুলো সক্ষমতার ৫০-৬০ ভাগ উৎপাদনে রয়েছে। ফলে মালিকদের ভর্তুকি দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাতে হচ্ছে। দ্বিতীয়, ব্যাংকগুলো গার্মেন্ট মালিকদের সহযোগিতা করছে না। আর তৃতীয়ত, কাস্টমসের অহেতুক ঝামেলার কারণে শিপমেন্টের সময় ফেল করছেন তারা। ৭-১০ দিন মাল ফেলে রাখছে। এর ফলে ঠিকমতো টাকাও আসছে না।

এ প্রসঙ্গে পোশাকখাতের মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর নবনির্বাচিত সভাপতি এসএম মান্নান কচি জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদের আগে বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়ে যাতে কোনো ধরনের সংকট তৈরি না হয় সেলক্ষ্যে আমরা পুরো বিষয়টির ওপর দৃষ্টি রাখছি। প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হচ্ছে। মালিকদের এ বিষয়ে সতর্ক করা হচ্ছে।

তিনি জানান, মালিক এবং শ্রমিক সবাই যাতে শান্তিপূর্ণভাবে ঈদ উদ্যাপন করতে পারে সেটিই চায় বিজিএমইএ। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সময়টা খারাপ। একদিকে অর্ডার কমছে, অন্যদিকে কমছে পোশাকের দাম। এ অবস্থায় চাপের মুখে রয়েছে গার্মেন্টসখাত। এরপরও যাতে বেতনভাতা নিয়ে সমস্যা তৈরি না হয় সে বিষয়ে আমরা নজর রাখছি।  
জানা গেছে, তৈরি পোশাক শিল্পে বিজিএমইএর কারখানা রয়েছে ১ হাজার ৫৮৯টি, বিকেএমইএর ৬২৮টি, বিটিএমএর ৩৫৬টি, বেপজার ৩৮৩টি ও অন্যান্য কারখানা রয়েছে ৬৫১টি। এসব কারখানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে শিল্প পুলিশ। তাদের তথ্যানুযায়ী, ঈদের আগে বেতন না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ১৩১টি কারখানায়।

বোনাস না হতে পারে ১০৮টি, বেতন-বোনাস দুটিই না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ১৭৭টিতে। সব মিলিয়ে সংকট হতে পারে এমন কারখার সংখ্যা ৪১৬টি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএর নেতৃবৃন্দ এবং বেপজা, কলকারখানা অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিল শিল্প পুলিশ। সেখানেও আলোচনায় এই সংকটগুলো উঠে এসেছে। 
জানা গেছে, বেশকিছু কারখানায় শ্রমিকরা ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন পাননি। মার্চের বেতন এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে হওয়ার কথা। মার্চ মাসের বেতন যেন ঈদের ছুটির আগেই পরিশোধ করা হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। এ ছাড়া মালিক ও শ্রমিকদের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ঈদের ছুটি নির্ধারণ করা হবে। ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতাকে কেন্দ্র করে কোনো অপশক্তি যেন আইনশৃঙ্খলা অবনতি ঘটাতে না পারে, সে বিষয়েও গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে।

শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর উপকণ্ঠে তিন পাশে শিল্পাঞ্চল রয়েছে। এই পথ ধরেই ঈদে ঘরমুখী মানুষ গ্রামে যাবেন। ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধ না করলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হবে। এতে করে সড়ক অবরোধসহ সহিংসতা হতে পারে। শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে দুর্ভোগে পড়তে হবে ঘরমুখো মানুষকে।
ঈদের আগে বেতনভাতা পরিশোধের নির্দেশ ॥ ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।  বুধবার সচিবালয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আয়োজিত ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (টিসিসি) ৭৭তম সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী। পবিত্র ঈদুল ফিতরের সরকারি ছুটি শুরু হওয়ার আগেই তৈরি পোশাকসহ সব খাতের শ্রমিকদের বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধ করতে মালিকপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, মালিকপক্ষ সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করবে বলেও আশ্বস্ত করেছে। শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় উপস্থিত ছিলেন শ্রমসচিব মো. মাহবুব হোসেন, শ্রম অধিদপ্তরে মহাপরিচালক মো. তরিকুল আলম, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সভাপতি আরদাশীর কবির, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান, বাংলাদেশ মুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুল্লাহ বাদল প্রমুখ। সভা চলাকালে এক ব্রিফিংয়ে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম  চৌধুরী বলেন, মালিক-শ্রমিক উভয়ের মধ্যে আলোচনা ও সম্মতির ভিত্তিতে সরকারি ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করে যাতায়াতের সুবিধা অনুযায়ী ঈদের ছুটি দেওয়া হবে। কোনো ক্রমেই ঈদের ছুটি সরকারি ছুটির কম হবে না।

×