ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য

ঢাকার টাকা, দিল্লির রুপি

রহিম শেখ

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩; আপডেট: ২৩:৫৯, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩

ঢাকার টাকা, দিল্লির রুপি

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মোট মজুতের অর্ধেকেরও বেশি। দুই দেশের মধ্যে টাকা-রুপিতে লেনদেন প্রক্রিয়া চালু হলে রিজার্ভের প্রায় অর্ধেক পরিমাণ ডলার বেঁচে যাবে। ডলার সংকটেও পরিত্রাণ পাবে দুই দেশ। এই বাস্তবতায় গত ডিসেম্বরে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে রুপিতে লেনদেনের প্রস্তাব দেয় ভারত।

একই সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্যের দিল্লির প্রস্তাবের বিপরীতে টাকায় বাণিজ্যের প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা। ঢাকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক লেনদেনে ভারতীয় মুদ্রা রুপি অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে টাকাকেও বিনিময় মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে দিল্লিকে। প্রতিবেশী দুই দেশের এই দুই প্রস্তাব নিয়ে এখন কাজ করছে দুই দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের শুরুতে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় পরিশোধের পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

গত ৪ জানুয়ারি রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। মাত্র দুই মাসের দায় পরিশোধে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি মজুত ব্যয় হয়েছে। এই দায়ের প্রায় সবটাই ভারত থেকে আমদানি ব্যয়। অল্প কিছু দায় আছে পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ইরান ও মালদ্বীপের। বাংলাদেশসহ এই দেশগুলো আকুর সদস্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের প্রধান মুদ্রা মার্কিন ডলার ও ইউরোতে আকুর দায় পরিশোধ করা হয়। ভারতের সঙ্গে যদি রুপি-টাকায় লেনদেন হয়, তবে আকুর পেমেন্ট বাবদ দুই মাস পর পর ডলার ও ইউরোতে যে এক থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার দায় পরিশোধ হয়, সেটি ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে।

এতে ডলারের ওপর চাপ অনেকাংশে কমে যাবে। এই বাস্তবতায় গত ডিসেম্বরে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে রুপিতে লেনদেনের প্রস্তাব দেয় ভারত। তখন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি রুপির বিপরীতে টাকায় লেনদেনের প্রস্তাব দেন। প্রতিবেশী দুই দেশের এই দুই প্রস্তাব নিয়ে এখন কাজ করছে দুই দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) নূর মো. মাহবুবুল হক বলেন, ‘মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে ওরা বলেছে, যেহেতু ডলারের সংকট আছে, রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য করা যায় কিনা।

আমাদের প্রস্তাব ছিল, রুপিতে হলে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ হবে। অর্থাৎ তাদের বাণিজ্য তারা যদি রুপিতে করে আমাদের বাণিজ্য হবে টাকাতে। এটা রুপি থেকে ডলার, বা ডলার থেকে রুপিতে কনভার্টেবল না হয়ে, রুপি থেকে টাকা এবং টাকা থেকে রুপিতে কনভার্ট হবে। এটা করলে ডলারের চাপ কিছুটা কমবে।’
জানা যায়, ডলার বা অন্য কোন হার্ড কারেন্সিকে এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য চালায়, সেটাকে আর্থিক পরিভাষায় বলে কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট। ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী কারেন্সি সোয়াপে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ভারতে পণ্য রপ্তানি করে সর্বোচ্চ ২ বিলিয়ন রুপি অর্জন করবে; অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশে রপ্তানি করে পাবে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। ভারতের এই দায় রুপিতে পরিশোধ করতে গেলে বাংলাদেশ হাতে থাকা সর্বোচ্চ ২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ রুপি দিতে পারবে। ঘাটতি থাকবে আরও ১৪ বিলিয়ন ডলারের দায়।

সেই ১৪ বিলিয়ন ডলারের দায় কি বাংলাদেশ ডলার দিয়ে রুপি কিনে পরিশোধ করবে? ভারতের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপের বিষয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই রুপির বিপরীতে টাকায় লেনদেনের প্রস্তাবের বিষয়টি এসেছে। লেনদেনের এই যে শূন্যতা এখানেই টাকা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নূর মো. মাহবুবুল হক বলেন, ‘আমরা নিশ্চয় ডলার দিয়ে রুপি কিনে সেই রুপিতে লেনদেন করব না। এ কারণে আমরা (ভারতকে) বলেছি, তোমরা প্রস্তাব পাঠাও, আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর সেটার সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করে দেখবে।’ 
জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে দুদেশের বাণিজ্য দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। গত অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় ২০০ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছানোতে ভারত এশিয়ায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য হয়ে উঠেছে। তবে রপ্তানি আয় বাড়লেও পণ্য আমদানিতে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৬১৯ কোটি ডলারের পণ্য। তাতে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৪২০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘আমরা যে পরিমাণ অর্থের পণ্য রপ্তানি করি, সমপরিমাণ অর্থের পণ্য যদি রুপিতে আমদানি করা যায়, তাহলেও কিছু ডলার বাঁচবে।’ এসবিআইয়ের নির্দেশনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ডলার-সংকটের শুরু থেকেই আমরা রুপি ও টাকায় লেনদেন করার দাবি করে আসছিলাম। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময়েও এ বিষয়ে কথা হয়েছে। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (এসবিআই) ঢাকা কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, এসবিআইয়ের নির্দেশনার বিষয়টি কার্যকরের আগে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরবিআইতে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে মতামত আসার পরই রুপি-টাকায় লেনদেন শুরু হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও অনুমোদন লাগবে। অবশ্য ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানিতে রুপি-টাকায় লেনদেনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, এখন পর্যন্ত ভারতের কোনো ব্যাংক থেকে আবেদন বা অনুরোধ আসেনি। তা ছাড়া ভারতীয় মুদ্রা রুপি এখন আইএমএফের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটসের (এসডিআর) ঝুড়িতে যুক্ত হয়নি। এসডিআর ঝুড়িতে রয়েছে ডলার, ইউরো, ইউয়ান, জাপানের ইয়েন ও পাউন্ড।

আইএমএফের সদস্য দেশের মধ্যে সহজে ও নিরাপদ লেনদেনের জন্যই পাঁচটি মুদ্রায় স্বীকৃত। ফলে অন্য কোনো মুদ্রায় লেনদেন করতে হলে বিশেষ নীতি সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে।
এর আগে গত বছরের জুলাই মাসে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরবিআইয়ের চিফ জেনারেল ম্যানেজার বিবেক শ্রীবাস্তবের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংককে জানিয়ে দেওয়া হয়, এখন থেকে যে কোন দেশের সঙ্গে ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতীয় রুপিতেই ‘সেটেলমেন্ট’ করা যাবে। তাতে বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, বিশেষ করে রপ্তানিতে গতি আনতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

রিজার্ভ ব্যাংকের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছিল, ভারতের রপ্তানি বাণিজ্যসহ সার্বিক আন্তর্জাতিক ব্যবসা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে যারা যুক্ত, তাদের মধ্যে ভারতীয় মুদ্রায় লেনদেনের ইচ্ছা কিছুদিন আগে থেকে দেখা যাচ্ছিল। সেটা মাথায় রেখেই এ নতুন ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফলে বর্তমান ব্যবস্থার পাশাপাশি ইনভয়েসিং, পেমেন্ট এবং আমদানি বা রপ্তানির সেটেলমেন্ট ভারতীয় মুদ্রার মাধ্যমে করা যাবে। কিভাবে ভারতীয় মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেন হবে, তার কিছু নিয়মও ওই সময় জানিয়েছিল রিজার্ভ ব্যাংক। 

×