ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে

প্রকাশিত: ১০:০৯, ৫ অক্টোবর ২০১৯

 শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে ফিরিয়ে আনার  প্রক্রিয়া চলছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ক্যাসিনো থেকেও নিয়মিত টাকা পেত দুবাইয়ে গ্রেফতার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান। দীর্ঘ ১৩ বছর পলাতক থাকার পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে গ্রেফতার হয়েছে এই শীর্ষ সন্ত্রাসী। জিসানকে দীর্ঘদিন ধরেই নিয়মিত টাকা দিয়ে আসছিলেন ক্যাসিনো সম্রাট খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। যুবলীগে পদ বাগিয়ে নেয়ার পর জিসানকে আর নিয়মিত টাকা দেন না খালেদ মাহমুদ। এ নিয়ে ক্যাসিনো সম্রাট খালেদের সঙ্গে জিসানের দ্বন্দ্ব এক পর্যায়ে চরমে পৌঁছায়। ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ খালেদ মাহমুদ আর ‘টেন্ডার কিং’ জি কে শামীম ছাড়াও ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত রাঘব বোয়ালরা জিসানকে নিয়মিত টাকা দিতেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে আটক খালেদ মাহমুদ ও জি কে শামীমের কাছ থেকে জিসান সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য বের হয়েছে। জিসান সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে সর্বশেষ আটক সেলিম প্রধানের। পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মহিউল ইসলাম জানান, শেষ পর্যন্ত এনসিবির তথ্য মোতাবেক আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তায় আমিরাতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুবাই থেকে জিসানকে গ্রেফতার করে। বুধবার রাতে জিসানকে গ্রেফতার করা হয়। বহু বছর ধরে দুবাইয়ে পলাতক জিসানকে টাকা দিয়ে আসছিলেন ক্যাসিনো সম্রাট খালেদ মাহমুদ। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে বহু বছর ধরে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছিল। দুবাইয়ে তার বসবাসের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। দুই মাস ধরে দুবাইয়ের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছিল। দুবাইয়ের এনসিবিও বাংলাদেশের এনসিবির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছ থেকে জিসানের সর্বশেষ ছবি সংগ্রহ করে দুবাইয়ে পাঠানো হয়। সেই সঙ্গে জিসান সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্যও জানানো হয়। এরপর দুবাইয়ের এনসিবি জিসানকে শনাক্ত করে। জিসানকে শনাক্ত হওয়ার পর জিসানের ওপর সর্বক্ষণিক নজরদারি চালায় তারা। দুবাই এনসিবি জিসানকে নজরদারির মধ্যে রাখার বিষয়টি ঢাকাকে নিশ্চিত করে। আরও নিশ্চিত হতে দুবাই এনসিবি ঢাকার কাছে জিসান সম্পর্কে আরও তথ্য চায়। জিসান ভিন্ন নামে দুবাই আছে বলে জানানো হয়। জিসান অন্য দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করছে বলে নিশ্চিত করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মাধ্যমে সে সব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়। যাচাই-বাছাইয়ে জানা যায়, জিসান ‘আলী আকবর চৌধুরী’ নামে দুবাইয়ে অবস্থান করছে। ভারতীয় নাগরিক পরিচয়ে। তার পাসপোর্ট ভারতীয়। পাসপোর্টটি যাচাই-বাছাই করা হয়। এরপর দুবাই এনসিবি জানায়, জিসান ডমিনিকান রিপাবলিকের পাসপোর্ট ব্যবহার করছে। ডমিনিকান রিপাবলিকের সঙ্গেও এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়। তারা ‘আকবর আলী’ নামে কাউকে পাসপোর্ট দেয়া হয়নি বলে জানায়। এদিকে জিসান সম্পর্কে ইন্টারপোলকে রেডএলার্ট নোটিসটি আপডেট করতে বলা হয়। ইন্টারপোল সেটি নিশ্চিত করে। জিসান সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য সংযোজন করা হয় ইন্টারপোলের রেডএলার্ট নোটিসে। নোটিসে জিসানের বিরুদ্ধে আরও কিছু মামলা থাকার বিষয় যুক্ত করা হয়। জিসান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে এনসিবি দফায় দফায় বৈঠক করে। ডিবি সূত্র জানায়, জিসান দুবাই থাকলেও ঢাকায় তার সন্ত্রাসী তৎপরতা আছে। এমনকি জিসানের ভাইও দুবাই থেকে সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করে আসছে। এই সূত্র ধরে এদেশে থাকা সহযোগীদের সঙ্গে জিসান ও তার ভাইয়ের দুই সহযোগী। সম্প্রতি ঢাকায় গ্রেফতার হয়। তাদের কাছ থেকে জিসান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আপডেট তথ্য পাওয়া যায়। এমনকি দুবাইতে জিসানের সঙ্গে যোগাযোগের কয়েকটি মোবাইল ফোন নম্বরও পাওয়া যায়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার ফকিরাপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়ে জুয়া খেলা অবস্থায় নারী-পুরুষসহ ১৪২ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। জব্দ হয় ক্যাসিনোর সরঞ্জামাদি, বিদেশী মদ, ইয়াবা, নগদ টাকা, জালটাকাসহ অনেক কিছু। ক্যাসিনোটি চালানোর দায়ে ঢাকা মহানগর যুবলীগের দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে ওইদিনই গুলশানের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতারের সময় তার বাসা থেকে ৪শ’ পিস ইয়াবা, প্রায় দশ লাখ টাকা ও ৬ লাখ টাকার ডলার পাওয়া যায়। তার কাছে তিনটি অস্ত্র পাওয়া যায়, যার একটি অবৈধ। অপর দুটি অস্ত্র বৈধ লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে গুলশান মডেল থানায় তিনটি মামলা দায়ের করেন র‌্যাব-৩-এর ওয়ারেন্ট অফিসার গোলাম মোস্তফা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকার মতিঝিল, শাহজাহানপুর বাসাবো, পল্টনসহ পুরো এলাকার ১০/১২ ক্লাব খালেদ মাহমুদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এর মধ্যে বড় কয়েকটি ক্লাবে ক্যাসিনো চলত। অন্য ক্লাবগুলোয় ছোট ছোট জুয়ার আসর বসত। সবই খালেদ মাহমুদ তার গড়ে তোলা সিন্ডিকেট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন। এসব ক্লাব থেকে জুয়ার মাধ্যমে উপার্জিত টাকার একটি অংশ সন্ত্রাসীদের দিতেন খালেদ মাহমুদ। বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসী জিসান বড় একটি ভাগ পেতেন। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া বহুদিন দুবাই পলাতক থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে নিয়মিত টাকা দিয়ে আসছিলেন। সর্বশেষ ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের পদ বাগিয়ে নেয়ার পর ক্যাসিনো সম্রাট খালেদ জিসানকে আর নিয়মিত টাকা দিচ্ছিলেন না। এ নিয়ে খালেদ মাহমুদের সঙ্গে জিসানের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, খালেদ মাহমুদ ও তার অপর দুই সহযোগী গ্রেফতার হওয়ার পর জিসান সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এমনকি দুবাইয়ে জিসানের সঙ্গে যোগাযোগের মোবাইল নম্বরও পাওয়া যায়। সেগুলো এনসিবির মাধ্যমে দুবাই এনসিবিকে দেয়া হয়। তারা ওই সূত্র ধরে জিসানকে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে শনাক্ত করে। বৃহস্পতিবার দুবাই এনসিবি ঢাকার এনসিবিকে জিসানকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করে। দুবাই এনসিবির সঙ্গে আইপি ফোনে যোগাযোগ হয় বাংলাদেশ এনসিবির। এতে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি জিসান বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। তাকে গ্রেফতারের পরই দুবাইয়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নেয়া হয়। এনসিবির উর্ধতন কর্মকর্তা মহিউল ইসলাম জানান, গ্রেফতারের পরপরই জিসানের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই দুবাই থেকে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণাদি চাওয়া হয়েছে। জিসানের বিরুদ্ধে থাকা মামলা সংক্রান্ত নথিপত্র পাঠানো হচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এসব নথিপত্র সরবরাহ করছে। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জিসানকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাকে দেশে ফেরত আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। জিসানকে দেশে ফেরত আনার বিষয়ে পুলিশের এআইজি (মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) মোঃ সোহেল রানা জানান, আইনী প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে জিসানকে দেশে ফেরত আনার চেষ্টা চলছে। এজন্য ইন্টারপোল ছাড়াও দুবাই এনসিবির সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। স্মর্তব্য এক দশক ধরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত দেশের শীর্ষ ২৩ সন্ত্রাসীর অন্যতম জিসান। দেশের ‘মোস্টওয়ান্টেড’ আসামি। তাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। দুবাই বসেই ঢাকার গুলশান, বনানী, বাড্ডা, মতিঝিলসহ বেশ কিছু এলাকার সন্ত্রাসী কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করত জিসান। কথামতো কিংবা চাহিদা অনুযায়ী কাজ না হলেই গুলি করে হত্যাসহ যে কোন অপরাধ সংঘটিত হতো তার নির্দেশেই। দেশে তার বাহিনীর সদস্যরা এসব সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে আসছিল। তাদের মূল কাজ চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি। ২০০৩ সালে মালিবাগের একটি হোটেলে দুজন ডিবি পুলিশ হত্যার পর আলোচনায় আসে জিসান। এরপরই সে আত্মগোপনে চলে যায়। সর্বশেষ জিসানের নির্দেশে চাঁদা না দেয়ায় রামপুরার তোবা গার্মেন্টস ও ভয়াবহ আগুনে শতাধিক শ্রমিক পুড়ে মারা যাওয়া তাজরিন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেনকে ভেবে তার শ্বশুরকে পাজেরো গাড়ির ভেতরে গুলি চালিয়ে হত্যা করে জিসানের সহযোগীরা। ২০০৫ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। সূত্র বলছে, জিসান পালিয়ে প্রথম ভারত যায়। সেখানে নিজের নাম বদলে ‘আলী আকবর চৌধুরী’ নামে পাসপোর্ট বানিয়ে সেই পাসপোর্টে দুবাই পালিয়ে যায় জিসান।
×