ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা

শিবির ছেড়ে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

শিবির ছেড়ে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ রোহিঙ্গারা শরণার্থী শিবির বাদ দিয়ে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ার টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে কি কারণে তারা শরণার্থী শিবির ছেড়ে কক্সবাজার ত্যাগ করার চেষ্টা করছে। জেলা প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিকে এড়িয়ে শিবির থেকে পালানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ পর্যন্ত প্রায় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়েছে শরণার্থী শিবির ছেড়ে। এদিকে, ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সভায় রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় পাওয়া গেলে আটক বা গ্রেফতারের পরিবর্তে উদ্ধার দেখাতে বলায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে প্রশাসন। অভিযোগ রয়েছে, মানবিক দিক চিন্তা করে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই দিয়েছে সরকার। তবে রোহিঙ্গারা যেন কোন অপরাধের সঙ্গে জড়াতে না পারে সেদিকে পুলিশ ও র‌্যাবের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গারা যেন কক্সবাজার ছাড়তে না পারে সেজন্য চেকপোস্ট বসানো আছে তবুও পালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। বিভিন্নভাবে নজরদারি রাখা হয়েছে যেন রোহিঙ্গাকে কেন্দ্র করে কেউ ব্যবসায় মেতে উঠতে না পারে। দেশব্যাপী রোহিঙ্গা ছড়ানো ঠেকাতে মরিয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে একদিকে প্রবেশ অন্যদিকে রোহিঙ্গা ঠেকানোর বিষয়টি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কেন রোহিঙ্গা প্রবেশে বাধা না দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা আটকাতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে তা নিয়ে সচেতনদের মাঝ রয়েছে কৌতূহল। এ কেমন সিদ্ধান্ত, এ কেমন মানবতার টান। তবে এসব রোহিঙ্গা এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি অনুপ্রবেশ বন্ধ করা না যাওয়াতে ও পুশব্যাক করা না যাওয়ার কারণে এখন অপরাধের মাত্রা বাড়ছে কক্সবাজারে। কারণ ত্রাণের পণ্য ও খাদ্য সামগ্রী কমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই রোহিঙ্গারা উপার্জনের দিকে এগোচ্ছে। এখনই টেকনাফ-কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন শ্রমবাজার ও দিনমজুর এমনকি হতদরিদ্র শ্রেণীর ওপর প্রভাব পড়ছে। অভাবের তাড়নায় শুরু হয়েছে অপরাধ। আরও অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গারা কক্সবাজার থেকে সটকে চট্টগ্রাম শহর হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিলেঢালা নজরদারির রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে। তবে মুষ্টিমেয় কিছু অভিযানে রোহিঙ্গারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্টে ধরা পড়লেও বিভিন্ন পরিবহনে দেশীয় সিন্ডিকেট গাড়ি ভাড়া করেই এসব রোহিঙ্গাদের সুযোগ দিচ্ছে। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ এখন জীবিকা নির্বাহের তাগিদে রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন জেলা শহরগুলোর শ্রমবাজারে উঠতে শুরু করেছে। এমনকি সীতাকু-ের কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাট হয়ে রোহিঙ্গারা পাড়ি জমাচ্ছে দেশের একমাত্র ব-দ্বীপ অঞ্চল সন্দ্বীপে। কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানাধীন থাইংখালীর হাকীমপাড়া এলাকায় রোহিঙ্গাদেরকে অবৈধভাবে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জায়গায় অবৈধভাবে শরণার্থী ক্যাম্প স্থাপন করছে বিভিন্ন চক্র। তারা ক্যাম্প পরিচালনা করার জন্য গোপনীয়ভাবে কমিটি গঠন করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান করছে। এসব রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দানের বিনিময়ে তাদের নিকট থেকে অর্থ আদায়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও এবং বিভিন্ন সংস্থার নিকট হতে ত্রাণসামগ্রী গ্রহণ করে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গাদের সহায়তা করছে পুরাতন রোহিঙ্গা সিন্ডিকেটসহ টেকনাফ-কক্সবাজার সিন্ডিকেট। উখিয়া ও কুতুপালংয়ে সরকারের নির্ধারিত শরণার্থী শিবির থাকলেও এখন তা বান্দরবানের নাইক্ষ্যাংছড়ি, বালুখালী থেকে শুরু করে কক্সবাজারের আনাচে-কানাচে এমনকি বাসাবাড়িতেও মানবিকতার টানের দোহাই দিয়ে ঠাঁই করে নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। প্রশ্ন উঠেছে এদেশের মানুষের মানবিকতাকে পুঁজি করে শেষ পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলায় আবাস গড়ে তোলে কিনা রোহিঙ্গারা। এদিকে, বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের মোবাইল ও সিম ব্যবহার শুরু করেছে এসব রোহিঙ্গারা। প্রশ্ন উঠেছে, বায়োমেট্রিক সিম জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যতীত কিসের ভিত্তিতে তাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটরদের দোকানিরা বিভিন্ন নামে এসব সিম বিক্রি করলেও রোহিঙ্গাদের অপরাধের কারণে নিবন্ধিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ ও ২৬ আগস্ট ২ দিনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে বাধা দিলেও পরে মানবিকতার বিষয়টি বিবেচনায় এনে সরে দাঁড়ায় রোহিঙ্গা ঠেকানো থেকে। ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ ও ২৬ তারিখ বিজিবি প্রথমদিকে দুই হাজার রোহিঙ্গা পুশব্যাক করলেও পরে অনায়াশে প্রবেশের সুযোগ পাওয়ায় বর্তমানে রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এদিকে, এক মতবিনিময় সভায় রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোহিঙ্গা ঠেকাতে ২৭টি চেকপোস্ট বসানোর নির্দেশনা দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের ডিআইজি এস এম মনির-উজ-জামান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তথা ইরান, মরক্কো, ভারত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া রোহিঙ্গাদের সাহায্য সহোযোগিতার হাত বাড়াতে গিয়ে ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছে। তবে ব্যক্তিগত ও বেসরকারী পর্যায়ের ত্রাণ বিতরণের কোন হিসাব নেই। বিশ্বের ৪০টি দেশের রাষ্ট্রদূতসহ ৪৭টি দেশের প্রতিনিধি কক্সবাজারের উখিয়া, কুতুপালংসহ বিভিন্ন রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করলেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে পারেনি। মিয়ানমার রোহিঙ্গা তাড়ানোর ইস্যুতে অটল থাকায় নাফ নদী পার হয়ে রোহিঙ্গারা আসছে এদেশে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব সেভেন কক্সবাজারের বিভিন্ন সড়কে চেকপোস্ট বসিয়েছে। ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেস্বর কক্সবাজারের লিংক রোড এলাকায় স্থাপিত চেকপোস্টে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ২১০ জন রোহিঙ্গা আটকের ঘটনা ঘটেছে। তখন এসব রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারে বালুখালী শরণার্থী শিবিরে হস্তান্তর করেছিলেন র‌্যাব সেভেনের কক্সবাজারের কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমীন। প্রশ্ন উঠেছে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশে কোন বাধা না থাকায় রোহিঙ্গারাই এখন এদেশের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট থেকে।
×