ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

বুলেটবিদ্ধ এক অসহায় মায়ের কষ্টের কথা

চোখের সামনে সন্তানের নির্মম মৃত্যু দেখেছি, কিছুই করতে পারিনি

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১১ আগস্ট ২০১৭

চোখের সামনে সন্তানের নির্মম মৃত্যু দেখেছি, কিছুই করতে পারিনি

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ সূর্যের কিরণ তখনও চারপাশ আলোকিত করেনি। ফজরের আযানের সুরেলা ধ্বনি চারদিক থেকে সুধা ঢালছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এমনই এক সময় অতর্কিত হামলায় কেঁপে উঠল ঢাকার ২৭নং মিল্টো রোডের বাড়িটি, বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের সদর দফতর। ঘাতকদের আগমনে ভীত চার বছরের শিশু সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত আশ্রয় চাইলেন মা শাহানারা আব্দুল্লাহর কোলে। কিন্তু মমতাময়ী মা তার আদরের শিশুপুত্রকে আর কোলে নিতে পারেননি। তার আগেই ঘাতকরা মায়ের চোখের সামনেই নির্মমভাবে গুলিতে হত্যা করে সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতকে। অশ্রুসজল নয়নে সেদিনের লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সিনিয়র সহসভাপতি শাহানারা বেগম বলেন, বাবু আমার কোলে আসতে চেয়েছিল কিন্তু সেদিন আমি বাবুকে কোলে নিতে পারিনি। চোখের সামনেই সন্তানের নির্মম মৃত্যু দেখলেও কিছুই করতে পারিনি বলেই অনেকটা স্তব্ধ হয়ে যান তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কালরাতে ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলার পাশাপাশি তার ভগ্নিপতি ও তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭নং মিল্টো রোডের বাড়িতেও হামলা করে ঘাতকরা। সেখানে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ ছয়জনকে হত্যা করা হয়। এরমধ্যে চার বছরের শিশু সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতও ছিলেন। মমতাময়ী মা শাহানারা আব্দুল্লাহ আলাপচারিতার শুরুতেই বলেন, সেদিন (১৫ আগস্ট) ফজরের আযানের পর আমরা প্রচ- গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। শব্দ আমাদের বাসার দিকেই আসছিল। গুলির শব্দে হঠাৎ আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমার শাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগম) বলেন, বাড়িতে ডাকাত পড়েছে আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দাও। আমার শ্বশুর আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুকে একটা ফোনও করেছিলেন। কিন্তু কি কথা হয়েছে বলতে পারব না। এরই মধ্যে আমি শেখ ফজলুল হক মনি ভাইকে ফোন করলাম। ফোনে তাকে বললাম, আমাদের বাড়ির দিকে কারা যেন গুলি করতে করতে আসছে বুঝতে পারছি না। মনি ভাই বলেন, কারা গুলি করছে দেখো। বললাম, বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে দেখা যাচ্ছে না। মনি ভাই বলেন, তারপরও দেখো কারা আসছে। এর মধ্যে ফোনটি আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে আমার শাশুড়ি মনি ভাইকে বলেন, বাবা বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমাদের বাঁচাও। এই কথা বলেই ফোন রেখে দিয়ে আমার শাশুড়ি আমার শ্বশুরকে বললেন, কি ব্যাপার তুমি আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দিলা না? আমার শ্বশুর বলেন, তোমার ভাইও মনে হয় রেহাই পায়নি। ওনার সঙ্গে কি কথা হয়েছে আমরা সেটা শুনিনি। আমাদের দরজা ভাঙ্গার শব্দ পাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা চিৎকার শুনলাম, তোমরা সামনে এগোবে না, ভাল হবে না। এ সময় ওরা (ঘাতকরা) থমকে দাঁড়ায়। চিৎকারটি দিয়েছিলেন আমার স্বামী (আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ)। এরপর উনি দোতলায় চলে যান। কাজের বুয়া দরজাটা বন্ধ করে দেয়। দরজা বন্ধ করে দেয়ার পর উনি আমাদের ঘরে না ঢুকে ডান পাশের রুমে ঢুকে যান। পরে আমরা জানতে পারি, একটা ফোন আসে (ফোনটি রিসিভ করে হাসানাত) মনি ভাই মারা গেছেন। অশ্রুসজল শাহানারা বেগম আরও বলেন, এর মধ্যে ঘাতকরা বাড়ির দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকে। তারা প্রতিটি রুমে ঢুকে হ্যান্ডসআপ হ্যান্ডসআপ বলে আমাদের সবাইকে কর্ডন করে নিচতলার ড্রইংরুমে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখে। সিঁড়ির অর্ধেক নেমেই বাবু (সুকান্ত বাবু) বলে, মা আমি তোমার কোলে উঠব। আমি ওকে কোলে নিতে পারলাম না। পাশে আমার ভাসুর (শহীদ সেরনিয়াবাত) ওকে কোলে নিল। নিচে নামার পর ভারি অস্ত্র ঠেকিয়ে ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে উপরে আর কে কে আছে? এমন সময় আমার শ্বশুর আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন; তার চোখের ইশারায় আমি বললাম, উপরে আর কেউ নেই। যে কারণে উপরের রুমগুলো তল্লাশি না হওয়ায় আমার স্বামী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে ওরা খুঁজে পায়নি। শাহানারা বেগম বলেন, তখনও আমরা বুঝতে পারছিলাম না ওরা আমাদের মারতে এসেছে না গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। আমার শ্বশুর ওদের বলল, তোমরা কি চাও। তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে। ওদের মধ্য থেকে একজন বলে, আমরা কিছুই চাই না, আমাদের কোন কমান্ডিং অফিসার নেই। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘাতকরা ব্রাশ ফায়ার করে। আমরা মাটিতে পড়ে যাই। এ কথা বলতেই শাহানারা বেগমের চোখ বেয়ে বেদনার জলধারা বইতে শুরু করে। কণ্ঠ ভারি হয়ে ওঠে। কিছু সময়ের জন্য চুপ থেকে চোখের জল মুছে শাহানারা বেগম আবার বলতে শুরু করলেন, শহীদ ভাইকে ...ঠেকিয়ে ওরা গুলি করে। উনি সঙ্গে সঙ্গে উপুড় হয়ে পড়ে যান। আমার শ্বশুরের শরীর দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। আমার শরীরের পেছনের অংশে হাত দিয়ে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। ওরা চলে যেতে লাগল। তখনও আমার জ্ঞান ছিল। এর মধ্যেই কে যেন কান্না করে ওঠে। এরপর ঘাতকরা আবার দৌড়ে এসে ব্রাশ ফায়ার করে। এবার ওরা নিচ দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। আমার শ্বশুর সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান। আমি আমার শ্বশুরের পেছনে ছিলাম, আমার কোমরে গুলি লাগে। ব্রাশ ফায়ারে ছয়জন মারা যায়। আমরা গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নয়জন কাতরাচ্ছিলাম। এর মধ্যে আবার একদল লোক গাড়ি নিয়ে আসে। তখন ভাবলাম এই বুঝি শেষ! কিন্তু, পরে দেখি রমনা থানার পুলিশ এসেছে। তারা আমার শ্বশুরের পালস্ দেখে বলে বাড়ির কেউ আহত আর কেউ মারা গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মমতাময়ী শাহানারা বেগম বলেন, পুলিশ আসার পর বাবুকে শহীদ ভাইয়ের বুকের নিচ থেকে ওঠানো হলো। দেখলাম ওর নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ আগে যে সন্তান আমার কোলে উঠতে চেয়েছিল তাকে কোলে নিতে পারি নাই, সেই আদরের সন্তানের নিথর দেহ আমার চোখের সামনে। ছেলের ছবির এ্যালবামে হাত বুলিয়ে পুরনো স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মমতাময়ী মা শাহানারা বেগম। ছেলের স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, আমার বাবু ছিল অসম্ভব মা ভক্ত। আমি যখন যা বলতাম তা মেনে নিত। মাঝে মধ্যে বলত, মা তোমাকে ছেড়ে অনেকদূরে ঘাসের মধ্যে গিয়ে শুয়ে থাকব। এই কথা বলেই দীর্ঘ সময় তার (শাহানারা বেগম) কথা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আবার শাহানারা বেগম বলেন, ওর জন্ম ১৯৭১ সালের ২২ জুন। মুক্তিযুদ্ধকালে ওকে বুকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে দৌড়েছি। একদিকে আর্মি অন্যদিকে রাজাকার। আমার স্বামী (আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ) বরিশাল অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। রাজাকাররা পেলেই আমাদের মেরে ফেলবে। এই আতঙ্কে ছিলাম। যুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘদিন হাসানাতের সঙ্গে দেখা হয়নি। পরে একটি চিরকুটের মাধ্যমে জানতে পেলাম তিনি পয়সারহাট এসেছেন। সেখানে গিয়ে দেখা করি। সেই সময় বাবুকে বুকে নিয়ে আজকে এই বাড়ি কালকে ওই বাড়িতে দিন পার করেছি। ওই সময় গ্রামে দুধ তো দূরের কথা ভাতও ঠিকমতো পাওয়া যায়নি। তাই ভাত টিপে টিপে নরম করে বাবুকে খাইয়েছি। বাবু রাজত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। আবার ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই (সুকান্ত বাবু) চলে গেল বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতের অসহায় মা শাহানারা বেগম। সেই ভয়াল কালরাতে তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ঢাকার মিল্টো রোডের বাসায় বরিশালের ছয় নারী-পুরুষ নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন। তারা হলেন, সাবেক মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি কৃষককুলের নয়নমণি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত এবং বরিশালের ক্রিডেন্স শিল্পগোষ্ঠীর সদস্য আব্দুর নঈম খান রিন্টু। আহত হয়েছিলেন নয়জন। তারা হলেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সহধর্মিণী আমেনা বেগম, শাহানারা বেগম, বিউটি সেরনিয়াবাত, হেনা সেরনিয়াবাত, আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ, রফিকুল ইসলাম, খ ম জিল্লুর রহমান, ললিত দাস ও সৈয়দ মাহমুদ।
×