স্টাফ রিপোর্টার ॥ উগ্রবাদী আগ্রাসনের অস্থির সময়ে আবারও আশ্রিত হলেন ফকির লালন সাঁই। অনেক বেশি প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সামনে এলো লালন ফকিরের মানবতার বাণী। জাত-পাতের বিভেদ ঘুচিয়ে লালনের সৃষ্টির আলোয় উচ্চারিত হলো শান্তির আহ্বান। তাঁর গান ও দর্শনের চর্চায় প্রকাশিত হলো হিংসার বিরুদ্ধে অহিংসার বারতা। হিংসার বিরুদ্ধে শান্তির বাণী ছড়াতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে তাঁরই অনুসারীরা জড়ো হয়েছেন রাজধানীতে। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা প্লাজা পরিণত হয়েছে সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টাকে খুঁজে ফেরা সেই সব বাউলসাধক ও ফকিরের পুণ্যভূমিতে। বিশাল আঙ্গিনাজুড়ে বসেছে গান গেয়ে মানবপ্রেমের কথা বলা এ সাধকদের ছোট ছোট আখড়া। সেখানে অবস্থান করছেন সারাদেশ থেকে আসা দেড় শতাধিক বাউল। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলছে সাধুসঙ্গ। গুরু-শিষ্যের আলাপচারিতার সঙ্গে সমানতালে চলছে গান-বাজনা। হচ্ছে গুরুকে নিবেদিত ভজন। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘ফকির লালন সাঁইজির ঘরানার ভাবশিষ্যদের সম্মিলনী ও ভাবগীত পরিবেশনা’। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া চার দিনব্যাপী আয়োজনটির তৃতীয় দিন ছিল শনিবার। এদিন সকালে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাউলসঙ্গীত সংরক্ষণ’ বিষয়ক আলোচনা। সন্ধ্যায় বসেছিল হৃদয় উতাল করা মরমী গানের আসর। একাডেমি আয়োজিত শিল্পের আলোয় বঙ্গবন্ধু শীর্ষক মাসব্যাপী কর্মসূচীর অংশ হিসেবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
শনিবার সকালের চিত্রশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনায় উঠে আসে জঙ্গীবাদের উত্থান রোধে সারাদেশে বাউলসঙ্গীত ছড়িয়ে দেয়া, লালনের দর্শন প্রচারে দেশব্যাপী উদ্যোগ নেয়া এবং বাউলদের নিগৃহীত হওয়াসহ নানা বিষয়। আলোচকদের একজন ফকির হৃদয় সাঁই বলেন, একজন বাউলসাধকের কোন জাগতিক চাওয়া-পাওয়া নেই। নেই কোন ঘরবাড়ি বা বিষয়-সম্পত্তি। সৃষ্টির মাঝেই তাঁরা স্রষ্টার সান্নিধ্য কামনা করে। পালন করে মানুষ ভজনের ধর্ম। লালনের গান ও দর্শনে প্রচার করে মানবতার বাণী। গুরু ভক্তির মাধ্যমে সত্যকে ধারণ করে খুঁজে নেয় শান্তির পথ। অথচ সেই শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে শুধুমাত্র গান গাওয়ার অপরাধে প্রায়ই অহেতুক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। আমাদের শব্দ কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। বাউলগান গাইতে গেলে বাধার মুখে পড়তে হয়। এভাবেই মানুষরূপী অমানুষদের অপতৎপরতায় রুদ্ধ হয় লালনের গান তথা মানবতা ও শান্তির দর্শন।
উগ্রবাদের মোকাবেলায় লালনের গানের চর্চা প্রসঙ্গে আরেক আলোচক বাউলগুরু পাগলা বাবলু বলেন, সারাদেশের জেলা শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে মানবতাবাদী দর্শনের এ গান। কর্মশালাসহ নানা আয়োজনে নতুন প্রজন্মের মাঝে এ সঙ্গীতধারার বীজটি বুনে দিতে হবে। তাহলেই এ দেশ মৌলবাদের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে খুঁজে পাবে আলোর পথ। কারণ, এখানে নেই কোন জাত-পাত বা ধর্মের বিভাজন। তাই লালনের গানের চর্চা কিংবা তাঁর দর্শনকে আত্মস্থ করলে কেউ আর বিপথগামী হবে না। তিনি আরও বলেন, সারাদেশে বাউলসাধকের ৪৫০ থেকে ৫০০টি আখড়া বাড়ি আছে। আমরা ভক্তদের নিয়ে বছরে একটি উৎসবের আয়োজন করি। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই অনেক সময় এ উৎসব করতে পারি না। দুস্থ কোন বাউল কখনও পায় না কোন সরকারী বা বেসরকারী সহযোগিতা।
সভাপতির বক্তব্যে একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্বে দেবে বাউলরা। লালনের দর্শনই বাঁচাতে পারে উগ্রবাদে আক্রান্ত বিশ্বকে। কারণ, সর্বধর্মের সম্মিলনই হচ্ছে লালনের দর্শন। আলোচনা শেষে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এ সভার মাধ্যমে আমরা লালনের অনুসারীদের সঙ্কটের কথাগুলো শুনলাম। নিরাপত্তা প্রদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের প্রস্তাবগুলোও গ্রহণ করেছি। বাউলদের যেন নির্যাতিত না হতে হয় সে লক্ষ্যে আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করব। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে সুপারিশ করা হবে যেন বাউলদের সংস্কৃতিচর্চায় কোন বাধা না আসে। এছাড়া আমরা কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার লালন একাডেমিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এ সাজানোটা যেন বাউলদের চর্চা ও সাধনার উপযোগী হয় সেটাও লক্ষ্য রাখা হবে। এছাড়া আমরা প্রতিটি জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বাউলসঙ্গীতের কর্মশালা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে এ কর্মশালা শুরুও হয়েছে। এছাড়া একাডেমির উদ্যোগে প্রতিটি জেলায় পৃথকভাবে ফোকলোর সেল গঠন করা হবে।
আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি সচিব আক্তারী মমতাজ। এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন- ইউনেস্কো জাতীয় কমিশনের সচিব মোঃ মনজুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা নাহির শাহ, লোকসঙ্গীতশিল্পী কিরণ চন্দ্র রায় প্রমুখ।
সকালের আলোচনা শেষে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’ শীর্ষক মরমী গানের আসর। সুরে সুরে মানবতা ও শান্তির বাণী উচ্চারিত হয়। মানবতার জয়ধ্বনি করে পাগলা বাবলু গেয়ে শোনান- এমন মানবসমাজ কবে সৃজন হবে/যেদিন হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান জাতি-গোত্র ভেদ নাহি রবে। ফকির বিদ্যুৎ সরকার পরিবেশন করেন ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’। ফকির ডাবু গেয়ে শোনান ‘মুরশিদ মানলেই খোদার মান্য হয়’। বাউল অমিয় শোনান ‘জাতে অপমৃত্যু ঘটে মন সদা তাই করে’। বাউল মিলনের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘চরণ ছাড়া করো না হে দয়াল’ ও ‘কি এক অচিন পাখি পোষলাম খাঁচায়’। বাউল সুভাষ বিশ্বাস গেয়ে শোনান ‘লয়ে গুরু মন্ত্র ছেড়ে তন্ত্র’। এছাড়াও সঙ্গীত পরিবেশন করেনÑ ফকির শরীফ সাধু, ফকির শাহ আলম স্বপন, ফকির ইয়াকুব, ফকির নিজাম সাঁই, ফকির বাউল মোহিনী সরকার, ফকির বাউল গণেশ বসু, ফকির নইর শাহসহ অনেকে।
আজ রবিবার সকাল ১০টায় বাউলদের নিয়ে মানবতার গান গেয়ে বের করা হবে শোভাযাত্রা। এটি একাডেমি থেকে বেরিয়ে শেষ হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।
অর্থমন্ত্রীর ‘হিস্টোরি অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থের প্রকাশনা ॥ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালী আত্মত্যাগ ও ছাড় দিয়ে এসেছে। সে আত্মত্যাগ একতা তৈরির পরিবর্তে সৃষ্টি করেছে বৈষম্যের। আর সে বৈষম্য থেকেই বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ।
শনিবার বিকেলে রাজধানীর এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশে আয়োজিত অর্থমন্ত্রীর লেখা ‘হিস্টোরি অব বাংলাদেশ : এ সাবকন্টিনেন্টাল সিভিলাইজেশন’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালীদের বড় ভূমিকা ছিল। কিন্তু তার পর থেকে বাঙালী আত্মত্যাগ করে আসছে। রাজধানী হয়েছে করাচী, ভাষা হয়েছে উর্দু। সম্পদের বণ্টনেও ছিল বৈষম্য। বাঙালীর এ আত্মত্যাগ একতার সৃষ্টি না করে বৈষম্য তৈরি করেছে। সে বৈষম্যই স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে নিয়ে গেছে আমাদের। তাই অনেক আগেই বাংলাদেশ নামের রাষ্টের গ-ি নির্ধারণ হয়ে গেছে। হৃদয়ে, মননে বাংলাদেশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল তখন থেকেই।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ২২ বছরের গবেষণার ফসল ‘হিস্টোরি অব বাংলাদেশ : এ সাবকন্টিনেন্টাল সিভিলাইজেশন’ বইটি। বইটির বিষয়ে উল্লেখ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে গিয়ে সবাই আড়াই হাজার বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেন। আমার প্রশ্ন তার আগে কি বাংলাদেশ ছিল না? ভারতবর্ষের সভ্যতার ইতিহাসের সব জায়গাতেই বাংলাদেশ ছিল। এটা আমাদের আরও দৃঢ়ভাবে বলা উচিত।’
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, আবুল মাল আবদুল মুহিত তার বইতে বাংলাদেশের ইতিহাসকে সামগ্রিক ভারতীয় সভ্যতার আলোকে ব্যক্ত করেছেন। বইতে লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতায় পাকিস্তান আমলের ইতিহাস, জাতীয়তাবাদের বিকাশ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা পৃথিবীর রাজনীতিসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। বইটি মনযোগ আকর্ষণ করার মতো।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রফেসর আমিরুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন- প্রফেসর ড. আবদুল মোমেন চৌধুরী ও প্রফেসর ড. সোনিয়া নিশাত আমিন।
কথা, গান ও কবিতায় বঙ্গবন্ধু স্মরণ ॥ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার বিকেলে খেলাঘর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘কথা, গান ও কবিতায় বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিম-লীর সদস্য নূরুর রহমান সেলিম। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বিশিষ্ট লেখক মণি সিংহ ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টের সভাপতি শেখর দত্ত, ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন, আবৃত্তিকার মীর বরকত। বক্তব্য রাখেন- খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিম-লীর সদস্য আব্দুল মতিন ভূঁইয়া, হাসান তারেক, খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবুল ফারাহ পলাশ, খেলাঘর ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান শহীদ। স্বরচিত ছড়া পাঠ করেন মানসুর মোজাম্মিল। হে মহামানব একবার এসো ফিরে- এ গানটি সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশন করেন খেলাঘরের সদস্যরা। আবৃত্তি করেন খেলাঘরের বন্ধু সৈয়দা রাইসা মাহযাবিন। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন ফারিহা সাকিন রোজা ও আসিফ ইকবাল সৌরভ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক সাহবুল ইসলাম বাবু।
স্মরণে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর ॥ স্বপ্নবাজ দুই বন্ধুর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সিনেমার ফেরিওয়ালা পরিচয়। চলচ্চিত্র নির্মাণই ছিল তাঁদের ধ্যান-জ্ঞান। পাঁচ বছর আগে আকস্মিক দুর্ঘটনায় নিভে যায় তাঁদের প্রাণপ্রদীপ। তাঁদের একজন হলেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও অপরজন হলেন চলচ্চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর। শনিবার ছিল চলচ্চিতপ্রাণ এ দুই ব্যক্তিত্বের পঞ্চম প্রয়াণবার্ষিকী। এ উপলক্ষে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ (এফএফএসবি), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং প্রজন্ম ’৭১ যৌথভাবে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর স্মরণে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও স্মরণ আলোচনার আয়োজন করে।
শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে এ স্মরণানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে প্রদর্শিত হয় তারেক মাসুদ নির্মিত চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’। এর পর তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ নিহত চলচ্চিত্রকর্মীদের স্মরণে মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বলন করা হয়। সন্ধ্যায় ছিল আলোচনা। আলোচনার শুরুতে রানওয়ে চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করেন চলচ্চিত্র সমালোচক অধ্যাপক আ আল মামুন। স্মরণ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন- এফএফএসবির সভাপতি স্থপতি লাইলুন নাহার স্বেমি, চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম, মিশুক মুনীরের সহোদর আসিফ মুনীর, তারেক মাসুদের সহোদর নাহিদ মাসুদ ও অনল রায়হান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন এফএফএসবির সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন। সভাপতিত্ব করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: