ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ডিএসই সূচক হারিয়েছে ৭২ পয়েন্ট

শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক দরপতন

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ২৭ মার্চ ২০২৪

শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক দরপতন

শেয়ারবাজার সাম্প্রতিককালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে

শেয়ারবাজার সাম্প্রতিককালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। যৌক্তিক কারণ ছাড়াই হু হু করে নিচের দিকে নামছে শেয়ারবাজারের সূচক। সবচেয়ে বড় কথা যে হারে সূচক কমছে তার চেয়েও ভয়ংকরভাবে মূলধন হারাচ্ছে বিনিয়োগকারী। ব্যাংকে আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় নিশ্চিত মুনাফার আশায় শেয়ারবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। সেইসঙ্গে সরকার ও বর্তমান কমিশনের শেষ সময়ে এসে কারসাজিকারকদের সিন্ডিকেট আগে থেকেই সক্রিয় রয়েছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার মেয়াদের সব অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছে তারা। তাদের হীন চক্রান্তের বলি হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার প্রধান শেয়ারবাজারের সূচক হারিয়েছে প্রায় ৭২ পয়েন্ট। বেড়েছে বিনিয়োগকারীদের রক্তক্ষরণ। 
চার বছর আগে করোনাভাইরাসের আতঙ্কে শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দায়িত্ব নিয়ে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয় শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম নেতৃত্বাধীন কমিশন। এতে মন্দার শেয়ারবাজারে ধীরে ধীরে গতি ফিরে আসে। অতিমারির সময়ে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে কমিশন বিনিয়োগকারীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিল।

সেই কমিশনের মেয়াদের শেষ দিকে এসে কঠিন চাপের মুখে পড়েছে শেয়ারবাজার। যদিও  বর্তমানে এভাবে ধারাবাহিক পতনের কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু তার পরও বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারানো থামছে না। বরং দিন যত যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের রক্তক্ষরণ তত বাড়ছে। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপরও ক্ষোভ বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শুরুতে সুবিধা নিলেও বর্তমানে বড় ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশ বর্তমান কমিশনের বিপক্ষে রয়েছে। তারা চান না এই কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হোক। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই অংশ বাজারে নিষ্ক্রিয় রয়েছে। শুধু নিষ্ক্রিয় থাকাই নয়, বিভিন্ন সময়ে নানা রকম গুজব রটিয়ে বিনিয়োগাকারীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে বাজারে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে এবং দরপতন হচ্ছে। এর সঙ্গে ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যাওয়া শেয়ারবাজারের জন্য নেতিবাচক হয়ে এসেছে। সবকিছু মিলিয়েই বাজারে দরপতন চলছে।
শেয়ারবাজারে সূচকের ওঠানামা  স্বাভাবিক হলেও বর্তমানের দরপতনকে ‘অস্বাভাবিক’ বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাজারে দরপতনের পেছনে কয়েকটি কারণ কাজ করছে। তবে সেসব কারণে বাজারে যে হারে দরপতন হওয়ার কথা, প্রকৃতপক্ষে দরপতনের মাত্রা তার থেকে বেশি। এখন বাজারে যে হারে দরপতন হচ্ছে তার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই।

জানা গেছে, ২০২০ সালের শুরুর দিকে অতিমারি করোনাভাইরাসের হানার ফলে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধস নামলে লেনদেন বন্ধ করে দেন বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। এমন পরিস্থিতিতে একই বছরের মে মাসে বিএসইসি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন আরও তিনজন। বিএসইসির দায়িত্ব নিয়ে নতুন কমিশন টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকা শেয়ারবাজারে আবার লেনদেন চালু করেন ওই বছরের ৩১ মে।
প্রথমবারের মতো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা লেনদেন চালু করার পাশাপাশি অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দেয় শিবলী কমিশন। অনিয়মে জড়িত থাকায় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়। সতর্ক করা হয় সরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-কে। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসকে জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়।

পরবর্তীকালে আইসিবি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাতিল করা হয় এক ডজন দুর্বল কোম্পানির আইপিও। পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে রোড শোর আয়োজন, ওটিসির মার্কেটের কোম্পানিগুলোতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে মূল মার্কেটে ফেরানো, স্বল্প মূলধনী কোম্পানিগুলোকে নিয়ে আলাদা বোর্ড গঠন ও প্রথমবারের মতো কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান কমিশন।
এই ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের প্রশংসা কুড়ান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে শেয়ারবাজারেও। করোনা মহামারির মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ায় শেয়ারবাজার। ৫০ কোটি টাকার ঘরে নেমে যাওয়া লেনদেন হু হু করে বেড়ে হাজার কোটিতে উঠে যায়। লেনদেন বাড়তে বাড়তে আড়াই  হাজার কোটিতে পৌঁছায়।  এর পর থেকে ডলার সংকটসহ নানা কারণে শেয়ারবাজার চাপে পড়ে যায়।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে দরপতনের পেছনে কয়েকটি কারণ কাজ করছে। তবে সেসব কারণে বাজারে যে হারে দরপতন হওয়ার কথা, প্রকৃতপক্ষে দরপতনের মাত্রা তার থেকে বেশি। এখন বাজারে যে হারে দরপতন হচ্ছে তার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই।
এরপর মাঝে কয়েক দফায় উত্থান-পতন চললেও বর্তমানে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা পতনের মধ্যে রয়েছে শেয়ারবাজার। চার বছরের জন্য দায়িত্ব পাওয়া শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম এবং তিন কমিশনারের মেয়াদ প্রথম দফায় শেষ হচ্ছে আগামী মে মাসে। নতুন করে তাদের নিয়োগ নবায়ন করা হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট হয়নি।
চেয়ারম্যান ও তিন কমিশনারের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে শেয়ারবাজারে টানা দরপতন হওয়ার পেছনে কোনো বিশেষ চক্রের হাত থাকতে পারে বলে মনে করছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ। এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, বর্তমান কমিশনের আমলে কোনো কোনো বড় বিনিয়োগকারী বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন। বড় অনিয়ম করার পরও তাদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আবার কিছু বিনিয়োগকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এসব কারণে স্বাভাবিকভাবেই একটি অংশ কমিশনের বিপক্ষে রয়েছে। তারা চান না এই কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হোক। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই অংশ বাজারে নিষ্ক্রিয় রয়েছে। ফলে বাজারে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে এবং দরপতন হচ্ছে। এর সঙ্গে ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যাওয়া শেয়ারবাজারের জন্য নেতিবাচক হয়ে এসেছে। সবকিছু মিলিয়েই বাজারে দরপতন চলছে।
সর্বশেষ জেড ক্যাটাগরি নিয়ে শেয়ারবাজারে কিছুটা টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। কীসের ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেড গ্রুপে যাবে, সে বিষয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি নির্দেশনা জারি করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। ওই নির্দেশনার শেষ পয়েন্টে বলা হয়- ইস্যুয়ার কোম্পানির পরবর্তী লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণা অথবা বার্ষিক/অন্তর্বতী লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণার দিন থেকে এ নির্দেশনা কার্যকর হবে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন নির্দেশনা থাকলেও ডিএসই থেকে হুট করে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২২ কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ঘোষণা আসে নতুন করে আর কোনো কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নেওয়া হবে না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি কোম্পানিকে এই গ্রুপে নেওয়া হয়। এভাবে কিছু কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নেওয়ার পর থেকেই শেয়ারবাজার দরপতনের মধ্যে পড়ে। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা এই দরপতনে এরই মধ্যে ডিএসইর বাজার মূলধন থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকার ওপরে নেই হয়ে গেছে। আর এসময়ে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে ৬১৩ পয়েন্ট।
ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (সিএমএসএফ) থেকে পুঁজিবাজার মধ্যস্থতাকারীদের ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেই অর্থ এখনো ছাড় হয়নি। এই অর্থ যেন দ্রুত ছাড় করা হয়, কমিশন সে চেষ্টা করছে। পাশাপাশি বাজার উন্নয়নে সব পক্ষের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এই দরপতনের কারণ হিসেবে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, শেয়ারবাজারে মন্দার জন্য অনেক কারণ থাকতে পারে। এর একটা কারণ হলো বাজারের প্রতি অনাস্থা। অনেক বিনিয়োগকারীর কোটি কোটি টাকা দেড় বছর ধরে আটকে ছিল। তাদের মধ্যে একটা অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে বিনিয়োগে আবার টাকা আটকে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ অবস্থায় বিদেশী বিনিয়োগ হবে না, কারণ বিদেশীরা বুঝে গেছে এদেশে বিনিয়োগ করলে টাকা আটকে যায়। দেশীয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে অনাস্থা। তিনি বলেন, বাজারে গত দেড় বছর ধরে ম্যানুপুলেশন (কারসাজি) হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। বাজারের ডিসিপ্লিন (শৃঙ্খলা) ভেঙে গেছে। অনেককে ফেবার করা হচ্ছে, অনেককে নানা ধরনের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এতে বাজারে সবার জন্য একই নিয়ম অনেক ক্ষেত্রেই বলবৎ থাকছে না।

বাজারে সুশৃঙ্খল অবস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ‘তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি যে লভ্যাংশ দেয় শেয়ারের দাম হিসেবে তার নেট রিটার্ন ৩-৪ শতাংশ। সেখানে ব্যাংকের সুদের হার ১০-১২ শতাংশ। সুতরাং শেয়ারবাজারে মন্দার জন্য এটা অবশ্যই একটা কারণ। তবে আমার মনে হয় প্রধান কারণ সুশাসন ও স্বচ্ছতার অভাব।
শেয়ারবাজারে চলমান মন্দা পরিস্থিতির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, এটা আমরাও বোঝার চেষ্টা করছি, এরকম তো হওয়ার কথা নয়। কারণ, এখন বাজারে তো তেমন কোনো নিউজ নেই, তারপরও হচ্ছে দরপতন।

×