গতকাল ছিল ৭ নবেম্বর। ৩ নবেম্বর গেল কয়দিন আগে। দুটো দিনই বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কময় দিবস হিসেবে চিহ্নিত। ৭ নবেম্বর মুক্তিযোদ্ধা হত্যা আর ৩ নবেম্বর চার জাতীয় নেতা হত্যা দিবস। এই কলঙ্ক কোনদিন ঘুচবে না। ইতিহাসের অংশ হিসেবে অনন্তকাল থাকবে। কিন্তু জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার জায়গা হলো- যারা যে উদ্দেশ্যে এই বর্বর নৃশংস হত্যাকা- চালিয়েছিল তাদের সেই জিঘাংসা যাত্রা এখনও আমরা থামাতে পারিনি। ফলে সেই একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, সেই একই গোষ্ঠী একের পর এক রাষ্ট্রের ওপর আঘাত করে যাচ্ছে। ২২ অক্টোবর মিরপুরে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন পুলিশ সদস্য এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা। কদিন না যেতেই আবার ৪ নবেম্বর সাভারের নন্দন পার্কের কাছে একটি চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য মুকুলকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যা থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের ওপর কেন আক্রমণ সে বিষয়ে গত সপ্তাহে লিখেছি। যার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। আর ঠিক এই সময়ে বিদেশীদের ওপর আক্রমণের একটা ভিন্ন প্রেক্ষাপট আছে। সে সম্পর্কেও আগের লেখায় আলোচনা করেছি। আজ যে কথাটি জোরের সঙ্গে বলতে চাই তাহলো- পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে যে কারণে জাতির পিতা এবং ৩ নবেম্বর জেলের ভেতরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে সেই একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রগতিশীল, আধুনিকমনা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের ওপর এখনও একের পর এক আক্রমণ হচ্ছে। এই হত্যাকা- কারা ঘটাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য বোঝার জন্য পঁচাত্তরের ৩ নবেম্বর জেলের ভেতরে চার জাতীয় নেতার হত্যাকা-ের প্রেক্ষাপট ও তার বিচার-বিশ্লেষণ উপলব্ধি করা দরকার। যদিও কিছু কথার পুনরাবৃত্তি হবে, তবুও হত্যাকারীদের উদ্দেশ্যের ধারাবাহিকতা বোঝার জন্য সেগুলো পুনরায় উল্লেখ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভ ও শক্তিকে শেষ করার জন্য পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। যদি শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করা তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হতো তাহলে বন্দী অবস্থায় জেলের অভ্যন্তরে চার নেতাকে হত্যা করা প্রয়োজন হলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা অনেকেই হয়ত জানি। কিন্তু চলমান রক্তক্ষরণ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এবং বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে এই প্রশ্নের উত্তর নিষ্কণ্টকভাবে উপলব্ধি করতে হবে। পঁচাত্তরের পর সামরিক শক্তির বলে রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রের পরিবর্তন যারা করেছে তারাই বিকৃত তথ্যে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। বিকৃত ও অসত্য তথ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গন এখনও ভরপুর। উদ্দেশ্যমূলকভাবে জেনেশুনে সত্যের সঙ্গে মিথ্যাকে মিশ্রিত করা হয়েছে। সত্য উদ্ঘাটন করার জন্য শুধু সামনের হত্যাকারীদের দিকে তাকালে হবে না। নেপথ্যের শক্তিকে চিনতে হবে। জানতে হবে পঁচাত্তরের হত্যাকারীদের বর্তমান পরিচয় কি? রাজনৈতিকভাবে তারা এখন কোথায় অবস্থান করছে? কোন্ বিদেশী শক্তি এখনও তাদের সহযোগী এবং কেন? তাই লেখার এই পর্যায়ে ফিরে যাই পঁচাত্তরে।
১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর ভোর হতেই ১৫ আগস্টের খুনীদের বিরুদ্ধে রক্তপাতহীন ও নীরব সেনা অভ্যুত্থান সম্পন্ন হয়ে যায়। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন চীফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম এবং অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন খন্দকার মোশতাক ও খুনীদের গদি টলটলায়মান হয়ে ওঠে, তখন তারা রাষ্ট্রের সবচাইতে নিরাপদ স্থানে হত্যা করে বরেণ্য জাতীয় চার নেতাকে। পলায়নের পূর্বে খুনীরা তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রের ইঙ্গিতে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল যাতে বাংলাদেশ আর কখনও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় ফিরে না আসে। ২ নবেম্বর রাতে খালেদ মোশাররফের ক্যু শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রিসালদার মোসলেউদ্দিন সেনানিবাস থেকে ঘাতকদল নিয়ে জেলখানায় হাজির হয়। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত সাংবাদিক মাসকারেনহ্যাসের লিখিত ‘বাংলাদেশ, এ্যা লেগ্যাসি অব ব্লাড’ বইয়ের ৯২ পৃষ্ঠায় বর্ণনা পাওয়া যায় জেলখানায় ওই দিন চার জাতীয় নেতাকে কিভাবে হত্যা করা হয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে খুনী মোসলেউদ্দিন ও তার দল ওই রাতে জেলখানায় প্রবেশ করলে বঙ্গভবন থেকে ১৫ আগস্টের খুনী মেজরদের একজন মেজর রশিদ টেলিফোনে ডিআইজি প্রিজনকে নির্দেশ দেন মোসলেউদ্দিনকে যেন কোন রকম বাধা না দেয়া হয়। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এমন নজিরবিহীন ভয়ঙ্কর নির্দেশ শুনে ডিআইজি প্রিজন হতভম্ব হয়ে সরাসরি বঙ্গভবনে টেলিফোন করেন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাককে। খন্দকার মোশতাকের কাছ থেকে একই রকম হুকুম শুনে ডিআইজি অসহায় হয়ে সবকিছু নিয়তির ওপর ছেড়ে দেন। এভাবেই বাঙালী জাতি ও ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের মাটিকে কলঙ্কিত করা হলো দ্বিতীয়বারের মতো, মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানে।
জেল হত্যাকা-কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষকগণ তুলনা করেছেন একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে। যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের একান্ত সহযোগী জামায়াত বুঝতে পারল যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না তখন তারা সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে হত্যা করেছিল, যাতে স্বাধীন বাংলাদেশ সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। ঠিক একইভাবে ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বরে খুনীরা হয়ত অনুমান করেছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে তাদের সাধিত প্রতিবিপ্লব ব্যর্থ হতে চলেছে, তখন তারা জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা করে, যাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন যেন পুনরায় বাংলাদেশে আর ফিরতে না পারে। পঁচাত্তরের পর ইতোমধ্যে ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। এই ৪০ বছরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত ঘটনাবলীর দৃশ্যমান প্রভাব এবং পরিণতি রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে আমরা দেখে আসছি। আবার যথার্থ প্রমাণাদির অভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা এখনও হয়নি। তবে যে সত্যটি এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাহলো ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যা, ৩ নবেম্বর জেল হত্যা ও ৭ নবেম্বর হত্যাকা-ের সবই ছিল একই সুতায় গাঁথা। ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা মুক্তিযুদ্ধের সকল চেতনাকে বিদায় করে পাকিস্তানের চেতনা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। তাজউদ্দীন ছিলেন একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি, যিনি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আপোসহীনভাবে এগিয়ে নিতে পারতেন। শত্রুরা সেটি ঠিকই বুঝেছিল। তাই দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর সরকারে তখন তাজউদ্দীন ছিলেন না, বাকশালের গুরুত্বপূর্ণ কোন পদেও তিনি ছিলেন না। তবুও অন্য তিন নেতার সঙ্গে তাকে হত্যা করা হলো। এতেই বোঝা যায় শত্রুদের পরিকল্পনার উদ্দেশ্য কি ছিল। এ সবের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালীর দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সবকিছুকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশকে হয় পাকিস্তানের সঙ্গে একটা কনফেডারেশনে নিয়ে আসা অথবা রাষ্ট্রের সকল অঙ্গনে পরিত্যক্ত পাকিস্তানী চিন্তা-চেতনা ও মনস্তাত্ত্বিকতা পুনরায় ফিরিয়ে আনা। পঁচাত্তরের অব্যবহিত পরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহী দুই সামরিক শাসক কর্তৃক উল্লিখিত উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য সংবিধানকে অবৈধ পন্থায় যেভাবে কাটাছেঁড়া করা হয়েছিল, তা এরই মধ্যে মহামান্য আদালত দ্বারা বাতিল ঘোষণার ভেতরে উপরোক্ত কথার সত্যতা পাওয়া যায়। কিন্তু পঁচাত্তরের পর যারা মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের পরিবর্তে সাতচল্লিশের চেতনায় ও পাকিস্তানের মনস্তাত্ত্বিকতায় বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল তারা কখনও বসে ছিল না, এখনও বসে নেই। পঁচাত্তরের পর তারা একনাগাড়ে ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল। তারপর ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ওই পক্ষের প্রধান প্রবক্তা জামায়াত বিএনপির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যার ফলে ভয়াবহ সশস্ত্র জঙ্গীদের উত্থান হয়। প্রগতি, আধুনিকতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল এবং মানুষের ওপর তারা বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। রাজনৈতিক পন্থা বা বৈধ কৌশলে নয়, দ্রুততম সময়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যত হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা তার প্রমাণ। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসার পর তাদের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। বরং তাদের যমযাত্রা অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জার্নিতে অন্যতম কাজ যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয় ২০১০ সালে, জনগণের ম্যান্ডেটের ওপর ভিত্তি করে। সেই থেকে জামায়াত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে নেমেছে। ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি শাপলা চত্বরের সমাবেশে তারা ঘোষণা দেয় নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীর কিছু হলে সারাদেশে আগুন জ্বলবে, গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। সেই চেষ্টা তারা অব্যাহতভাবে করে যাচ্ছে। বিএনপির অন্যতম বড় মিত্রপক্ষ জামায়াত। সুতরাং কখনও প্রত্যক্ষভাবে, আবার কখনও পরোক্ষভাবে জামায়াতের এই যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে বিএনপি। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আকিন গাম্প নামক লবিস্ট ফার্মকে বিএনপি নিয়োগ দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে কাজ করার জন্য। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত-শিবির কর্তৃক জাতীয় পতাকা পোড়ানো ও শহীদ মিনার ভাঙ্গার দৃশ্য দেখার পরও বিএনপি তখন জামায়াতের পক্ষে মাঠে নামে। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের ১৩ দফায় বিএনপি সরাসরি সমর্থন দেয়। সুতরাং চলমান হত্যাযজ্ঞ এবং রাষ্ট্র ও সংবিধানবিরোধী কর্মকা-ের একমাত্র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঠেকিয়ে রাখা। এখন তাদের ইমেডিয়েট লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা তারা শুরু করেছে পঁচাত্তরে। সে চেষ্টা তারা এখনও করে যাচ্ছে অব্যাহতভাবে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পিতভাবে পুলিশ এবং প্রগতিশীল, আধুনিকমনা ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশী মানুষকে হত্যা করছে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে শুভবুদ্ধির জয় হবে, যেমনটি হয়েছিল একাত্তরে।
লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক