ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঘটছে দুর্ঘটনা

ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে সন্দ্বীপ ও হাতিয়া চ্যানেল

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ২১ মে ২০২২

ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে সন্দ্বীপ ও হাতিয়া চ্যানেল

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ জলপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে সন্দ্বীপ-হাতিয়া চ্যানেল ও সন্নিহিত জলসীমা। প্রতি বছরই দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে পণ্যবোঝাই লাইটার জাহাজ। সর্বশেষ প্রায় সাত কোটি টাকার গম নিয়ে ডুবেছে একটি জাহাজ। তলদেশের গভীরতায় তারতম্য এবং পর্যাপ্তসংখ্যক পাইলট না থাকায় এই অবস্থা বলে জানাচ্ছেন জাহাজ পরিচালনা ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। দুই সহস্রাধিক জাহাজের জন্য পাইলট মাত্র ৪০ জন। নিরাপদে নৌযান চলাচল নিশ্চিত করার জন্য পাইলট সংখ্যা আরও বাড়াবার দাবি দীর্ঘদিনের। বঙ্গোপসাগরে রামগতির কাছাকাছি এলাকায় এমভি তামিম নামের একটি লাইটার জাহাজ গত বুধবার দুপুরে ডুবে যায়। জাহাজটি চট্টগ্রাম থেকে কাঁচপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। এতে ছিল ১ হাজার ৬শ মেট্রিক টন গম চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙ্গরে থাকা জাহাজ এমভি প্রোফেল গ্রিজ থেকে এ গম নেয়া হয়েছিল। বঙ্গোপসাগরের ভাসানচরের কাছে গিয়ে এটি ডুবে যায়। তলদেশে কোন শক্ত মাটি বা বস্তুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে এটি ডুবে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। লাইটার জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশীদ জনকণ্ঠকে জানান, ধাক্কা খেয়ে প্রথমে এটি কাত হয়ে যায়। এতে হ্যাচের একাংশের গম নষ্ট হয়। এরপর জোয়ারের ফলে অপর অংশও ডুবে যায়। বৃহস্পতিবার গম ও জাহাজের মালিক পক্ষ দুর্ঘটনাস্থল সরেজমিনে পরিদর্শন করে। সেখানে আরেকটি লাইটার জাহাজ অপেক্ষমাণ রয়েছে। জাহাজটিকে সরিয়ে নিয়ে কিছু পণ্য উদ্ধার করা যায় কিনা সে চেষ্টা চলছে। জাহাজ মালিকদের প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, সন্দ্বীপ চ্যানেল ও সন্নিহিত সাগর জলসীমায় জাহাজ চলাচলে ঝুঁকি অনেক। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ জলপথে পণ্য নেয়ার ক্ষেত্রে অনেকটুকু পথ আড়াআড়ি পাড়ি দিতে হয়। এতে করে ওপর থেকে নেমে আসা স্রোত এবং সাগরের জোয়ার ওই জাহাজটিকে পাশ থেকে ধাক্কা দেয়। সোজা চলাচলে সাধারণত ঝুঁকি কম থাকে। কিন্তু যে কোন একপাশ থেকে ধাক্কা খেলে তা সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে দুর্বল জাহাজগুলোর দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার শঙ্কা থাকে। সবচেয়ে বড় সমস্যা এই আড়াআড়ি পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোন পথ নেই। সাগরের নিচে মাটি কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। এক্ষেত্রে জাহাজগুলোকে অবস্থা বুঝে খুবই সতর্কতার সঙ্গে চলতে হয়। কখনও বা তলদেশ মাটি স্পর্শ করে গেলে জাহাজ উল্টে বা কাত হয়ে যায়। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। ডব্লিউটিসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, পাইলট সমস্যা এখন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। ছোট লাইটারগুলো চালিয়ে থাকেন মাস্টাররা। দক্ষ মাস্টারের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। আর অপেক্ষাকৃত বড় লাইটার জাহাজগুলো চালানোর জন্য প্রয়োজন পাইলট। কিন্তু সেই পাইলট প্রয়োজনের তুলনায় শুধু কমই নয়, নেই বললেই চলে। বন্দর বহির্নোঙ্গরের মাদারভেসেল থেকে পণ্য নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির মালিকানাধীন জাহাজসহ মোট চলাচলকারী জাহাজের সংখ্যা ২২শ থেকে ২৩শ। কিন্তু পাইলট আছেন মাত্র ৪০ জন। এতে করে প্রয়োজন অনুযায়ী পাইলট সরবরাহ করতে পারে না অভ্যন্তরীণ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। এছাড়া একজন পাইলট পেতে গেলে নিয়ম বহির্ভূত অনেক বাড়তি খরচের ব্যাপার রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে জাহাজ মালিকদের পক্ষ থেকে। চট্টগ্রাম বন্দরে আসা কন্টেনার ভর্তি আমদানির পণ্যগুলো জেটিতে খালাস হয়ে সড়ক বা রেলপথে পরিবাহিত হলেও বহির্নোঙ্গরে আনলোড হওয়া কার্গো অর্থাৎ খোলা পণ্যগুলোর বেশিরভাগই পরিবাহিত হয় জলপথে। লাইটার জাহাজগুলো এ পণ্য পরিবহন করে থাকে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টর হওয়া সত্ত্বে¡ও নিরাপদে জাহাজ চলাচল নিশ্চিত করতে সরকারী দায়িত্বশীল সংস্থা ব্যর্থ, এ অভিযোগ অনেক পুরনো। সন্দ্বীপ চ্যানেল তো দুর্ঘটনার জন্য বিশেষায়িত হয়ে আছে। অনেকটা নিয়মিত বিরতিতেই ডুবছে নৌযান। যাত্রীবাহী নৌযানডুবিতে মরছে মানুষ আর লাইটার জাহাজডুবিতে তলিয়ে যাচ্ছে অতি মূল্যবান আমদানির পণ্য। প্রতিবছরে অন্তত কয়েকটি করে জাহাজডুবি হচ্ছে। এতে সাধারণত থাকে গম, ভুট্টা, সিমেন্ট ক্লিংকারসহ আমদানির বিভিন্ন পণ্য। এবার এমন সময়ে ১৬শ মেট্রিক টন গম নিয়ে একটি জাহাজ নিমজ্জিত হল, যখন ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের সঙ্কটের আলামত সুস্পষ্ট। নৌযান চলাচলের পথ নিরাপদ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর প্রতি চেয়ে আছেন অভ্যন্তরীণ শিপিং সেক্টরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
×