ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এরা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের বিরোধী

হেফাজত তালেবানী রাষ্ট্র কায়েম করতে চেয়েছিল

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ৪ মে ২০২১

হেফাজত তালেবানী রাষ্ট্র কায়েম করতে চেয়েছিল

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ হেফাজতে ইসলাম দেশজুড়ে এখন নিন্দিত একটি সংগঠনের নাম। দেশজুড়ে সম্প্রতি পরিকল্পিতভাবে যে নাশকতা চালিয়েছে তা প্রমাণ করে এরা শুধু স্বাধীনতার মূল চেতনা নয়, এই রাষ্ট্রেরই বিরোধী। তারা অসাম্প্রদায়িক এ রাষ্ট্রকে তালেবানী রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গিয়েছিল। বিলম্বে হলেও সরকার যখন এদের বিষয়ে আসল জায়গায় হাত দিয়েছে, তখন একে একে থলের সব বিড়াল বেরিয়ে আসছে। খোলাসা হয়ে যাচ্ছে এরা এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিরই প্রেতাত্মা। এ পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া হেফাজত নেতাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকটি সংস্থার পৃথক পৃথক জিজ্ঞাসাবাদে এমন সব অজানা ও বিস্ময়কর এবং ভয়ঙ্কর তথ্য বেরিয়ে আসছে। কিছু জিজ্ঞাসাবাদকারীরা প্রকাশ করছে, আর কিছু রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এখনও প্রচারে আনা হচ্ছে না। ষড়যন্ত্রকারী প্রত্যেককে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার পর যা বেরিয়ে আসবে তা হয়তো হবে বিস্ময়েরও বিস্ময়। গত ২৬-২৮ মার্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং এর আগে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরের ঘটনার নেপথ্য কাহিনী গ্রেফতার হওয়া হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মুখ থেকেই অনায়াসেই বেরিয়ে আসছে। এরা সরকার গঠনেরও স্বপ্ন দেখেছিল। কে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেবেন, সে রূপরেখাও প্রণয়ন করেছিল। কী ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। কোন রাজনৈতিক দলও নয়, অথচ হেফাজতীরা এমন পরিকল্পনা কিভাবে করে, কাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনে এরা মাঠে নেমেছিল, এখনতো সবই পরিষ্কার হচ্ছে গ্রেফতারকৃত হেফাজত নেতাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের পর। তারা অসাম্প্রদায়িক এই রাষ্ট্র চায় না, চায় তালেবানী স্টাইলের রাষ্ট্র। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, যার জন্ম হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতা নিয়ে। সংগঠনটি ব্যাপক আলোচনায় আসে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনকারী তরুণদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে হুঙ্কার এবং মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ ও ব্যাপক তা-বের মধ্য দিয়ে। নামে ইসলামের হেফাজতকারী মনে হলেও নারী প্রগতির বিরোধিতা, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দেশের বিভিন্ন জেলায় সহিংস কর্মকা-, জ্বালাও-পোড়াও, সরকারী অফিসে অগ্নিসংযোগ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভাংচুর, সম্পদের ক্ষতিসাধনসহ নানা ধ্বংসাত্মক তৎপরতার প্রমাণিত যে, এটি মূলত একটি রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্ম নেয়া এই সংগঠন দ্রুত সম্প্রসারিত হয় সারাদেশে। প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফী। মূলত এটি একটি কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন। কওমি শিক্ষার্থীরাই এর মূল শক্তি। শক্ত জনভিত্তি বলতে যা বোঝায়, তা তাদের নেই। তবে মাদ্রাসাভিত্তিক হওয়ার সুবিধা হলো, তারা যখন তখন একটি মিছিল বা সমাবেশ করে সক্রিয় উপস্থিতির জানান দিতে পারে। তাদের শক্তি কওমি মাদ্রাসা। ফলে কোন কারণে মাদ্রাসায় লম্বা ছুটি বা বন্ধ ঘোষিত হলে দলটি শক্তিহীন হয়ে পড়ে। সেজন্য করোনা মহামারীতে দেশের অন্য সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও চালু রাখা হয় নিজেদের পরিচালিত মাদ্রাসাগুলো। কারণ তারা ভাল করে জানেন, মাদ্রাসা বন্ধ করলে ছাত্ররা সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে। ফলে শক্তি প্রদর্শন সম্ভব হবে না। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কাছ থেকে সাহায্যনির্ভর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ও কমে যাবে। মিছিল-সমাবেশে গর্জন বেশি হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা দেশের মোট সংখ্যার মধ্যে তেমন উল্লেখ করার মত পারসেন্টেজে পড়ে না। রাজনৈতিক নেতৃত্বে কথিত অরাজনৈতিক সংগঠন ॥ অরাজনৈতিক দাবি করলেও হেফাজতে ইসলাম রাজনৈতিক নেতাদের পরিচালিত সংগঠন। সম্প্রতি বিলুপ্ত ঘোষিত হেফাজতে ইসলামের ১৫১ সদস্য কেন্দ্রীয় কমিটির ৮৫ জনই ছিল বিভিন্ন উগ্রবাদী ধর্মীয় সংগঠনের নেতা, যে সংগঠনগুলো বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় দলের শরীক দল। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অন্তত ৪ জন প্রার্থী জোটের মনোনয়নে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনও করেছেন। সুতরাং রাজনীতির যোগসূত্র যে অত্যন্ত নিবিড় তা গবেষণা করে প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না। তাই হেফাজতের ভেতরে অন্যরা ঢুকে গিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, এমন অভিযোগও ধোপে টিকে না। হেফাজতের আত্মপ্রকাশ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতা নিয়ে। তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০০৯-এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। একেবারে শুরুতেই তাদের টার্গেট জানান দিয়েছে, দলটি উগ্রসাম্প্রদায়িক এবং নারী প্রগতির বিরুদ্ধে। এরপর হেফাজতের অবস্থানগত চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ২০১৩ সালে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে যখন গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে তরুণরা স্লোগানমুখর, তখনই এই হেফাজতের গাত্রদাহ শুরু হয়। তরুণদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে সক্রিয় হয় প্রতিক্রিয়াশীল হেফাজতে ইসলাম। নাস্তিক আখ্যা দেয়া মূলত একটি অজুহাত মাত্র। কারণ, শাহবাগে জমায়েত ছিল লাখ লাখ তরুণের। একই দাবিতে সারাদেশেই গঠিত হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। তাহলে প্রশ্নÑ বাংলাদেশে কি এত নাস্তিক ছিল বা আছে? এটা মূলত দলটি স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থান। শাপলা চত্বরের সমাবেশ ছিল স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানেরই প্রকাশ। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে সমাবেশ থেকে তুলে ধরা হয় ১৩ দফা দাবি, যা প্রায় সবগুলোই বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটির জন্ম, সংবিধান ও মৌল চেতনাবিরোধী। মতিঝিলে সমবেতরা সেদিন ব্যাপক তা-ব চালায়। ভেঙ্গে ফেলে রোড ডিভাইডার, ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কেটে ফেলা গাছ-গাছালি এবং পুড়িয়ে দেয় অসংখ্য স্থাপনা। হেফাজত এমন কোন বড় সংগঠন নয় যে, তারা এককভাবে এত বড় সমাগম ঘটাতে পারে। ওটা ছিল আসলে হেফাজতের ব্যানারে একইসঙ্গে অন্যদেরও সমাবেশ। তখন ছিল তৎকালীন সরকারের ক্ষমতার মেয়াদে শেষ সময়। সরকার পতনের দাবিতে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধীদলগুলো ছিল আন্দোলনে। তারাও মাঠে নেমেছিল হেফাজতের ব্যানারে। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তার সমর্থকদের প্রতি পরিষ্কারভাবে আহ্বান জানিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের পক্ষে দাঁড়াতে। পরদিন সকাল থেকে একসঙ্গে অবস্থান কর্মসূচী ছিল ২০ দলীয় জোটেরও। শুধু তাই নয়, শাপলা চত্বরে লাগাতার অবস্থানের পরিকল্পনা ছিল হেফাজতে ইসলামের। অনেকটা চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল সরকারের পতনের পর কীভাবে হবে ক্ষমতার ভাগাভাগি। ঠিক হয়ে গিয়েছিল কে হবেন রাষ্ট্রপতি, কে হবেন প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভায় কারা থাকবেন। কিন্তু সেদিন সরকারের দৃঢ়তায় রাতের মধ্যেই তারা শাপলা চত্বর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। হোঁচটের পর পুনরুত্থান ॥ শাপলা চত্বর থেকে বিতাড়িত হবার পর হেফাজতে ইসলামের কর্মী ও সমর্থকরা এক প্রকার গর্তে ঢুকে যায়। অনেকটা লজ্জায় মুখ ঢাকার মতো অবস্থা। হয়তো বা কুড়ি বছরেও তারা আর সক্রিয় হতো না। কিন্তু সরকারের বদান্যতায় সেই হেফাজত আবার ওঠে আসে রাজনীতির দৃশ্যপটে। সরকার কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদ দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স ডিগ্রীর সমমানের হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে ফের ফণা তোলে এই সংগঠনটি। প্রশাসন কেন যে হেফাজতে ইসলামের প্রতি এমন নমনীয়তা বা সহানুভূতিশীল হয়েছিল, সেই রহস্য এখনও স্পষ্ট নয়। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়েও এই দলটির মনরক্ষা করতে হয়েছে সরকারকে। দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়েও হেফাজতের সঙ্গে আলোচনা বা সমঝোতা করতে হয়, এই যেন এক মহা বিস্ময়কর ঘটনা। আলোচিত হেফাজতে ইসলাম তার চেহারার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটায় ২০২১ সালের মার্চ মাসে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী একটি সার্বভৌম দেশের মাইলফলক। স্বাভাবিক কারণেই এই উপলক্ষে ব্যাপক আয়োজন দেশে। বিষয়টি শুধুমাত্র সরকারের নয়, বরং পুরো জাতির। অনুষ্ঠানে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে আমন্ত্রিত হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সংগঠনটি মোদি ঠেকাবার নাম করে সহিংস হয়ে ওঠে। মাঠে নেমে তা-ব চালায় কয়েকদিন ধরে। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, ব্যক্তি হিসেবে নয়। অতি সাধারণ এই বিষয়টি বুঝতে না পারার ভান করে হেফাজতে ইসলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রধান সাহায্যকারী ভারত। তারা মূলত মাঠে নেমেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ সাহায্য প্রদানকারী সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, দেশের বামপন্থী দলগুলোও মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোর বিরুদ্ধে মিছিল করেছিল। কিন্তু এই দুই বিরোধিতার সুর একই ছিল না বলে প্রতীয়মান। বামেরা মোদির আগমনের বিরোধিতা করেছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে। আর হেফাজতে ইসলামের মোদিবিরোধী অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। এটা ছিল জঙ্গীবাদী স্টাইলে উদগ্র উল্লম্ফন। হেফাজত যে কারণে রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি ॥ বাংলাদেশ আন্দোলনের দেশ। এ দেশের যত অর্জন তার সবই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্রসহ নানা দাবিতে অনেক আন্দোলন হয়েছে। অনেক রক্তও ঝরেছে। তবে আন্দোলনের অতি পরিচিত একটা ধরন রয়েছে। মিছিল হয়েছে, মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়েছে বা উত্তেজিত আন্দোলনকারীরা পাথর মেরে ভবনের কাঁচ ভেঙ্গেছে অথবা উত্তেজনার মুহূর্তে কয়েকটি গাড়ি পোড়া গেছে। কিন্তু হেফাজতী কর্মকা- এদেশের দীর্ঘ সময়ের আন্দোলনের প্যাটার্নের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। মহাসড়ক কেটে দেয়া, সড়কের ওপর ৫ ফুট উচ্চতার দেয়াল নির্মাণ, ইলেকট্রিক করাত দিয়ে গাছ কেটে ফেলা, থানা আক্রমণ, সরকারী অফিস পুড়িয়ে দিয়ে মূল্যবান নথি ধ্বংস-এমন আন্দোলন অতীতে হয়নি। কিন্তু এমন ধ্বংসাত্মক আন্দোলন কেউ করেনি। হেফাজতের এহেন তৎপরতা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতোই। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান ঘিরে তিনদিন ধরে যে নাশকতা ও সহিংসতা হেফাজত চালিয়েছে তা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকা-ের পর্যায়ে পড়ে। তাদের আক্রমণ থেকে বাদ যায়নি জাতির জনকের ভাস্কর্য ও ম্যুরাল। প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার ছবি ভাংচুর করার বিষয়টিও হয়তো অনেকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেবেন। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের প্রতি এত ঘৃণা প্রদর্শনের অন্য অর্থ দাঁড়ায়। কারণ তিনি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছেন। রাষ্ট্রের স্থপতির বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ মহলটির কেন থাকতে পারে, এর উত্তর বের করতে বড় গবেষক হবার প্রয়োজন পড়ে না। তাছাড়া কওমি মাদ্রাসাগুলোতে ওড়ানো হয় না জাতীয় পতাকা, গাওয়া হয় না দেশের জাতীয় সঙ্গীত। এসব আচরণও রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল নয় কি? হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী সম্প্রতি বলেছেন তাদের নেতাদের বিধর্মী পুলিশ কর্মকর্তা দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ না করতে। এটা পরিষ্কার রাষ্ট্রবিরোধী কথা। কারণ, রাষ্ট্রের সংবিধানে এমন কোন নির্দেশনা নেই যে, মুসলিমদের অমুসলিম পুলিশ কর্মকর্তা দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না। অপরদিকে, কথিত ‘শিশুবক্তা’ রফিকুল ইসলাম মাদানী ওয়াজে ঔদ্ধত্য ভাষায় জানিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট মানেন না, প্রধানমন্ত্রী মানেন না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানেন নাÑযদি তারা যদি ইসলাম না মানেন। এটাও রাষ্ট্রবিরোধী আচরণ। কেননা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের একটি স্তম্ভ ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’। অমুসলিম হলে কেউ প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হতে পারবেন না, এমন বক্তব্য বাংলাদেশের সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থার স্পিরিটের বিরুদ্ধেই যায়। ওয়াজে ছড়ানো হয় হিংসার বিষবাষ্প ॥ হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামের সংগঠনটি যে অরাজনৈতিক নয়, তা এর মধ্যেই তারা নিজেরাই প্রমাণ দিয়েছে। সহিংস মতবাদ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে দলটি বেছে নিয়েছে ওয়াজ মাহফিল। সারাদেশে তারা এই মাহফিলের মাধ্যমেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছাড়াও নিজ ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধেও নানা ফতোয়ায় সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলছে। কৌশল হিসেবে তারা স্থানীয় এমপি, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, প্রশাসনের কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান এবং এলাকার সরকার দলীয় নেতাদের অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। অতিথিরা ওয়াজ মাহফিল উদ্বোধন করে দিয়ে চলে যান। এরপর সেই মঞ্চে রাত অবধি চলে সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই গালাগাল। শুধু তা-ই নয়, এ সকল মাহফিল আয়োজনে সরকার দলীয় নেতা ও বিত্তবান সমর্থকদের আর্থিক সহযোগিতা থাকে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ বলছেন, ধর্মের নামে হেফাজতে ইসলামের এসব রাজনৈতিক মাহফিলে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ হওয়া উচিত। দেশে কওমি শিক্ষার্থীর সংখ্যা আসলে কত ॥ কওমি মাদ্রাসাগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকির বাইরে। ফলে এ সকল মাদ্রাসায় কী পরিমাণ শিক্ষার্থী রয়েছে সেই সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। এখানে মাদ্রাসা পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন, তা-ই সঠিক ধরে নেয়া হচ্ছে। তারা বলছেন, ২৫ লাখ। আর সকলেই বিশ^াস করছেন তাদের কথাই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেশে এই পরিমাণ কওমি শিক্ষার্থী থাকা কি সম্ভব? কওমি মাদ্রাসায় যদি ২৫ লাখ শিক্ষার্থী থাকে তবে দেশের এতগুলো সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন স্কুল, এবতেদায়ি-আলিয়া মাদ্রাসা, মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়, মেডিক্যাল- ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ইংলিশ মিডিয়ামসহ ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কী পরিমাণ শিক্ষার্থী হতে পারে, সেই প্রশ্ন এসে যায়। ন্যাশনাল কারিকুলামের অধীনে এবতেদায়ি-আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বোর্ড বই অধ্যায়ন করে থাকে। তাহলে এই মাদ্রাসাকে কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। কওমি শিক্ষার্থী ২৫ লাখ হলে দেশে মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাই ২৫ কোটি হওয়ার কথা। অথচ বাংলাদেশের জনসংখ্যাই ১৭ কোটি। এরমধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ কোটির কিছু কম বা বেশি। কওমি শিক্ষার্থী যদি মোট শিক্ষার্থীর এক শতাংশ হয় তাহলে এ সংখ্যা হতে পারে বড়জোর ৫ লাখ, আর দুই শতাংশ হলে ১০ লাখ। পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান যে, কওমি শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই শতাংশের নিচে। মাদ্রাসা পরিচালকরা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়িয়ে তুলে ধরছেন সমীহ আদায় এবং বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে। এটা এক ধরনের জুজুর ভয়ও। অত্যধিক শিক্ষার্থী দেখিয়ে নানা ক্ষেত্র ও মহল থেকে বেশি অনুদান সংগ্রহ করার কৌশল। তাছাড়া মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে পরিমাণ এতিমখানার প্রচার রয়েছে, তত এতিম এদেশে কোথায়? বাবা-মা হারা এতিম হওয়া মানেই এতিমখানায় চলে যাওয়া নয়। কারণ তাদেরও অনেকের সচ্ছল পরিবার এবং চাচা-মামাসহ নিকট আত্মীয় অভিভাবক থাকেন। এছাড়া গরিব হলেই এতিমখানায় চলে যায় বা গরিবের জন্য মাদ্রাসা-এতিমখানা, এ ধারণা এখন আর সঠিক নয়। কেননা, এখন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয় বিনামূল্যের বই এবং উপবৃত্তি। এতিমখানার দোহাই দেয়া প্রকৃতপক্ষে বাড়তি সহানুভূতি আদায়ের প্রয়াস মাত্র। হেফাজতে ইসলাম নেতারা বিভিন্ন কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের আধুনিক শিক্ষা টার্গেট করে যতটা সোচ্চার, নিজেদের পরিচালিত মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকারসহ নানা ধরনের অপকর্মের বিষয়ে ততটাই নির্লিপ্ত। সংগঠনটি কখনই সাধারণ মানুষের দাবি নিয়ে মাঠে নামে না। দান খয়রাতনির্ভর এ দলের নেতারা ওয়াজ মাহফিলকে বেছে নিয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ উপার্জন এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারের মাধ্যম হিসেবে। দেশজুড়ে এক সময় যে সাংস্কৃতিক কর্মকা- পরিচালিত হতো তা এখন আর নেই। রাজনৈতিক নেতা ও সমাজের বিত্তবানরা এখন আর আগের মতো আবহমান বাঙালী সংস্কৃতির আয়োজনকে পৃষ্ঠপোষকতা দেন না বলেই প্রতীয়মান। ফলে মাঠে চলছে একতরফা প্রচার। বাঙালী জাতি ও স্বাধীন বাংলাদেশের মৌল চেতনাকে ধরে রাখতে সংস্কৃতির যে জাগরণ প্রয়োজন, সে বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে গেছে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা উচিত বলে মনে করছেন সমাজ গবেষকগণ।
×