ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দীর্ঘ ৭২ বছর পর খাজা নাজিম উদ্দিনের নাম বাদ

প্রকাশিত: ২৩:০০, ২২ জুলাই ২০২০

দীর্ঘ ৭২ বছর পর খাজা নাজিম উদ্দিনের নাম বাদ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ দীর্ঘ ৭২ বছর পর অবশেষে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত এই দেশে খাজা নাজিমউদ্দিনের নামে একটি কলেজের নাম পরিবর্তন হলো। পাকিস্তানীদের শাসক বাংলা ভাষা ও বাঙালীবিদ্বেষী খাজা নাজিমউদ্দিনের নামে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘মাদারীপুর সরকারী নাজিমউদ্দিন কলেজ’ এর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মঙ্গলবার ‘মাদারীপুর সরকারী কলেজ’ নামে আদেশ জারি করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। এর মধ্য দিয়ে মাদারীপুরবাসীসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসী দেশের অগণিত মানুষের সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা দাবি পূর্ণতা পেল। এদিকে সরকারী নাজিমউদ্দিন কলেজের নাম পরিবর্তনের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ায় খুশি এ দাবির সঙ্গে যুগের পর যুগ যারা সম্পৃক্ত ছিলেন। পদক্ষেপের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সীমাহীন কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসার কথা জানিয়েছেন নাম পরিবর্তনের এ আন্দোলনকে সফলতার মুখ দেখানো রাজনীতিবিদ মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান এমপি। তিনি জনকণ্ঠকে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলছিলেন, পাকিস্তানীদের শাসক বাংলা ভাষা ও বাঙালীবিদ্বেষী খাজা নাজিমউদ্দিনের নামে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘মাদারীপুর সরকারী নাজিমউদ্দিন কলেজ’-এর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এটা কেবল মাদারীপুরবাসীর নয়, এটা পুরো বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ^াসী প্রতিটি মানুষের খুশির খবর। আজ অত্যন্ত ভাল লাগছে। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ ও ভালবাসা জানাচ্ছি। এত বছর পরে হলেও এটা সম্ভব হয়েছে জাতির জনকের কন্যার হাত ধরেই। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ স্বাক্ষরিত ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এক আদেশে বলা হয়েছে, ‘২০২০-২০২১ শিক্ষা বর্ষ থেকে ‘সরকারী নাজিমউদ্দিন কলেজ’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘ ‘মাদারীপুর সরকারী কলেজ, মাদারীপুর’ করা হলো। কলেজ পরিদর্শক জনকণ্ঠকে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা নাম পরিবর্তনের আদেশ জারি করলাম। মঙ্গলবার থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে এ আদেশ কার্যকর হলো। জানা গেছে, এই কলেজটির নাম পরিবর্তন নিয়ে গত কয়েক দশক মাদারীপুর ছাড়াও দেশের অসংখ্য বিশিষ্টজন দাবি করে আসছেন। প্রত্যেকেরই একটি দাবি ছিল, ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত এই দেশে ‘খাজা নাজিমউদ্দিন’-এর নামে সরকারী কলেজের নাম থাকে কিভাবে? কেন এখনও পরিবর্তন করা হয়নি? যে দেশে ভাষার জন্য যুদ্ধ হয়, মুক্তিযোদ্ধারা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য লড়াই করেন, সেই দেশে একজন ভাষাবিদ্বেষীর নামেই স্কুল কেন? দেশের বিশিষ্টজন বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলে আরও বলেছেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের রক্ত ঝরলেও খাজা নাজিমউদ্দিনের অবস্থান ছিল বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে তিনি ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে চুক্তি করেন। তিনি ১৯৪৮ সালেই মাদারীপুরে নিজের নামে কলেজের নামকরণ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েও সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করেননি। ঢাকার নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ করা একজন বাঙালী রাজনীতিবিদ (পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, ১৯৪৮-১৯৫১) হয়েও বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন। আর এর পরেই ঘটনার ধারাবাহিকতায় মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ হলো এবং বিশ্বের মানচিত্রে লাল-সবুজের বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। সেই বিতর্কিত খাজা নাজিমউদ্দিনের নামে স্বাধীন বাংলাদেশে কলেজের নাম রয়েই যায়। আজকে নাম পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা যায়, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী ও বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান এমপি নাম পরিবর্তনের জন্য চিঠি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। যেখানে শাজাহান খান নাজিমউদ্দিন কলেজের নাম পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর দাদা শেখ লুৎফর রহমানের নামে করার প্রস্তাব করেছিলেন। তবে প্রধানমন্ত্রী তাতে সম্মতি দেননি কিন্তু নাজিমউদ্দিনের নাম পরিবর্তনে গত বছরই সম্মতি দেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারী নাজিমউদ্দিন কলেজের নাম পরিবর্তন না হওয়ায় বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেছে আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, ছাত্র মৈত্রীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শাজাহান খান বলছিলেন, এটা আমাদের পুরো জাতির পাওয়া। আমি এ দাবি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে জনমত গঠন করেছি। সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা করে জনমত তৈরি করেছি বিভিন্ন সময়। আজ মাদারীপুরবাসী খুশি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞরা, সীমাহীন ভালবাসা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন করোনাকালে আমরা নাম পরিবর্তনের এ আনন্দ হয়ত সেভাবে উদ্যাপন করতে পারব না, তার পরেও আমরা একটি সভা করছি। আমরা সকলের মাঝে এ আনন্দটা ভাগ করে নিতে চাই। নাম পরিবর্তন করে ‘মাদারীপুর সরকারী কলেজ’ করায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মাদারীপুরের ভাষাসৈনিক পরিবারবর্গ, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীরা। ’৯০-এর দশকে নাজিমউদ্দিন কলেজের নাম পরিবর্তনের আন্দোলন সবচেয়ে বেগবান ছিল। সেই আন্দোলনে ছিলেন যুব মৈত্রীর মাদারীপুর জেলার সাবেক সভাপতি শহীদুর কবীর খোকন। তিনি বলছিলেন, দেরিতে হলেও বিতর্কিত খাজা নাজিমউদ্দিনের নাম বাদ দেয়ায় আমরা খুুশি। তবে আমাদের দাবি ছিল মাদারীপুরের প্রথিতযশা কারও নামে নামকরণ হোক। কারণ কখনও স্বাধীনতাবিরোধীরা আবার ক্ষমতায় এলে তারা হয়ত নিজেদের মতো কারও নাম দিতে পারে।
×