ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জমির মিয়াদের সংসার চলে না

জীবন সংগ্রামে ভাল নেই নিম্ন আয়ের মানুষ

প্রকাশিত: ০৯:৫৬, ২০ এপ্রিল ২০২০

 জীবন সংগ্রামে ভাল নেই নিম্ন আয়ের মানুষ

ওয়াজেদ হীরা ॥ জমির মিয়া (৪৮) রাজধানীর মগবাজার-মালিবাগ-মৌচাক সড়কের রিক্সাচালক। নির্দিষ্ট পথ ছেড়ে এখন ছুটে বেড়ান ফাঁকা রাজধানীর যে কোন পথেই। তবুও আয় কমেছে, নেমেছে আগের অর্ধেকে। জীবন বাঁচাতে জীবিকার সন্ধানে থেমে নেই জমির মিয়া। কখনও অন্যের মাল টেনে দিচ্ছেন কখনও যাত্রী বয়ে বেড়াচ্ছেন, কখনও কারও দেয়া ত্রাণও নিচ্ছেন। জীবিকার সন্ধানে নেমে চেষ্টা করছেন ভাল থাকার, পরিবারকে একটু ভাল রাখার। রাজধানীর বুকে রিক্সা-ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা এই সকল জমির মিয়ারা ভাল নেই। সরকারের সাধারণ ছুটির মধ্যে শুরুতে কিছুটা কম রিক্সা দেখা গেলেও এখন রাস্তায় বেড়েছে রিক্সার চলাচল। তবে যাত্রী নেই। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি চলছে। চার দফায় সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে আরও বাড়ানোর অপেক্ষা রয়েছে সামনের দিনগুলোতেও। এই দীর্ঘ সময়ের শুরুতেই কেউ কেউ বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। আবার কেউ বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছেন জীবিকার সন্ধানে। রিক্সার প্যাডেল ঘুরাতে ঘুরাতে জমির মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, সিরাজগঞ্জে বাড়ি আমার। সঙ্গীরা বেশির ভাগই বন্ধের সময় চলে যায়। আমরা ৪/৫ জন আছি। কারোই কোন ইনকাম তেমন নেই। আগে মালিকের জমা খরচ দিয়ে ৮০০ থেকে হাজার বা আরও বেশি আয় হতো। এখন দুই শ’ থেকে সর্বোচ্চ ৪শ’ টাকা আয় হয়। কোন দিন জমা খরচ দেয়ার টাকাও ওঠে না। তবুও পইরা আছি, কিছু কিছু আয় দিয়া সংসার চালাইতাছি দেশে তো (গ্রামে) কোন কাম নাই। দেশে থাকলে বাচ্চা লইয়া না খাইয়া মরমু তাই যাই নাই। আর কদিন চালাইয়া দেশে গিয়া ধান কাটমু। যাত্রী না পাইলে দিন কিভাবে যায় সে কথা বলতে গিয়ে জমির মিয়া বলেন, এখন আর কাম নাই, তয় প্রায়ই কেউ কেউ খাবার দেয়। আমি চারদিন পাইছি। প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে সামান্য উপহারে আনন্দ অশ্রুতে ভরে যায় জমির মিয়ার দু’চোখ। রাজধানীর রিক্সাচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোগ থেকে বাঁচতে সবাই যেখানে ঘরবন্দী তখন ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে এই জমির মিয়াদের। একদিন বসে থাকার উপায় নেই কারও। কোন না কোন কাজ করতেই হবে নয় তো চুলায় আগুন জ্বলবে না পরিবার থাকবে অভুক্ত। তাই তো এই শহরে প্রতিদিনই আয়ের স্বপ্ন নিয়ে অসংখ্য রিক্সাওয়ালা ঘুরান প্যাডেল। কারও আয় ভাল হলে সর্বোচ্চ আগের আয়ের অর্ধেকের মতো হয়। মানুষ শূন্য শহরে এখনও জমা খরচ কমাননি রিক্সা মালিকরা। তবে কেউ জমা খরচ তুলতে না পারলে বা একটু কম দিলে মালিকরা তেমন কিছু বলেন না এটিও জানা গেছে। সারাদিনের জন্য রিক্সা চালালে মালিককে ভাড়া বাবদ ৮০-১০০ টাকা আর অর্ধেক বেলার জন্য ৫০-৬০ টাকা স্থান ভেদে ভাড়া দিতে হয় রিক্সাচালককে। ফাঁকা ঢাকায় রিক্সার ভিড় নেই বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে। সবাই রিক্সা চালিয়ে যাত্রী খুঁজতে থাকে কোথাও পেলেই গন্তব্যে ছুটে যান। এখন গলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অন্যান্য সময় যানজটের কারণে বড় ব্যস্ত রাস্তায় উঠতে দেয়া হয় না রিক্সা। এখন যে কোন সড়কে রিক্সাই যেন ভরসা। তবুও যাত্রী উঠতে চান না, অধিকাংশ সময় হেঁটেই যাতায়াত করে। নেত্রকোনার খালেক ছুটির মধ্যেই বাড়ি ফেরত নিম্ন আয়ের মানুষ। এক সপ্তাহ বাড়ি কাটিয়ে কোন কাজের সন্ধান করতে পারেননি। খালেক ও তার তিন প্রতিবেশী আবার পণ্যবাহী গাড়িতে ঢাকায় এসেছেন। কথা প্রসঙ্গে খালেক বলেন, আমরা ১২ জন দেশে (গ্রামে) চইলা গেছিলাম, তয় আমরা চারজন আবার অনেক কষ্টে আইয়া পরছি। দেশে কি করুম, কোন কাম পাই নাই। সংসার চলবো কেমনে। ঢাকায় মানুষ বাহির হয় না তয় কিছু কিছু আয়তো হয়। ধান কাটা লাগলে আবার চইলা যামু। নিম্নবিত্তের লাখো মানুষ ঢাকাকে ঘিরে বাঁচার চেষ্টা করে, চালায় সংসার পরিবারের ভরণ-পোষণ। অনেকেই গ্রামে গিয়ে আটকা পড়েছেন। কেউ গ্রামের বিভিন্ন দিনমজুর ভিত্তিক কাজে যোগ দিয়েছেন। আর রাজধানীতে থাকা মানুষগুলো সংগ্রাম চালাচ্ছেন। লালমানিরহাটের বাসিন্দা সোরহাব উদ্দিন অনেকটাই অনিচ্ছায় এখন রিক্সা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমি দুই বছর ধরে গাড়ির কাঁচামাল নামাই। এখন গাড়ির আসে কম আর আমরা লেবার বেশি। তাই দিনের হাফবেলা একটু রিক্সা চালাই। অধিকাংশ এই শ্রমিকরা কয়েকদিনের টাকা একত্রে করে গ্রামের বাড়ি পাঠায় বিকাশ বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহার করে। এখন সব জায়গা যত্রতত্র সব না থাকাতে টাকা পাঠাতেও বিড়ম্বনা রয়েছে। সোরহাব উদ্দিন আরও বলেন, মনে করেন আগে যখন খুশি টাকা পাঠাই দিতাম এখন সেটি করা যায় না। আমি টাকা পাঠাইতে গিয়া একদিন শুধু ঘুরছি বিকাশ খুঁজতে পরে এক দোকান খোলা পাইয়া দিছি। এদিকে, এ সকল মানুষের পাশে ব্যক্তি উদ্যোগে খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি অর্থ সহায়তাও করছেন কেউ কেউ। কেউ নির্দিষ্ট ভাড়ার বেশি ভাড়া দিচ্ছেন, কেউবা ভাড়ার পাশাপাশি খাদ্যপণ্য কিনে দিচ্ছেন। কেউ রিক্সা চালকের পুরো পরিবারের এক সপ্তাহের বাজার করে দিচ্ছেন। কেউ কেউ এসব কাজের মাধ্যমে অন্যকে উৎসাহ দিতে ফেসবুকে লিখে পোস্টও দিচ্ছেন আবার কেউ করছেন নীরবে। ইমতিয়াজ নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন আমার সাধ্য নেই তেমন তবে নিম্ন আয়ের দুজন ভাইকে এক সপ্তাহ খাওয়ার মতো পণ্য কিনে দিতে পেরেছি। আপনার সাধ্য অনুযায়ী একজনের পাশে হলেও দাঁড়ান। শুধু নিজের বাসার রান্নার কথাই ভাববেন না, দেশে অনেকের চুলায় আগুন জ্বলে না সেটিও ভাববেন। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি প্রায়ই অফিস যাত্রায়াতকালীন সময়ে নির্দিষ্ট ভাড়া ৭০-৮০ টাকা হলেও ৫০০ টাকা দিয়ে দেন। তার মতে, আমি এইভাবে একজন মানুষকে সরাসরি সহায়তা করলাম আবার সে এটা ভাববে না তাকে দান করলাম। সে পরিশ্রম করেছে আমি ভাড়াটা একটু বাড়িয়ে দেই। মূলত, সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকেই নিম্ন আয়ের মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করে। মাঝে মধ্যে কেউ কেউ ত্রাণ বা খাদ্য সহায়তা করলেও কেউ কেউ একাধিকবার পায় কেউ একবারও ঝুটে না এসব খাদ্য সহায়তা। আবার অনেক এলাকায় ত্রাণ নিতে লাগে ভোটার আইডি কার্ড ফলে রাজধানীর ভাসমান নিম্ন আয়ের মানুষ অনেকেই এক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়। রাতের নির্জন ঢাকায় বড় রাস্তায় আশ্রয় নেয় অনেকেই। রাতে ঘুরে ঘুরে দরিদ্র মানুষের পাশে খাবার নিয়ে দাঁড়ায় কিছু মানুষ। তবে নিজেদের চেয়ে পরিবারের মানুষের কথাও ভাবেন। তাই তো ভাইরাসের কারণে অসুখ-বিসুখ নিয়ে চিন্তা না করে প্রতিদিনই পরিবারের অন্যদের জন্য কাজ খোঁজেন পথে পথে। এর আগে একাধিক অর্থনীতিবিদরা জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, এই সময়ে কঠিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত হচ্ছে গরিব মানুষ। নিম্নবিত্ত মানুষ। যারা দিন আনে দিন খায়, যদি দিনে আনার বিষয়টা মানে রোজগার না হয় তাহলে তো খাওয়ার সুযোগ নেই মনে করেন অর্থনীতিবীদরা। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোঃ আইনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এই করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা দিন আনে দিন খায়। রিক্সাওয়ালা, সবজিওয়ালা বা যাদের নিম্ন আয় তাদের এখন থেকেই অল্প মূল্যে কি করে নিত্য পণ্য দেয়া যায় সেটিও দরকার। ইতোমধ্যেই সরকার বিভিন্ন ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। কোথাও ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রি করছেন। এছাড়াও ব্যক্তি সহায়তা করছেন অনেকে। রাজধানীসহ দেশে একটি বড় শ্রেণী এই নিম্নবিত্ত মানুষ। কেউ চা পান বিক্রেতা, কেউ ঠেলা ভ্যান বা রিক্সা চালায়। কেউবা নানা পণ্যের পসরা সাজায় ফুটপাথের দোকানে। অল্প আয়ে স্বপ্ন দেখেন পরিবারের স্বাদ মেটানোর। সেই স্বপ্ন দেখাটাও নেই। ভাইরাস কি তারা বুঝতে চায় না পরিবারের দিকে তাকিয়ে জীবন সংগ্রামে তারা প্রতিনিয়ত কাজে বিশ্বাসী। তবে কাজের বিনিময়ে আয়ে ভাটা পরায় আর সংসারেও টান লেগেছে। তবুও সংগ্রাম থেমে নেই এদের।
×