ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রেল লাইনের বস্তিতে মৃত্যু কড়া নাড়ে প্রতিদিন ॥ দায় ও দায়িত্ব

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ১৫ মার্চ ২০২০

রেল লাইনের বস্তিতে মৃত্যু কড়া নাড়ে প্রতিদিন ॥ দায় ও দায়িত্ব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ এক বছরের কম বয়স শিশু আরিফার। হামাগুড়ি শেখা শেষে দাঁড়ানোর চেষ্টা। বাবা-মা ঘরে নেই। দিনে তাকে দেখভালের দায়িত্ব ভাই পিয়ালের। ওর বয়স মাত্র ছয়। এখন ভাল-মন্দ বিবেচনাবোধ খুব একটা আসেনি। সে আর ছোট বোনের কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পারে? তবে উপায় নেই। পরিবারের অন্যরা কাওরান বাজারে দিনভর কাজ করেন। তাই বোনকে সামলানোর দায়িত্ব তার। কোন কারণে অন্যমনস্ক ভাই। ঘরের দরজা খোলা। এই ফাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে আরিফা ট্রেনের লাইনে চলে গেছে। কারণ ঘর থেকে বের হলেই স্বাগত জানায় মৃত্যুদূত। এক হাত লাইনের ওপর! ট্রেন তো আসছে। ছোট্ট এই শিশুটির এই বোধ কি আছে। না। থাকবার কথাও নয়। খুব কাছাকাছি ট্রেন। এই মুহূর্তে আরিফার দিকে নজর গেল প্রতিবেশী একজনের। তিনি রীতিমতো জীবন বাজি রেখে পা ধরে টান দিয়ে আরিফাকে সরানোমাত্রই ইঞ্জিন শাঁ করে চলে গেল! ওহ! ভাবুন তো ঘটনাটি কত ভয়ঙ্কর হতে পারত। ১০ সেকেন্ডের ব্যবধানে ঘটে যেতে পারত বড় রকমের দুর্ঘটনা। নিভে যেতে পারত ছোট এই শিশুটির জীবন প্রদীপ। হয়তো বাবা-মা সন্তানের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর খবর পেয়ে ঘরে ফিরতেন। বলছি কাওরান বাজারে রেললাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা বস্তির বসতির কথা। এখানে ট্রেনলাইন ঘেঁষে গড়ে উঠেছে হাজার-হাজার বসতি। মাত্র একহাত ব্যবধানে মানুষের বসবাস। চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই, মৃত্যুকে হাতে নিয়ে কিভাবে বছরের পর বছর সবাই বসবাস করছেন। এখানে শিশু আরিফার মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটে। আছে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা যাওয়ার উদাহরণ। কাওরানবাজার এলাকায় বস্তিতে থাকা পারুল জানালেন, পাশের ঘরের লোকজন গ্রামের বাড়ি থেকে এক আত্মীয়কে ঢাকায় বেড়াতে নিয়ে আসেন। নাম সম্ভবত মর্র্জিনা। ঘটনা গত ডিসেম্বরের। শীতের সকালে রোদ পোহাতে মর্জিনা ট্রেন লাইনের ওপর বসেছিলেন। কানে কম শুনতেন তিনি। হঠাৎ করেই ট্রেন আসে। খেয়াল করেননি তিনি। ঢাকা আসার তিনদিন পর ট্রেনের নিচে কাটাপড়ে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়! ট্রেনে কাটাপড়ে কি পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হয় তা জানতে যেতে হবে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থানায়। থানার পাশে রয়েছে মর্গ। এরপাশে থাকা কয়েকটি গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে কিছু প্লাস্টিকের পুঁটলি। এগুলো কোন নেশাখোরদের কাজ নয়। সবক’টিই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। যা একেবারেই অযতœ অবহেলায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় ট্রেনে কাটাপড়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে সবক’টি লাশের আলামত। সাধারণত ট্রেনে কাটাপড়ে সকল মৃত্যুর তদন্তের দায়ভার রেল পুলিশের ওপর বর্তায়। তাই অযতেœ অবহেলার মধ্যেও মামলার আলামতের সংখ্যা প্রচুর। এ থেকেই বোঝা যায় ট্রেনলাইনে মৃত্যুর সংখ্যা বেশ। প্রশ্ন হলো স্বাভাবিকভাবে ট্রেনলাইনে ১৪৪ ধারা জারি থাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা খুব একটা জানেন না। রেল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত প্রচারণাও খুব একটা নেই। তাই ট্রেনলাইন ধরে মানুষের চলাচল অহরহ দেখা যায়। এ কারণে ট্রেন দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। অসচেতনভাবে লাইন ধরে চলাচলের কারণে ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। আরেকটি বিষয় হলো, লাইনের ১০ মিটারের মধ্যে কোন স্থাপনা থাকার কথা নয়। এর দেখভালের দায়িত্ব রেলের সম্পত্তি বিভাগের। যদি ঢাকার চিত্র বলা হয় তবে ট্রেনলাইনের দু’পাশে নিরাপদ কোন স্থান নেই। শতভাগ জায়গা-জমি দখলে। কোথাও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কোথাও গড়ে উঠেছে বসতি। মাঝে মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান দেখা গেলেও তা একেবারেই নামেমাত্র। অন্য দেশে ট্রেনলাইনের দু’পাশে দেয়াল নির্মাণ বা কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও আমাদের দেশে তা উদ্যোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এত গেল রেল বিভাগের দুর্বলতা। মানুষ হিসেবে কি তাহলে আমাদের কোন দায়দায়িত্ব নেই। নিরাপদ নয়, তা জেনেও কেন বসবাস করতে হবে? এ প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয়। যারা এরকমভাবে বসবাস করছেন, তারা বলছেন আয় কম। অনেকের ভাড়া লাগে না। নিজের মতো করে ঘর তুলে নিলেই হয়। কেউ কেউ বলেন, স্থানীয় মাস্তানদের মাসপ্রতি ৫০০ কিংবা হাজার টাকা দিলেই একটি ঘর তোলা যায়। উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত থাকা নিয়ে আর চিন্তা থাকে না। সরেজমিন রাজধানীর তেজগাঁও, কাওরানবাজার, খিলগাঁও, মালিবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, প্লাস্টিকের ছাউনি। ছোট্ট ঝুপড়ি ঘর। দিনের বেলায় আলো নেই। অন্ধকার। ঘরের বেড়া দেয়া হয়েছে প্লাস্টিক, টিন অথবা পাতলা কাঠ দিয়ে। কোন কোন ঘরের চাল টিনের দেখা গেলেও বেশিরভাগই প্লাস্টিকের। এক ঘরেই সবকিছু। থাকা, রান্না বান্না থেকে শুরু করে আসবাবপত্রও রাখা আছে। বেশিরভাগ মানুষ মাটিতেই থাকেন। যেখানে একটু ঘর বড় দেখা গেছে সেখানে ঘাট, শো কেস, আলনা, টিভি, ফ্রিজের আয়োজনও আছে। বৈধ লাইন না থাকলেও রাতে ঘরে আলো জ্বলে। মাটির চুলোয় হয় রান্না বান্নার কাজ। কিছু পরিবারে দেখা গেছে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবস্থাও। প্রতিটি ঘরেই আছে পানির হাহাকার। অল্প পানিতে কাপড় ধোয়া, গোসল করা ও রান্না বান্নার কাজ চলে। আশপাশে কোন পাম্প থেকে বোতল বা বালতি দিয়ে পানি সংগ্রহ করা হয়। অথবা কোথাও টিউবওয়েল থাকলে সেখানে লাইন দিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো টয়লেট। লাইন ঘেঁষে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি দেখা গেছে কাওরান বাজার ও তেজগাঁও এলাকায়। এখানে বসবাস করে আট বছরের শিশু নিহার। সে জানায়, রাতে যখন ট্রেন যাওয়া আসা করে তখন মনে হয় গায়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। নয়তো মনে হয় এই বুঝি বুকের ওপর আছড়ে পড়ছে। মাটি কাঁপতে থাকে থরথর করে। প্রায় রাতেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। শিশুরা আতঙ্কে কেঁদে ওঠে। একই কথা নিহারের বন্ধু শোভনের। সে জানায়, বাবা-মা কাওরান বাজারে কাজ করেন। আমি আর ভাই দিনভর বাসায় থাকি। সন্ধ্যায় তারা বাসায় ফেরার পর আমি খেলতে বের হই। সারাদিন কষ্টে কাটে আমার। মন ভাল থাকে না। একেতে বন্দী, তারপর আবার আতঙ্ক। বহুদিন বাবাকে বলেছি বাসা বদলাতে। লাইনের পাশ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে। নেয় না। মোট বসতির মধ্যে নারী ও শিশুদের মধ্যে ভয়, সংগ্রাম ও আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি। রেললাইন ঘেঁষে বস্তিতে থাকা পাখির মা জানালেন, ভয়ের মধ্যেই তো থাকতে হয়। ছোট দুটি বাচ্চা। এদের রেখে পানি আনতে যেতে হয়। নানা কাজে বাইরে যেতে হয়। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই ট্রেন লাইন! সব সময় চোখ রাখতে হয় লাইনের ওপর। এই বুঝি ট্রেন আসে। একটু অসতর্ক হলেই মহাবিপদ ঘটে যেতে পারে। প্রায়ই এখানে ঘটে দুর্ঘটনা। তাই সব সময় সজাগ থাকতে হয়। কিন্তু ভয়ে ভয়ে জীবন আর কতটুকু নিরাপদ রাখা যায়। বিপদ তো সব সময়ের জন্যই দরজায় কড়া নাড়ে। কিন্তু কেন এখানে বসতি করতে হবে। এ প্রশ্নে খুলনা থেকে আসা বস্তির বাসিন্দা আরজ আলী বললেন, কি করার আছে। গ্রামে জমি বাড়ি বলতে কিছু নাই। তাই ২০ বছরের বেশি ঢাকায় আছি। বস্তিতে থাকলে তো টাকা লাগে না। আয় সামান্য। ঝুঁকি থাকলেও এখানেই থাকতে হচ্ছে। চাঁদপুরের বাসিন্দা ফকির চাঁনের বক্তব্য একই রকমের। তিনি বলেন, কাওরান বাজারে কাজ করে কত টাকা পাই। দিনে ৪০০/৫০০ টাকায় জীবন চলে না। কিন্তু আমার জীবন তো এভাবে শেষ হবে। ভবিষ্যত প্রজন্মের ভাগ্য হয়তো আরো খারাপ। কারণ টাকার জন্য দুই শিশুকে লেখাপড়া করানোর সাহস করেন না তিনি। রেলওয়ে পুলিশের দেয়া তথ্যে, রাজধানীতে রেললাইন সংলগ্ন যে দুর্ঘটনা ঘটে তার বেশিরভাগই তেজগাঁও সংলগ্ন লেভেলক্রসিং, বস্তি ও বাজারে। গত পাঁচ বছরে রেল দুর্ঘটনায় প্রায় দুই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৪১১ জন, ২০১৪ সালে ৩৯১ জন, ২০১৫ সালে ৪৪৯ জন, ২০১৬ সালে ৩৬৩ জন এবং ২০১৭ সালে ৩৭০ জনের মৃত্যু ঘটে। পাঁচ বছরে সর্বমোট ১৯৮৪ জনের মৃত্যু হয়। রেলওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, রেললাইনের দুই পাশে যে অবৈধ স্থাপনা ও ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে তা উচ্ছেদের দায়িত্ব রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। আর এসব বস্তি উচ্ছেদের ক্ষমতা রেলওয়ে পুলিশের নেই। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এসব উচ্ছেদে রেলওয়ে পুলিশের সহযোগিতা চাইলে তারা এগিয়ে যান। তারা বলেন, সাধারণত রেললাইনের আশপাশে যে বাজার ও বস্তি আছে তা সে সব এলাকার রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণেই গড়ে উঠেছে।
×