ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফের নির্মমভাবে শিশু হত্যা

রাজধানীর পল্টনে লাশ বস্তায় ভরে ফেলে দেয়া হয়

প্রকাশিত: ১১:০৬, ১২ নভেম্বর ২০১৯

রাজধানীর পল্টনে লাশ বস্তায় ভরে ফেলে দেয়া হয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আবারও শিশু হত্যা। হত্যার পর লাশ বস্তায় ভরে ফেলে দেয়া হয়েছে। রবিবার খোদ রাজধানীর পল্টন এলাকার অলিম্পিক ভবনের পাশ থেকে সানি নামে পাঁচ বছরের বস্তাবন্দী হতভাগ্য এক শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। অবুঝ ওই শিশুর সঙ্গে কারও কোন শত্রুতা, ঝগড়া বা পারিবারিক বিরোধ থাকার কথা নয়। তারপরও ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! তাকে খুন হতে হয়েছে। তাও আবার পরিকল্পিতভাবে। শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ বস্তায় ভরে রাতের আঁধারে রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়েছে। কী নির্মম! কী ভয়ঙ্কর পৈশাচিকতা! পুলিশ সদর দফতর মামলা দায়েরকারী ও ভিকটিমের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দোষীদের নিয়মিত মনিটরিং করার নির্দেশ জারি করেছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারণে অকারণে খুন হতে হচ্ছে শিশুদের। ধর্ষণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া থেকে শুরু করে জমি নিয়ে বিরোধ, পূর্ব শত্রুতা, অর্থ নিয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রসহ নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে খুন হতে হচ্ছে কোমলমতি শিশু-কিশোর ও কিশোরীদের। সচেতনতা ও কঠোর আইন প্রয়োগ ছাড়া এ থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই। গত ১০ নবেম্বর রবিবার রাত দশটার দিকে রাজধানী ঢাকার পল্টন থানাধীন অলিম্পিক ভবনের পাশের মোড় থেকে ওই শিশুর লাশটি উদ্ধার হয়। পল্টন থানা পুলিশ স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানায়, রাস্তার পাশে প্লাস্টিকের বস্তাটি পড়ে ছিল। স্বাভাবিক কারণেই মানুষের মধ্যে বস্তায় কি আছে তা জানার আগ্রহ জন্মে। অনেকেই বস্তার কাছে যান। দেখেন, বস্তাটি পরিপাটি করে বাঁধা। কিন্তু ভেতরে কিছু একটা আছে তা বোঝা যাচ্ছিল। অনেকেই আগ্রহ করে বস্তার মুখ খুলেন। ভেতরে দেখা যায় তোষক দিয়ে কিছু একটা পেঁচানো। তোষক খুলতেই বেরিয়ে আসে শিশুর লাশ। দেখে সবাই হতবাক। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। শিশুটির মাথার ডান পাশে কানের কাছে কিছুটা থেঁতলানোর আঘাত ও গলায় শ্বাসরোধের চিহ্ন আছে। শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যার পর বস্তায় ভরে ফেলে দেয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিহত শিশুর পিতার নাম সাগর শেখ। মা ঝর্ণা বেগম। ভাসমান পরিবার। পরিবারটি গুলিস্তান স্টেডিয়াম এলাকার ফুটপাথে থাকত। পল্টন মডেল থানার পরিদর্শক মোহাম্মদ সেন্টু মিয়া নিহত সানির পিতা-মাতার বরাত দিয়ে জনকণ্ঠকে জানান, শনিবার রাত দশটার পর থেকেই সানি নিখোঁজ ছিল। টোকাই ছেলেকে পিতামাতা অনেক খুঁজেছে। কিন্তু পায়নি। ভেবেছিল, হয়তো কোথাও গেছে, ফিরে আসবে। পল্টন এলাকা থেকে শিশুর লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে পিতামাতা ছেলেকে শনাক্ত করে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি ঢাকার গে-ারিয়ায় খিচুড়ি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে আয়েশা নামের এক শিশুকে বাড়ির তিনতলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা, চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ডেমরার কোনাপাড়ার একটি বাসায় লিপস্টিক দেয়ার লোভ দেখিয়ে ফারিয়া আক্তার দোলা (৫) ও নুসরাত জাহান (৪) নামে দুই শিশুকে ডেকে বাসায় নিয়ে গামের্ন্টস শ্রমিক গোলাম মোস্তফা (২৮) ও তারই মামাত ভাই আজিজুল বাওয়ানী (৩০) কর্তৃক হত্যা, চলতি বছরের ৫ জুলাই ঢাকার ওয়ারীতে সিলভারডেল স্কুলের নার্সারির ছাত্রী সামিয়া আফরিন সায়মাকে (৭) ধর্ষণের পর গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা, গাজীপুরে পাঁচ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা, গত ৮ এপ্রিল ডেমরার মসজিদুল-ই-আয়েশা জামে মসজিদের দ্বিতীয় তলা থেকে সিমেন্টের বস্তাবন্দী সেখানকার নূর-ই-মদিনা মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণীর ছাত্র মনিরের (৮) লাশ উদ্ধারসহ প্রায়ই অবুঝ শিশু, কিশোর-কিশোরী হত্যার ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করছে। পুলিশ সদর দফতরের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আলোচিত হত্যাকা- বা অন্য ঘটনার আসামিরা গ্রেফতারও হচ্ছে। কিন্ত আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে, এমন সব ঘটনার আসামিরা জামিন পেয়ে যাচ্ছে। জামিন পেয়েই তারা দেশ ছাড়ছে। অনেক সময়ই প্রভাব খাটিয়ে এবং প্রয়োজনীয় প্রমাণাদির অভাবে এমনটা হচ্ছে। জামিন পাওয়ার পর সাধারণ বিশেষ কোন ঘটনা না হলে, ওইসব আসামিদের ওপর কোন মনিটরিং করা হয় না। এমন সুযোগে দেশ ছাড়ে। যেমনটি হয়েছে মতিঝিলের বহুল আলোচিত ঘরোয়া হোটেলের মালিকের ক্ষেত্রে। সূত্র বলছে, ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর মতিঝিলের ঘরোয়া হোটেলের মালিক আরিফুল ইসলাম সোহেল (৩৩) সামান্য একটি মোবাইল চুরির অভিযোগে তারই হোটেলেরই কিশোর কর্মচারী রিয়াদকে (১৬) খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। নির্যাতনের একপর্যায়ে হোটেল মালিক রিয়াদকে গুলি করে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে হোটেল মালিক মুখে পিস্তলের নল ঢুকিয়ে দিয়ে গুলি চালিয়ে রিয়াদকে হত্যা করে। এ বিষয়ে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (এ্যাডিশনাল ডিআইজি) মাহবুব আলম জনকণ্ঠকে জানান, অনেক চেষ্টার পরেও মূল খুনীকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। শেষ পর্যন্ত হোটেল মালিকসহ তার সহযোগী খুনীদের আসামি করে মামলাটির চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। মূল আসামি গ্রেফতার হলে তার বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশীট দাখিল করা হবে। তবে ঢাকায় ঘটে যাওয়া অন্যান্য চাঞ্চল্যকর ঘটনার আসামিদের গ্রেফতারে ডিবি পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। এসব বিষয়ে দেশের খ্যাতিমান অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, যে কোন ধরনের অপরাধের সঙ্গেই মানসিক বিষয়াদি জড়িত। যে অপরাধ করে, সে তার মানসিকতা দিয়েই অপরাধ করার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ হয়। তাই প্রতিটি অপরাধই একটি নেতিবাচক মানসিকতার ফসল। বিশেষ করে ধর্ষণ, উত্ত্যক্ত করা বা ধর্ষণের চেষ্টা করে হত্যা করার ঘটনাটি পুরোটাই নির্ভর করে মানসিকতার উপর। আমরা এটাকে বিকৃত মানসিকতা বলে থাকি। মানসিকভাবে মানুষকে এসব বিষয়ে সচেতন করতে হবে। এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে প্রয়োজনে পাড়া মহল্লায় সভা সমাবেশ করে মানুষকে বুঝানো প্রয়োজন। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পাঠদানের মাধ্যমে এসব বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সমাজের মানুষদের সচেতন করা দরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের রীতিমতো এসব বিষয়ে সতর্কতামূলক শিক্ষা দেয়া এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি পিতামাতা ও পরিবারের সদস্যদের শিশু, নারী বা অন্য যারা পরিবারের সদস্য তাদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তার সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, তার সন্তানের ওপর আপশাশের কারও কোন কুনজর আছে কি না তা খেয়াল রাখতে হবে। তাদের সন্তানকে কে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। সন্তান কোন কোন জিনিস বা বিষয়ের প্রতি দুর্বল তা জানতে হবে। প্রয়োজনে পরিবারকে সন্তানের যেসব চাহিদা সাধ্য মোতাবেক পূরণ করতে হবে। সন্তানদের নানা বিষয়ে সতর্কতামূলক বিষয়াদি শেখাতে হবে। তাহলেই ধর্ষণ, খুনসহ এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, যখনই কোন সন্তান পিতামাতা বা ভাই বোনের কাছে নিজের ভাব প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়, তখনই তার বিপদগামী বা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে শিশু বা কিশোর-কিশোরীরা সহজ টার্গেটে পরিণত হয়। ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর খুনের মতো অপরাধগুলোও সংঘটিত হয় এভাবেই। সম্প্রতি আদালত এ ধরনের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকা উচিত। তাহলে ভবিষ্যতে ধর্ষণ বা নিপীড়ন বা শিশু খুনের মতো অপরাধ কমে আসার সম্ভবনা তৈরি হবে। পুলিশ বা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে তারা যখন বিভিন্ন সভা সমাবেশে যান, তারা এসব বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে এবং পাশাপাশি আইনে কঠোর শাস্তির কথা জানালে এ ধরনের অপরাধ কমে আসার ক্ষেত্রে আরও সুফল আসবে।
×