ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণখেলাপীদের বিশেষ সুবিধা বহাল রাখল আদালত

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ৪ নভেম্বর ২০১৯

 ঋণখেলাপীদের বিশেষ সুবিধা বহাল রাখল আদালত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঋণখেলাপীদের পুনর্তফসিল সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা বহাল রেখেছে আদালত। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে খেলাপী ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারকে বৈধ ঘোষণা করে তার মেয়াদ তিন মাস (৯০ দিন) বাড়ানো হয়েছে। রবিবার থেকেই এটা কার্যকর। তবে এসব ঋণখেলাপীদের নতুন ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১২ সালের ‘মাস্টার সার্কুলার অন লোন রিশিডিউলিং’ অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ঋণ অনুমোদন ও আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর অনিয়ম, দুর্বলতা চিহ্নিত করে সম্ভাব্য সমাধানের বিষয়ে পরামর্শ দিতে নয় সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। ঋণখেলাপীদের সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপন স্থগিত চেয়ে রিটের রুল নিষ্পত্তি করে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মোঃ খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ রবিবার এ রায় ঘোষণা করেছেন। আদালত রায়ে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ও দুরবস্থা নিরসনে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হয়েছে। সেখানে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে বিশেষজ্ঞদের এই কমিটিতে রাখতে বলা হয়েছে। এছাড়া ব্যাংকের এমডি থেকে সর্বনিম্ন পাঁচ পদে নিয়োগের বিষয়টিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আদালত আরও বলেছে, আমরা মনে করি সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুদের হার ডাবল ডিজিট থেকে সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা উচিত। রক্ত সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ করে হার্ট। আর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাংক। রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশ ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, আদালত কমিশন গঠনে সরকারের প্রতি কোন নির্দেশনা দেয়নি। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি কমিটি করতে বলেছে। ব্যাংকিং সেক্টরে কমিটির কাজ হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টরে অনিয়ম কেন হয়েছে সেটি তদন্ত করে দেখে রিপোর্ট তৈরি করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে সার্কুলার (২ শতাংশ) দিয়েছিলেন সেটি অবৈধ হয়নি বরং আরও তিন মাস সময় বাড়িয়ে দিয়েছে ওই সার্কুলারের মেয়াদ। দুই শতাংশ জমা দিয়ে পরে লোন নিতে পারবে। তবে পরে লোন দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যেটি মাস্টার সার্কুলারে উল্লেখ আছে, সেই বিধিবিধান যেন মান্য করা হয়। তিনি আরও বলেন, এ রায়ের ফলে আমাদের মনে হয় না ব্যাংকিং খাতে কোন সমস্যা আছে। এর ফলে বরং ব্যাংকিং সেক্টর আরও ভাল হবে। আদালত বলেছে সব ব্যাংক যেন সুদকে সিঙ্গেল ডিজিটে আনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষের আইনজীবী মুনীরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময়েই বিভিন্ন সময়ে গঠিত কমিটির পরামর্শ নিয়ে কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে আমি মনে করি যে, আজকে (রবিবার) আদালত যে কমিটি গঠন করতে বলেছে, তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজের কাজের ইন্টারাপ্ট হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সফলভাবে কাজ করতে পারবে। অন্যদিকে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, কোর্ট আদেশে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে যারা বিশেষজ্ঞ আছেন সেই রকম নয়জন ব্যক্তিকে দিয়ে একটি কমিটি গঠন করে, সেই কমিটি সরকারী-বেসরকারী সব ব্যাংকের যে দুর্বলতা, বিশেষ করে ঋণ পরিশোধ, ঋণ অনুমোদন এবং সংগ্রহে অনিয়মসহ সব বিষয়ে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি করবেন। সেখানে তারা এগুলো তৈরি করে কি কি উপায়ে এগুলো দূর করা যায়, এ দুরবস্থাগুলো দূর করা যায়, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তারা প্রতিবেদন দেবেন। আদালত বলেছে, যে প্রতিবেদন দেবেন বাংলাদেশ তা কার্যকর করবেন। তিনি আরও বলেন, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনর্তফসিলের বিষয়ে আদালত আদেশ দিয়েছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১২ সালের ‘মাস্টার সার্কুলার অন লোন রিশিডিউলিং’ সংক্রান্ত সার্কুলার অনুসরণ করতে হবে। এদিকে এই মামলার শুনানিতে ঋণ পুনর্তফসিলীকরণ-সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা বহাল রাখার পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক তিনটি হলফনামা হাইকোর্টে দাখিল করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী মুনীরুজ্জামান বলেন, আমরা আদালতে তিনটি হলফ নাম দাখিল করেছিলাম। ৭, ২১ ও ২৭ অক্টোবর আদালতে শুনানির সময় ঋণ পুনর্তফসিলীকরণ সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা বহাল রাখার জন্য তিনটি হলফনামা দাখিল করা হয়। ওই হলফনামায় বলা হয়েছে, খেলাপী ঋণ পুনর্তফসিল করা না হলে ঋণগ্রহীতাদের শিল্প, কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। কর্মচারীরা বেকার হয়ে পড়বে। হ্রাস পাবে দেশের উৎপাদন এবং অচল হবে অর্থনীতির চাকা। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতেই বাংলাদেশ ব্যাংক জনস্বার্থে বিশেষ সুবিধা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এছাড়া অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশের বাণিজ্য খাতে, বিশেষ করে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে যারা বিনিয়োগ করেছেন, তাদের অধিকাংশই খেলাপী হয়ে পড়েছেন। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ঋণখেলাপীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এতে আরও বলা হয়, অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপী বা অনিবার্য ও নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে কারণে যারা ঋণখেলাপী হয়েছেন তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। স্বেচ্ছা ঋণখেলাপীরা কোন সুবিধা পাবে না দাবি করে হলফনামায় বলা হয়, ‘ভুল’ ব্যক্তিকে সুবিধা দিয়ে ওই বিজ্ঞপ্তির অপব্যবহারের কোন সুযোগ এখানে নেই। এছাড়া ঋণখেলাপী এবং নিয়মিতভাবে ঋণ পরিশোধকারীদের মধ্যে এ প্রজ্ঞাপন কোন বৈষম্য সৃষ্টি করবে না। এসব বিচেনায় অর্থ মন্ত্রণালয় গত বছরের ২০ জুন ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপীদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে এ প্রজ্ঞাপন জারি করে। ফলে জনস্বার্থ বিবেচনায় এ বিষয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করার কোন এখতিয়ার রিটকারী পক্ষের নেই। রবিবার রায় ঘোষণার জন্য সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে কার্য তালিকায় সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের ১৯ নম্বর ক্রমিকে রাখা হয়েছিল। ২৮ অক্টোবর রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায়ের এ দিন নির্ধারণ করেছিল আদালত। রবিবার সাড়ে ১১টা থেকে শুরু হয়। আর রায় শেষ হয় বিকেল ৪টায়। ১৩ অক্টোবর থেকে একটানা ১২ দিন এ মামলার শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, দুদকের পক্ষে এ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান, ব্যারিস্টার হাসান এম আজিম, রিটকারীর পক্ষে এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ, ব্যারিস্টার এম আমির-উল-ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক, পলাশ চন্দ্র রায় ও মুনীরুজ্জামান। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ব্যারিস্টার আজমালূল হোসেন কিউসি ও ব্যারিস্টার শামিম খালেদ আহম্মেদ। আদালতে এই ১২ দিনে শুনানিতে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, এটা পলিসি মেটার, শিল্প খাতের সঙ্গে জড়িত। জাতীয় স্বার্থে সরকার এই সুবিধা দেয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছেন, দুদক আইনের কার্যাবলী বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। তফসিলভুক্ত অপরাধের বাইরে কিছু করতে পারি না। দুদকের আইনের বাইরে অন্য কিছু করা পারমিট করে না। কমিশন হবে কিনা তা সরকার জানাবে। তখন রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, তারা তো বললেন তাদের হাত-পা বাঁধা। এর আগে কমিশন চাওয়ায় আইনজীবী বাদ দিয়েছে দুদক। এর জবাবে দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, না এটা সঠিক না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষের আইনজীবী আজমালূল হোসেন কিউসি বলেছেন, বিষয়টি সেনসিটিভ। বাংলাদেশ ব্যাংক যে সার্কুলার জারি করেছে সে ক্ষমতা তাদের আছে। গত ১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করা হয়। এরপর রিটকারীদের আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ২১ মে ওই সার্কুলারের ওপর ২৪ জুন পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য আদেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। ২৪ জুন এ স্থিতাবস্থার মেয়াদ আরও দুইমাস বাড়ানো হয়। পরে এ আদেশ স্থগিত চেয়ে আপীল বিভাগে আবেদন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগের ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২ জুলাই আপীল বিভাগের চেম্বার আদালতের বিচারপতি মোঃ নুরুজ্জামান হাইকোর্টের আদেশে স্থগিতাদেশ দেন। একই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠানোর আদেশ দেন। চেম্বার জজ আদালত ৮ জুলাই পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে। ৮ জুলাই এ স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরও দুই মাস বাড়ানো হয়। আপীল বিভাগ তখন বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চকে রুল নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেন। মানবাধিকার সংগঠন এইচআরপিবির করা এক রিট আবেদনে হাইকোর্ট গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এক আদেশে ঋণখেলাপীর তালিকা দাখিলের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে রুল জারি করে। রুলে আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বন্ধে কমিশন গঠনের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না এবং এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এরপর ২৪ জুন হাইকোর্টে ঋণখেলাপীদের তালিকা দাখিল করা হয়। এ রিটের সঙ্গে সম্পূরক আবেদন হিসেবে ঋণখেলাপীদের সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা জারি করেছিল তা স্থগিতে আবেদন করে রিটকারী পক্ষ। ২০ অক্টোবর ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে খেলাপী ঋণ পরিশোধের যারা সুযোগ গ্রহণ করবেন তারা অন্য কোন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন না বলে হাইকোর্টের আদেশের মেয়াদ আরও এক মাস অথবা এ বিষয়ে জারি করা রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। যেটা আগে শেষ হয়। শেষ পর্যন্ত আগেই শুনানি শেষ হয়েছে। অবশেষে রবিবার রায়টি আসল।
×