ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাচীন বাংলার শঙ্খ তরঙ্গ, পৌরাণিক গল্পগাথা

প্রকাশিত: ১১:০২, ৩ অক্টোবর ২০১৯

প্রাচীন বাংলার শঙ্খ তরঙ্গ, পৌরাণিক গল্পগাথা

মোরসালিন মিজান ॥ শঙ্খ ধ্বনি, না, খুব মিষ্টি নয়। এর পরও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণে ঠিক বাজানো হয়। আর কিছু বাজুক বা না বাজুক, শঙ্খ বাজা চাই। পূজার এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তাই বলে শুধু পূজার অনুষঙ্গ হিসেবে দেখলেও চলবে না। শঙ্খের গা খুঁড়ে যে শিল্পকর্ম করা হয় তার আলাদা মূল্য আছে। কোন কোন শঙ্খের সৌন্দর্যের কাছে নামকরা শিল্পীদের রিলিফ ওয়ার্কও হার মানে। পৌরাণিক উপাখ্যানে শঙ্খের যে উল্লেখ পাওয়া যায় তাও যারপরনাই কৌতূহল উদ্দীপক। শঙ্খ একই সঙ্গে কম্বু বা শাঁখ নামে পরিচিত। সামুদ্রিক শামুকের খোলস দিয়ে তৈরি। গায়ের রং দুধের মতো সাদা। মসৃণ। শঙ্খের মুখটি বক্রাকার ছিদ্রবিশিষ্ট। ভেতরের ছিদ্র পথটিও বক্রাকার। এর সামনের অংশ মুখ দিয়ে ছুঁয়ে ফুঁ দিলে বিশেষ এক ধরনের সুর বেজে ওঠে। এই বিবেচনায় শঙ্খকে বাদ্যযন্ত্রও বলা যায়। দেশীয় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন ড. আবদুল ওয়াহাব। তার বর্ণনা অনুযায়ী, শঙ্খ বাংলা তথা ভারতের বহু প্রাচীন শুষির শ্রেণীর বাদ্যযন্ত্র। প্রাচীন বাংলার সঙ্গীত আসরগুলোতে শঙ্খতরঙ্গ বাজানো হতো। সাত বা বারো স্বরের সাতটি বা বারোটি শাঁখে আলাদা আলাদা স্বরধ্বনিত করে রাগ বাজানোর কথাও জানা যায়। আকৃতি-প্রকৃতি বিবেচনায় শঙ্খের আলাদা আলাদা নাম হয়। এই যেমন: গোমুখ শঙ্খ, ধবল শঙ্খ, পানি শঙ্খ ও পঞ্চমুখী শঙ্খ। শঙ্খের ইতিহাস বহু পুরনো। মহাভারত, রামায়ণ ও অন্যান্য পুরাণে শঙ্খের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। সে সময় এর নামেও ছিল বৈচিত্র্য। মহাভারতে কৃষ্ণের শঙ্খের নাম ছিল পাঞ্চজন্য। যুধিষ্ঠিরের শঙ্খের নাম ছিল অনন্ত বিজয়, ভীমের পৌত্র, অর্জুনের দেবদত্ত, নকুলের সুঘোসা ও সহদেবের মণিপুষ্প। বিষ্ণুর হাতেও ছিল শঙ্খ। সমুদ্র মন্থনকালে শঙ্খে বিষ নিয়ে পান করেছিলেন শিব। ভগীরথ শঙ্খ নিনাদের মাধ্যমে গঙ্গাকে মর্তে আনেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শঙ্খ ধ্বনিকে মাঙ্গলিক জ্ঞান করেন। প্রায় প্রতিঘরেই পূজার সামগ্রীর পাশাপাশি শঙ্খ রাখা হয়। নতুন কোন কাজ শুরু করার আগ মুহূর্তে শঙ্খ বাজানোর রীতি প্রচলিত আছে। আর এখন তো পূজা পার্বণের সময়। এমন উৎসবের দিনে আনন্দ বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার কাজেও ব্যবহৃত হয় শঙ্খ। ড. আবদুল ওয়াহাবের গবেষণা মতে, এর আগে যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহৃত হতো শঙ্খ। ঘোড়া, ঢাল-তলোয়ার তো ছিলই, সেই সঙ্গে বহন করা হতো শঙ্খ। ডামাডোলের মধ্যে যখন কারও কথা শোনার সুযোগ থাকত না তখন শঙ্খ বাজিয়ে আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হতো। রণে ভঙ্গ দেয়ার ঘোষণাও আসত শঙ্খ থেকে। পাশাপাশি একে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো। তবে এখন বদলে গেছে অনেক কিছু। শঙ্খের অত ব্যবহার চোখে পড়ে না। পূজার অনুষঙ্গ হয়ে এটি টিকে আছে। রাজধানী ঢাকার শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজারে সারা বছরই শঙ্খ তৈরি হয়। পূজা উপলক্ষে উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। সম্প্রতি শাঁখারীবাজারেরর দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি দোকানেই বিক্রির জন্য শঙ্খ রাখা হয়েছে। ‘মা মনসা শঙ্খ শিল্পালয়’ নামের একটি দোকানে ঢুকে দেখা গেল, শামুকের শরীর দক্ষ হাতে বা মেশিনে কেটে অদ্ভুত সুন্দর নক্সা করা হয়েছে। খুঁটিয়ে দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। দোকানি সদানন্দ নাগ জানান, সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করা শামুককে শঙ্খ হিসেবে গড়ে নেন তারা। শিল্পীরা নিপুণ হাতে ফুল, লতা-পাতা, দেব-দেবীর ছবি আঁকেন। অনেকে আবার সোনা ও রূপার পাত বসিয়ে অলঙ্কৃত করেন। যে শঙ্খের গায়ে সূক্ষ¥াতীসূক্ষ্ম কাজ তার দাম বেশি। ‘জয় গুরু ভা-ার’ নামের আরেকটি দোকানে সাধারণ দেখতে শঙ্খ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তবে দোকানি আশোক নন্দী বললেন, কারুকাজ খচিত শঙ্খও আছে। কিনলে তবেই দেখানো হয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সাদা শঙ্খ বার বার হাতে নিলে ময়লা হয়ে যায়। তা ছাড়া বেশি কাজ করা শঙ্খ সৌখিন ক্রেতা ছাড়া কেউ কিনতে চায় না। তেমন ক্রেতা পেলেই দেখাতে চান বলে জানান তিনি।
×