ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাতে বিএসএফ সীমান্তে আলো কমিয়ে ইয়াবা পাচার করে

কুড়িগ্রামে মাদকের নিরাপদ রুট

প্রকাশিত: ০৯:২৮, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

কুড়িগ্রামে মাদকের নিরাপদ রুট

স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম ॥ কুড়িগ্রাম এখন মাদকদ্রব্য পাচারে আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মাদককারবারিদের কাছে। সড়ক-নৌপথ ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছে এসব মাদকদ্রব্য। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন হাজার-হাজার ইয়াবা, গাঁজা, মদসহ বিভিন্ন মাদক পাচার হচ্ছে। উত্তরের শেষপ্রান্তের নদ-নদী আর সীমান্ত বেষ্টিত জেলা কুড়িগ্রাম। জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে ৭টির সঙ্গে ভারতের তিনটি রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে ২৭৮.২৮ কিমি। এর মধ্যে প্রায় ৩২ কিমি সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া নেই। নদীপথ রয়েছে ৩১৬ কিমি। ভারতের পশ্চিম বঙ্গ ও অসম রাজ্যের সীমানায় কুড়িগ্রাম ২২ বিজিবির অধীনে ১৯৮ কিমি সীমান্ত রেখা। জামালপুর ৩৫ বিজিবির আওতায় সীমানা প্রায় সাড়ে ৪৬ কিমি কাঁটাতারের ওপারে ভারতের অসম ও মেঘালয় রাজ্য। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সীমানায় লালমনিরহাট ১৫ বিজিবির অধীনে ৩৬ কিমি সীমান্ত। ফলে প্রতিদিনেই দীর্ঘ সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে আসছে বিপুল পরিমাণ মাদক। এসব মাদকের মধ্যে ইয়াবা, মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। তবে পরিবহনে সহজ হওয়া সবচেয়ে বেশি আসছে ইয়াবা। আর মাদক পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে সীমান্তবর্তী এলাকার গরিব-নিরীহ মানুষদের। মাদক বহন ব্যবহার হচ্ছে নারী-পুরুষ, যুবক, কিশোর এবং শিশুরা। ইতোমধ্যে রৌমারী উপজেলা দিয়ে নিরাপদ ও আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে ব্যবহার করছে মাদক পাচারকারী চক্রগুলো। এখানে ভারতের অসম-মেঘালয় রাজ্যের নিকটবর্তী পাহাড়ী এলাকা হওয়ায় অনায়সে আসছে ইয়াবার বড়-বড় চালানসহ গাঁজা। রাতের আঁধারে বিএসএফসহ ভারতীয় মাদক ব্যবসায়ীরা কাঁটাতারের ওপর দিয়ে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য পার করে দেবার অভিযোগও উঠেছে। মাদক কারবারিরা সীমান্তের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে মাদকদ্রব্য নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। জানা যায়, জেলার ৭টি উপজেলার প্রায় ৬০ পয়েন্ট এবং ভারতের ৪৫ পয়েন্ট দিয়ে আসে মাদক। আর এসব মাদকদ্রব্য একাধিক হাতবদল হয়ে চিলমারী-রৌমারী এবং রাজিবপুর দিয়ে নৌ-সড়ক পথে চলে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। নতুন কৌশল অবলম্বন করে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য সীমান্ত দিয়ে নিয়ে আসছে মাদক পাচারের একাধিক সিন্ডিকেট চক্র। এসব পয়েন্টে ভারত-বাংলাদেশের প্রায় দুসহ¯্রাধিকেরও বেশি রয়েছে মাদক কারবারি। আর রৌমারীতেই ছোট-বড় পাঁচ শতাধিকেরও বেশি। স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব, সীমান্তবর্তী ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসনের কিছু অসাধু ব্যক্তিদের মদদে ক্রমেই বাড়ছে মাদকের কারবার। জানা যায়, মাদক ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্ধ লেনদেন করছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইয়াবা সিন্ডিকেট চক্র হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে অর্থ পাঠাচ্ছেন। ফলে প্রায় প্রতিদিনেই আসছে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, মদসহ মাদকদ্রব্য। তবে পরিবহনে সহজলভ্য হওয়ায় অন্যান্য সীমান্তর তুলনায় রৌমারীর সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। ভারত-বাংলাদেশের যেসব সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে আসছে মাদকদ্রব্য। বাংলাদেশের রৌমারী-রাজিবপুর উপজেলার প্রায় সাড়ে ৪৬ কিমি সীমান্ত এলাকা জুড়ে রয়েছে বালিয়ামারী, মাখনেরচর, আলগারচর, খেওয়ারচর, বকবান্দা, ঝাউবাড়ি, বড়াইবাড়ি, চরফুলবাড়ি, নওদাপাড়া, খাইটয়ামারী, চর বামনেরচর, বেহুলারচর, গয়টাপাড়া, চর বোয়ালমারী, ধর্মপুর, খেতারচর, চর গয়টাপাড়া ও ডিগ্রীরচর। আর ভারতের সীমান্ত পয়েন্ট হলো শিংমারী, শিশুমারা, অসমের আলগা, গোধূলী, দ্বীপচর, কুকুরমারা, দিয়ারারচর, ঢালেরচর, কুসনিমারা, জোরডাংগা, সোনারপারা, মানকারচর, কাঁকরিপারা, কালাইরচর। ফুলবাড়ি উপজেলার ৩৬ কিমি সীমান্ত এলাকায় গোরকম-ল, কিসনান্দ বকসী, বালাটারী, বজেরকুটি, খলিশ কোটাল, করুষা-ফেরুষা, গাজিরটারী, রৌসন শিমুলবাড়ী, নন্দির কুটি, জুম্মার মোড়, চাঁন্দের বাজার, থোসবিদ্যাবাগিস, চোত্তাবাড়ি মোড়, নাখারজান, আজোয়াটারী, কাশিয়াবাড়ি, কাশিপুর, অনন্তপুর এবং উত্তর অনন্তপুর। এখানে ভারতের সীমান্ত পয়েন্ট হলো নয়ারহাট, মরাকুটি, খাবিদা হাবিদা, নারায়ণগঞ্জ, কিসামত করলা, দোল দেবিরপাট, ভাটিয়ারমোড়, বসকোটাল, থরাইখানা, ধাপরারহাট, সেউতি-১ ও সেউতি-২, চৌধুরীরহাট এবং সাহেবগঞ্জ। নাগেশ^রীর উপজেলায় সীমান্ত এলাকা প্রসাদের কুটি, নাগরাজ, মডায়টারী, শিঙ্গের ভিটা, চাটাম, সুভারকুটি, বালাবাড়ি, ধলুয়ারবাড়ি, বালারহাট। এখানে ভারতের সীমানা পয়েন্ট হলো বিন্নছড়া, নালিয়া, বামনহাট, চৌধুরীরহাট, গোলকগঞ্জ। ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সীমান্ত এলাকা শিংঝাড়, শালঝোড়, দিয়াডাঙ্গা, রাঙ্গালেরকুটি, বাগভান্ডার, বাশজানি, পাগলার হাট। এবং ভারতের সীমান্ত পয়েন্ট মশালডাঙ্গা, সাহেবড়ঞ্জ এবং কালজানি। একাধিক মাদক কারবারি এবং মাদক সেবীরা জানান, মাদক আসার প্রধান উৎসই হলো হুন্ডির টাকা। এই হুন্ডির টাকা বন্ধ করা গেলেই মাদক অনেকাংশে কমে যাবে। রৌমারীর আলগারচর সীমান্তে ভারতীয় মাদক ব্যবসায়ী হলেন ধুবড়ি জেলার মানকার চর থানার ফকিরবাট গ্রামের আমিরুল হক, সোনা মিয়া, ঝগড়ার চরের জহুরুলসহ প্রায় ৭/৮শ মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক বিজিবি সদস্য জানান, আলগার চরে সিংহভাগ মানুষই মাদকের সঙ্গে জড়িত। রাতের বেলা বিএসএফ সীমান্তে লাইটের আলো কমিয়ে দিয়ে ইয়াবা পাচার করে। আমাদের বিজিবি টহল টিম বের হলে স্থানীয় মাদককারবারিরা ফোনে জানিয়ে দেয়। ফলে টহল টিমের বিপরীত দিকে পাচার করে। এখানে ইয়াবা পাচারে মহিলারাই বেশি জড়িত। কেননা তারা গরু-ছাগলকে ঘাস খাওয়াতে গিয়ে ইয়াবার প্যাকেট বুকের মধ্যে বা শরীরের বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে পার করে থাকে। স্থানীয় অনেক জনপ্রতিনিধি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় মাদক নির্মূল করা যাচ্ছে না। পুলিশ সুপার মহিবুল ইসলাম খান-বিপিএম জানান, সচেতনতা বৃদ্ধিসহ অভিযান জোরদার করা হয়েছে।মাদককারবারিসহ মানিলন্ডারিংকারীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে এবং দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি আশ^াস দেন।
×