ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অতীতে ছিল অবহেলিত এখন আদৃত- থোকায় থোকায় ঝুলছে গাছে

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ২ জুলাই ২০১৯

অতীতে ছিল অবহেলিত এখন আদৃত- থোকায় থোকায় ঝুলছে গাছে

সমুদ্র হক ॥ নিকট অতীতের অপরিচিত ও অবহেলিত ফলটির আসন এখন রাজকীয়। দেশীয় ফল লটকন। বর্ষায় পেকে ঝুলছে গাছে থোকায় থোকায়। দক্ষিণ এশিয়ায় এই বৃক্ষের পরিচিতি বুনো গাছ। বাংলাদেশে টকের সঙ্গে মিষ্টি মিশ্রণে আলাদা স্বাদের হয়ে এই ফলের কদর দিনে দিনে বেড়েছে। দেশের প্রতিটি এলাকায় দেখা মেলে লটকন বৃক্ষের। লটকনের ইংরেজী নামটিও সুন্দর- বার্মিজ গ্রেপ। বাংলা অর্থে- বার্মিজ আঙ্গুর। দেশে লটকনের অঞ্চলভিত্তিক নাম আলাদা। যেমন চট্টগ্রামে হারফাড়া, সিলেটে রুবী, ময়মনসিংহে কানাইজু, কোথাও লটকাউ, কিচিম, লটকা। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নাম- রামবাই, রামবি, লামখাই, রোমাই, মাফিফ্রাং ইত্যাদি। বিজ্ঞান নাম- বাকাউরিয়া মলটিয়ানা। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড লটকনের চাষ সবচেয়ে বেশি। ওই দেশে রাতে খাওয়ার পর লটকন ঐতিহ্যের অংশ। অতিথিদের লটকন পরিবেশন সামজিক রীতি। বাংলাদেশের গ্রামের কৃষক ও গৃহস্থ পরিবার লটকন চারা রোপণ করে ফলটির সঙ্গে পরিচিত করে দিচ্ছে। দেশের নরসিংদী জেলার বেলাগো উপজেলার লাখপুর গ্রামটি ‘লটকন গ্রাম’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। কেন এই নামে পরিচিতি এর উত্তর মেলে- ওই গ্রামে এত বেশি লটকন গাছ আছে এবং গাছগুলোতে এত ফলন যে লোকজনের কাছে গ্রামের নাম লটকন প্রিয় হয়ে উঠেছে। বগুড়ার হর্টিকালচার সেন্টারে গত ক’বছর ধরে বারি-১ জাতের চারটি লটকন গাছ ফলন দিচ্ছে। তারা চারা বিক্রি করছে। এ ছাড়াও ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, রাজশাহী, পাবনা অঞ্চলসহ প্রতিটি এলাকায় লটকনের চাষ বেড়েছে। লটকন বৃক্ষ বড়। উচ্চতা ১২ থেকে ১৫ মিটার। ওপরের অংশ ঝোপালো অর্থাৎ জোড়ালো শাখা-প্রশাখা। লটকনের কোন চারা পুরুষ ও স্ত্রী তা সহজে বোঝা যায় না। দশটি চারার মধ্যে সাতটিই মেলে পুরুষ। প্রকৃতির পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় স্ত্রী চারায় ফল হয়। যে কারণে স্ত্রী গাছের কলম চারাতেই লটকন বৃক্ষ রোপণ হয় বেশি। দশ বছরে গাছ লম্বা হয়ে প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় বছরে ২শ’ থেকে ৪শ’ কেজি করে ফল ধরে। তবে লটকন গাছ বেড়ে ওঠার তিন-চার বছরের মধ্যে ফল ধরতে শুরু করে। প্রতিটি গুচ্ছ বা থোকায় থাকে ২৫ থেকে ৩৫টি লটকন। ফলের আকার ২ থেকে ৫ সেন্টিমিটার। প্রতিটির ওজন ১০ থেকে ২০ গ্রাম। ফল দেখতে অনেকটা ডুমুরের মতো। প্রতিটি ফলের মধ্যে অতি ছোট ২ থেকে ৫টি বীজ মেলে। বীজের চারদিকে লাগানো থাকে খাওয়ার অংশ। বলা হয় লটকনের কোয়া। হলদেটে রঙের লটকন ফুল ও ফল দুই-ই সুগন্ধী। লটকন সরাসরি খাওয়া যায়। পুষ্টিগুণ অনেক। ভিটামিন ‘বি’, বি-১, বি-২, ভিটামিন ‘সি’, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন। প্রতিদিন মানবদেহে যে পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ দরকার মাত্র চারটি লটকন তা পূরণ করে। পাকা লটকন তৃষ্ণা নিবারণ করে মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক। লটকনের পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে পানিতে গুলিয়ে খেলে পুরানো জ্বর, চর্ম রোগ, ডায়রিয়া দূর করে। লটকন বৃক্ষ বেশি রোদ সইতে পারে না। বৃক্ষ রোপণে দরকার ছায়াযুক্ত স্থান। বসন্তে ফুল ফোটে বর্ষায় ফল পেকে খাওয়ার উপযুক্ত হয়। এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে লটকন বৃক্ষ রোপণের উপযুক্ত সময়। লটকন গাছের ছাল বাকর থেকে এক ধরনের রং বের হয়। যা রেশম সুতা রঙিন করতে ও পেইনটিংয়ে ব্যবহার হয়। লটকন ফল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রথ যাত্রার অন্যতম প্রয়োজনীয় উপকরণ। রথযাত্রার সঙ্গে লটকনের নিবির সম্পর্ক রয়েছে, এমনটি মনে করেন পুরোহিতগন। বাংলাদেশের ধামরাই টাঙ্গাইল, ভারতের কোচবিহার ও নবদ্বীপে রথযাত্রা এবং উল্টো রথে লটকন অতি প্রয়োজনীয় ফল। দেশের বিভিন্ন স্থানে লটকন ফল নিয়ে নানা ধরনের গল্প আছে। তবে তা সবই লৌকিক। লোকজ ঐতিহ্যে পুঁথি পাঠ, পালা গান, কবি গানে লটকন নিয়ে অনেক কথা রচিত হয়েছে।
×