ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফেনীর আদালতে চার্জশীট জমা

মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের ফাঁসি চায় পিবিআই ॥ নুসরাত হত্যা মামলা

প্রকাশিত: ১০:০৪, ৩০ মে ২০১৯

  মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের ফাঁসি চায় পিবিআই ॥ নুসরাত হত্যা মামলা

নিজস্ব সংবাদদাতা, ফেনী, ২৯ মে ॥ ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন, পৌর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও পৌর কমিশনার মাকসুদ আলমসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট জমা দিয়েছে পিবিআই। এ ১৬ জনের মধ্যে ৮ জন এজাহারভুক্ত। মামলার তদন্তে বাকি ৮ জনের নাম এসেছে। বুধবার বেলা সোয়া দুইটায় ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ জাকির হোসেনের আদালতে পিবিআইয়ের মামলা তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর শাহআলম চার্জশীট জমা দেন। চার্জশীটে অন্তর্ভুক্ত ১৬ জনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রত্যাশা করেছে পিবিআই। অন্যদিকে নুসরাতের পরিবার দোষীদের মৃত্যুদন্ডসহ মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। বিশেষ পুলিশ সুপার পিবিআই চট্টগ্রাম বিভাগ চট্টগ্রাম মোঃ ইকবাল জানান, গত ১০ এপ্রিল মামলাটি পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তরের পর ৪০ ঘণ্টার মধ্যে নুসরাত হত্যার সঙ্গে জড়িত মূল আসামিদের পিবিআই গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এ মামলা তদন্ত শেষ করে ৫০ দিনের মধ্যে দোষীদের বিরুদ্ধে আদালতে ৮০৮ পাতার চার্জশীট জমা দেয় পিবিআই। ৫০ দিনের মধ্যে ৩৩ দিন কার্যদিবস থাকলেও তদন্ত টিম ছুটির দিনেও দিনরাত কাজ করে মামলার তদন্ত কাজ শেষ করেছে। আলোচিত এ মামলায় শেষ পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও পিবিআই। এদের মধ্যে এজাহারভুক্ত ৫ জনসহ ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। একই সঙ্গে পিবিআই এটি একটি চঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে মামলার সাধারণ কর্মকান্ডের বাইরে ব্যতিক্রমভাবে মামলার সাক্ষী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ৭ জনের সাক্ষ্য ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী হিসেবে আদালতে রেকর্ড করে নিয়েছে, যা মামলার বিচারে কাজে লাগবে। এ মামলায় ১৬১ ধারায় জবানবন্দী দেয়া ৬৯সহ ৯২ সাক্ষীর নাম চার্জশীটের সাক্ষীর তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার আলামত হিসেবে ১০ জিনিস জব্ধ করে আদালতে জমা দিয়েছে পিবিআই। বর্তমানে এ মামলায় গ্রেফতার হওয়া ২১ জন ফেনী কারাগারে। নুসরাতের মা শিরিন আক্তার মামলার চার্জশীটে যাদের এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের দাবি জানিয়েছেন। ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে ॥ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কক্ষে ডেকে নিয়ে গত ২৬ মার্চ ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোঃ এসএম সিরাজউদদৌলা। এ ঘটনায় গত ২৭ মার্চ নুসরাতের মা শিরিন আক্তার মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজউদদৌলার বিরুদ্ধে সোনাগাজী থানার মামলা দায়ের করেন। সোনগাজী থানা পুলিশ ২৭ মার্চ সিরাজউদদৌলাকে গ্রেফতার করে। এ অবস্থায় মামলাটি উঠিয়ে নেয়ার জন্য সিরাজউদদৌলার পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে নুসরাতকে চাপ দেয়া হয়। কিন্তু নুসরাত মামলা উঠিয়ে নিতে অপারগতা জানায়। এক পর্যায়ে বর্তমান চার্জশীটভুক্ত কয়েক আসামি সিরাজউদদৌলার পক্ষে তার মুক্তির দাবিতে সোনাগাজী থানা ঘেরাওসহ সোনাগাজী বাজারে মানববন্ধন করে। এ অবস্থায় নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে আলীম বোর্ড পরীক্ষা শুরুর দিন থেকে নুসরাতকে তার ভাই নোমান পরীক্ষার হলে বসিয়ে দিয়ে আসত। ৬ এপ্রিল শনিবার সকালে বোনকে পরীক্ষার হলে বসিয়ে দেয়ার জন্য মাদ্রাসা এলাকায় প্রবেশের সময় মাদ্রাসার পিয়ন মোস্তফা ভেতরে প্রবেশে নোমানকে বাধা দেয় এবং নুসরাত নিজে পরীক্ষার হলে বসতে পারবে বলে নোমানকে বাইরে থাকতে বলে। নুসরাত পরীক্ষার হলে গিয়ে বসলে সিরাজউদদৌলার অনুসারী ছাত্রী পপি পরীক্ষার হলে এসে নুসরাতের বান্ধবী নিশাতকে ছাদে কারা যেন মারধর করছে বলে নুসরাতকে হল থেকে ডেকে ছাদে নিয়ে যায়্। ছাদে অবস্থান করা সিরাজউদদৌলার কয়েক অনুসারী এ সময় সিরাজউদদৌলার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি উঠিয়ে নেয়ার জন্য নুসরাতকে চাপ দেয়। এতে নুসরাত রাজি না হওয়ায় সিরাজউদদৌলার অনুসারীরা নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন নিয়ে চিৎকার দিয়ে নুসরাত ছাদ থেকে নিচে দৌড়ে নেমে আসে। এ অবস্থার খবর পেয়ে ভাই নোমানসহ স্থানীয় কয়েকজন অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে প্রথমে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। ফেনী হাসপাতালে নুসরাতের অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকলে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ৫ দিন পর ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়। পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে তার জানাজা শেষে সোনাগাজীর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। নুসরাত মারা যাওয়ার আগে তাকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলাকে প্রধান আসামি করে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৪/৫ জনকে আসামি করে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করে। নুসরাতের মৃত্যুর পর মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে আমলে নেয়া হয়। নুসরাতের শ্লীলতাহানির চেষ্টা থেকে শুরু করে তার শরীরে আগুন দেয়া পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনায় সোনাগাজী থানা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তার পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করতে পিবিআইয়ের কাছে মামলাটি হস্তান্তরের আদেশ দেয় পুলিশ সদর দফতর।
×