ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মজুদ বেশি থাকার পরেও রমজান সামনে রেখে দাম বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ২৪ এপ্রিল ২০১৯

মজুদ বেশি থাকার পরেও রমজান সামনে রেখে দাম বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের

এম শাহজাহান ॥ চাহিদার তুলনায় মজুদ বেশি থাকার পরও রমজান সামনে রেখে বেড়ে যাচ্ছে ভোগ্যপণ্যের দাম। সারাদেশে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করার নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া কারসাজি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হলে জড়িত ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়ে গেছে রসুন, আদা, পেঁয়াজ ও ছোলার দাম। মানভেদে ৫৫০-৫৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি গরুর মাংস। এছাড়া চিনি ও ভোজ্যতেলের দামও বাড়তির দিকে। শব-ই বরাতের একদিন পর থেকে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ভোক্তাদের কষ্ট বাড়ছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি থাকতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, রমজানে বেশি ব্যবহার হয় এমন ছয় পণ্যের মজুদ বেশি থাকার পরও দাম বেড়ে যাচ্ছে। ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, ছোলা, মসুর ডাল, খেজুর ও চালের মজুদ, আমদানি এবং এলসি খোলার সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এসব পণ্যের কোন ঘাটতি নেই। বরং পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, আসন্ন রমজান উপলক্ষে ৮ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজের এলসি খোলা হয়েছে। এরমধ্যে চলতি মাসের মাঝামারি সময় পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৮২ হাজার টন। শুধু রমজানে এ পণ্যের চাহিদা রয়েছে ৫ লাখ টন। ফলে চাহিদা অনুযায়ী আমদানি বেশি হয়েছে। বতর্মান ৩ থেকে ৫ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি আমদানিকৃত ২৪-২৮ এবং দেশী পেঁয়াজ ২৬-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। এছাড়া রমজানে প্রায় ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদা থাকলেও মার্চ মাস পর্যন্ত আমদানি করা হয় ৮৯ হাজার ৩৯০ টন এবং এলসি খোলা হয়েছে ৮৪ হাজার ৭৪৮ টনের। ফলে তথ্য অনুযায়ী চাহিদার চেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে। বর্তমান বাজারে এক কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৯০ টাকায়। দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশে পর্যাপ্ত মসুর ডাল আমদানি করা হয়েছে রমজান উপলক্ষে। এরমধ্যে রমজানের চাহিদা হচ্ছে ৮০ হাজার মেট্রিকটন। এ সময় আমদানি করা হয় ১ লাখ ৮৭ হাজার টন এবং এলসি খোলা হয়েছে ১ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিকটন ডালের। রমজানে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য হচ্ছে ভোজ্যতেল। এ পর্যন্ত এ পণ্যটি আমদানি করা হয়েছে ১৪ লাখ ৬৯ মেট্রিকটন এবং এলসি খোলা হয়েছে ১৭ লাখ ৬৬ হাজার টন। এ পণ্যের রমজানে চাহিদা হচ্ছে ৩ লাখ মেট্রিকটন। রোজার চাহিদাকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা চিনিও পর্যাপ্ত আমদানি করেছে। রোজায় চিনির চাহিদা হচ্ছে ৩ লাখ মেট্রিকটন। এ পর্যন্ত আমদানি করা হয়েছে ১০ লাখ ৭০ হাজার টন। পাশাপাশি এলসি খোলা হয়েছে ১৪ লাখ ৪৭ হাজার টন। রোজার চাহিদার কয়েকগুণ বেশি চিনি আমদানি হয়েছে। তবে আসন্ন রমজানকে সামনে খেজুর আমদানির পরিমাণ এখন পর্যন্ত কম আছে। রমজানে খেজুরের চাহিদা হচ্ছে ১৮ হাজার টন। এ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১২ হাজার ২৯৯ টন। যদিও সরকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবি খেজুর বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া ৫০ টাকার খোলা চিনি এখন ৫২-৫৫ এবং মসুর ডাল ৫৫-১১০ এবং প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন ৭৮-৮৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে, রমজানের আগে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তারা অস্বস্তিতে রয়েছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত বৈঠকে রোজায় পণ্যের দাম না বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু অধিক মুনাফা লাভের আশায় তারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখেননি। রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বিভাগীয় কমিশনারদের চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই চিঠিতে বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সারা বছরের মতো রমজানের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ভোক্তা সাধারণের কাছে ন্যায্যমূল্যে মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। স্থানীয় পর্যায়ে পণ্যের মূল্য সহনীয় রাখার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য যাতে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, সে বিষয়টি নিশ্চিতের লক্ষ্যে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন। চিঠিতে তিনি আরও বলেন, জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রমজানে ভেজালবিরোধী অভিযান জোরদার করা প্রয়োজন। দেশের সব জেলা ও উপজেলায় বাজারে পণ্য সরবরাহ ও মজুদ অটুট রাখা, নির্বিঘেœ পণ্য পরিবহন, অবৈধ মজুদ প্রতিরোধ এবং পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত কার্যক্রম জোরদারসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য আপনার আন্তরিক উদ্যোগ ও সহযোগিতা কামনা করছি। এদিকে, রমজান সামনে রেখে গরুর মাংসের দাম কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিকেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫৫০-৫৮০ টাকায়। দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। মাংস ব্যবসায়ীরা বলছে, গরুর দাম বেশি, অন্যদিকে চামড়ার দাম কম। এ কারণে মাংসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া ইফতারিতে বেশি ব্যবহার হয়-খেজুরের দাম বেড়ে গেছে। প্রতিকেজি মরিয়ম খেজুর ৭৫০ টাকা, কালমি ৬৫০ টাকা, ডাব্বাস ২৬০ টাকা, নূর খেজুর ৬০০, ইরানী মরিয়ম ৭০০ টাকা, তিউনিশিয়া ৩০০ টাকায় প্রতিকেজি পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ১২০ টাকা ও ২২০ টাকা দামের খেজুরও রয়েছে বাজারে। মৌলভীবাজারের খেজুর ব্যবসায়ীরা বলছে, এ বছর আমদানি কম হয়েছে। অন্যদিকে বাড়ছে চাহিদা। এ কারণে দাম একটু বেড়ে গেছে। জানা গেছে, এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বাজারের ওপর নজর রাখবেন সংশ্লিষ্টরা। যেকোন প্রকার পণ্যে মূল্যের কারসাজি অথবা কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথাও ভাবছে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল। রমজানে চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে পণ্যের আমদানি ও মজুদের মধ্যে সমন্বয় রাখতে ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক থাকলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কোন সুযোগ নেই বলে মনে করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের ভোগপণ্যের দাম নি¤œমুখী ধারায় রয়েছে। কিন্তু দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এছাড়া কারসাজি করে দ্রব্যমূল্য বাড়াতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র রয়েছে ঢাকার মৌলভীবাজার, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এবং নারায়ণগঞ্জ বন্দরে। এছাড়া ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক পর্যায়েও বড় ধরনের কারসাজির কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে।
×