ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাখা বন্ধ, কর্মকর্তারা লাপাত্তা

কো-অপারেটিভের নামে ২৩০ কোটি টাকা লোপাট

প্রকাশিত: ১১:১৯, ১১ এপ্রিল ২০১৯

কো-অপারেটিভের নামে ২৩০ কোটি টাকা লোপাট

রহিম শেখ ॥ ফেরদৌসি বেগম। থাকেন রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী এলাকায়। তার একমাত্র সন্তান কাজ করেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। তিন বছর আগে সন্তানের উপার্জিত ৩ লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এ্যান্ড ফাইন্যান্স ব্যাংক লিমিটেডের যাত্রাবাড়ী শাখায়। গত জানুয়ারি মাসে মুনাফাসহ আমানতের টাকা তুলতে গেলে নয়ছয় শুরু করে আজিজ কো-অপারেটিভ। এভাবে গত তিন মাস ঘুরে এক টাকাও পাননি তিনি। গত সপ্তাহ থেকে শাখাটির কার্যক্রম বন্ধ। কর্মকর্তারাও লাপাত্তা। প্রায় প্রতিদিনই শাখাটির সামনে এসে বসে থাকেন ফেরদৌসি বেগম। জনকণ্ঠকে জানালেন, দ্বিগুণ মুনাফার আশায় পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে টাকা জমা রেখেছিলেন। বললেন, এই টাকা না পেলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেন। আজিজ কো-অপারেটিভের প্রতারণার শিকার ফেরদৌসি বেগমের মতো এমন গ্রাহকের সংখ্যা দেশে ৫৮৩৩ জন। সারাদেশের ৭১ শাখা থেকে ২৩০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে তা ফেরত দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। উল্টো দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ শাখা বন্ধ করে দিয়েছে আজিজ কো-অপারেটিভ। গ্রাহকের আমানত আত্মসাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়া আজিজ কো-অপারেটিভের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানিয়েছে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হিসাব জব্দ করতে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু হিসাব জব্দ করার আগেই উধাও হয়ে গেছেন কো-অপারেটিভটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই দেশের সব শাখার সাইনবোর্ডে ‘এসিসিএফ ব্যাংক’ লিমিটেড শব্দটি জুড়িয়ে দেয়া আছে। এছাড়া সমবায় সমিতি আইনের তোয়াক্কা না করেই নামের শেষে যুক্ত করা হয়েছে ‘কমার্স এ্যান্ড ফাইন্যান্স’ শব্দ। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটিতে সঞ্চয়ের সুরক্ষা না থাকায় গত বছরের মার্চে সতর্কতামূলক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর অবৈধ ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম বন্ধ তো দূরের কথা উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধেই আদালতে একটি রিট করে আজিজ কো-অপারেটিভ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে অর্থমন্ত্রী বরাবর চিঠি দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তবে তাদের এ ধরনের আচরণে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ওই সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। জানা গেছে, বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া ‘ব্যাংক’ শব্দটি ব্যবহারের সুযোগ নেই। সমবায় সমিতির সংশোধিত আইনেও ব্যাংক শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ বিষয়ে সংশোধিত সমবায় সমিতি আইন ৯-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, নিবন্ধিত বা নিবন্ধনের জন্য প্রস্তাবিত কোন সমবায় সমিতির নামের সঙ্গে কমার্স, ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট, লিজিং, ফাইন্যান্সিং প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা, চেক ইস্যু ও আন্তঃশাখা লেনদেন করতে পারবে না। একটির বেশি শাখা থাকবে না। তবে কোন সমবায় সমিতি তাদের নামে ব্যাংক শব্দ নিয়ে নিবন্ধিত হয়ে থাকলে তা ৩ মাসের মধ্যে সংশোধন করে নিবন্ধককে অবহিত করতে হবে। এ আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৭ বছরের কারাদ- বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবে। আইনে বলা হলেও সেটি মানা হচ্ছে না। কিন্তু আজিজ কো-অপারেটিভের প্রধান কার্যালয়সহ সারাদেশের ৭১ শাখায় সাইনবোর্ডে ইংরেজীতে বড় অক্ষরে এসিসিএফ ব্যাংক লিমিটেড লেখা আছে। তাছাড়া কমার্স ও ফাইন্যান্স শব্দটি প্রতিষ্ঠানটির নামের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে। গত সোম ও মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ী এলাকার শহীদ ফারুক সড়কের ৯২ নম্বর ভবনে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির শাখায় গিয়ে দেখা যায়, বাইরে থেকে তালা দেয়া। এক নিরাপত্তা কর্মী জনকণ্ঠকে জানান, গত সপ্তাহ থেকে শাখার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ। অফিসে কোন কর্মকর্তা আসছে না। সেখানে কথা হয় ভুক্তভোগী কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে। মাসিক কিস্তিতে ৫ বছরে প্রায় ৩ লাখ টাকা জমা দেন নাসিমা বেগম। মুনাফাসহ ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা দেয়ার কথা তাকে। কিন্তু এক মাস ঘুরেও কোন সুদ-আসলসহ কোন টাকাই পাননি তিনি। জনকণ্ঠকে তিনি জানান, ‘টাকার জন্য গেলে তারা বলে কাল আসেন, পরশু আসেন। এরপর গেলে বলে, আগামী সপ্তাহে আসেন।’ তিনি বলেন, আমি তাদের হাতে পায়ে ধইরা বলছি, আমার লাভ দরকার নেই, আসল দেন। এখন অফিস বন্ধ কইরা পালাইছে। হেড অফিসে গেলেও কেউ দেখা করে না। আলমগীর হোসেন নামে একজন গ্রাহক জনকণ্ঠকে বলেন, টাকা না দিয়া কর্মকর্তারা পালাইছে। মতিঝিলের হেড অফিসে গেলে কেউ দেখা করে না। আলমগীর হোসেনের মতে, কার কাছে অভিযোগ করবেন জানেন না তিনি। আমানতের টাকা পেতে প্রতিদিনই রাজধানীর বিজয়নগরে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে আমানতকারীরা ভিড় করছেন। কার্যালয়ে ঢোকার পথেই তাদের শুনিয়ে দেয়া হচ্ছে ‘প্রতিষ্ঠানটি আর নেই’। ভেতরে ছোট পদের কয়েক কর্মকর্তা কাজ করলেও আমানতকারীদের সঙ্গে দেখা করছেন না তারা। আমানতকারীদের কেউ কেউ জোর করে কথা বলার চেষ্টা করলে কার্যালয়ের ভেতরের দেয়ালগুলোতে টাঙিয়ে রাখা একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছবি দেখিয়ে আশ্বস্ত করা হচ্ছে যে, ভবনটি নির্মাণ শেষ হলে তাদের টাকা ফেরত দেয়া হতে পারে। গত মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির বিজয়নগরের কার্যালয়ে ঢুকতেই রিসিপশনে থাকা দুজন কর্মী নিজেদের নাম গোপন করে জনকণ্ঠকে জানান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এখন আর অফিসে আসেন না। কোম্পানি আছে কি নেই, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। প্রিন্সিপাল অফিসার পরিচয় দিয়ে মিজানুর রহমান নামের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, সারা দেশে ৭১ শাখার মাধ্যমে ২৩০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। বাকি ২০০ কোটি টাকা দিয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে। তাই আমানতকারীদের পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এখন কো-অপারেটিভের কাছে কোন টাকা নেই। সে সময় মোট আমানতকারীর সংখ্যা জানতে চাইলে, তিনি তা জানাতে পারেননি। মার্কেট নির্মাণের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে মিজান বলেন, ১২ তলা ভবনের ৮ তলা পর্যন্ত নির্মাণ হয়েছে। ফ্লোরও বিক্রি হচ্ছে। ফ্লোর বিক্রির টাকা কোথায় যাচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করেননি। তবে নির্মাণাধীন ভবনের যে রঙিন ছবি অফিসটিতে রয়েছে, তাতে ভবনটি আট তলাবিশিষ্ট; ১২ তলা নয়। সরেজমিনে অফিস ঘুরে দেখা যায়, উর্ধতন কর্মকর্তারা যেসব কাচঘেরা কক্ষে অফিস করতেন, সেসব কক্ষের সামনে থেকে নেমপ্লেটগুলো তুলে নেয়া হয়েছে। কাচের দেয়ালে নেমপ্লেট থাকার ছাপ রয়ে গেছে। এমডি আছেন কি না জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘এমডি আছেন, তবে বাইরে।’ এমডির নাম, মোবাইল নম্বর জানতে চাইলে জানাতে পারেননি তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে আজিজ কো-অপারেটিভের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করার অনুরোধ করা হয়েছে। পরে এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত জানাতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে ১৩ মার্চ চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলে কো-অপারেটিভটির সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে লেখা সমবায় মন্ত্রণালয়ের চিঠির তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে ৭১টি শাখা খুলে আজিজ কো-অপারেটিভ ৫ হাজার ৮৩৩ সদস্যের কাছ থেকে ১১২ কোটি ৪১ লাখ টাকা আমানত নিয়েছে। মেয়াদ পূর্তির পরও বিভিন্ন অজুহাতে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিচ্ছে না তারা। কো-অপারেটিভটির ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও সময়মতো নির্বাচন দেয়া হয়নি। সমবায় অধিদফতর অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে তাদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের নির্দেশ দিলেও তা মানা হয়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির নির্দেশে অবৈধভাবে আমানতকারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেড বা আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এ্যান্ড ফাইন্যান্স ব্যাংক লিমিটেডের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে বলেছে সমবায় মন্ত্রণালয়। আজিজ কো-অপারেটিভের অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পর্কে গ্রাহকদের সতর্ক করতে ২০১৭ সালের মার্চে বিভিন্ন পত্রিকায় সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে কো-অপারেটিভটির রংপুর স্টেশন রোডের শাখা পরিদর্শনে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ ব্যাংকিংসহ নানা অনিয়ম পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। গণবিজ্ঞপ্তি প্রচারের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে দুটি রিট মামলা করেছে কো-অপারেটিভটি। ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চলমান থাকলে এবং প্রতিষ্ঠানটির দ্বারা সংঘটিত অনিয়মাদি রোধ করা না গেলে আর্থিক খাতে অচিরেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। এ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির দ্বারা সংঘটিত অনিয়ম ও অবৈধ ব্যাংকিং কার্যাবলি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক।
×