ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

ধ্রুপদ মানব মুহম্মদ খসরু

প্রকাশিত: ১২:০১, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ধ্রুপদ মানব মুহম্মদ খসরু

শাহবাগ থেকে হাঁটতে হাঁটতে ভরদুপুরে আমরা চলে গিয়েছিলাম নবাবপুর রোডে। সেখানে গলির মুখেই ভাতের হোটেল ‘শান্তি হোটেল’। বালতিতে ভাত, ডাল আর সবজি এবং মাছ নিয়ে আসা লোকটি কাঁসার থালায় আমাদের খাবার বেড়ে দিল। গোগ্রাসে খেয়েছিলাম বলা যায়। সালটা ১৯৭৮। এ রকম প্রায়ই আমরা যেতাম পুরান ঢাকায় খাবারের সন্ধানে। অধিকাংশ হোটেলই ছিল মুহম্মদ খসরুর পূর্ব পরিচিত। কোন খাদ্যেই ছিল না আমাদের অরুচি। নিত্য নতুন হোটেলে খাবারের বিষয়টি আমার বন্ধু মহলও জেনে গেল। তাই এক সময় দেখা গেল, বন্ধুবর কবি রুদ্র, আলী রীয়াজ মইনুদ্দিন খালেকরাও সঙ্গী হয়ে গেল। মাঝে মধ্যে খেয়ে দেয়ে বিকেলে যেতাম ধানম-ি দুই নং সড়কে জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বা ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। বিদেশী চলচ্চিত্রের দর্শক হিসেবে আমিও বেশ চলচ্চিত্র নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েছিলাম। সে সুবাদে মুহম্মদ খসরুর নেতৃত্বাধীন ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ আমার এবং সহপাঠী অনেক বন্ধুদের। সিনেমা সম্পর্কে আমাদের চোখ-কান খুলে দিয়েছিলেন তিনি। ভাল এবং উন্নতমানের সিরিয়াস সিনেমা দেখার আগ্রহটা তিনিই তৈরি করে দিয়েছিলেন আমাদের প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে। চলচ্চিত্রের বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত করেছিলেন আমাদের সামনে। মুহম্মদ খসরুর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৪ সালে অভাবিতভাবেই। তার নামের সঙ্গে পরিচয় আরও আগেই চলচ্চিত্র বিষয়ক সাময়িকীতে লেখা পড়ে ও চিত্র দেখে। আরও বিশাদ জানা হয়। ওই বছর ঢাকায় ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্সের আয়োজন করেছিল ফিল্ম সোসাইটি। পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ সতীশ মাখুর ছিলেন কর্মশালার প্রধান বক্তা। সে নিয়ে চিত্রালী, পূর্বাণীতে, এমনকি দৈনিকেও ফিচার ছাপা হয়েছিল। তাতে খসরুর বক্তব্যও ছিল। চুয়াত্তর সালের গোড়ায় আমার ছোট আপার বিয়ে হয় বর ছিলেন খসরুর ঘনিষ্ঠজন এবং ফিল্ম সোসাইটির কর্মকর্তা চলচ্চিত্রকার বাদল রহমানের খালাত ভাই, যিনি ওই কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলেন। ঢাকা ও পাকিস্তানের সিনেমা দেখা এই আমি তেহাত্তর সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিদেশী ছবি ‘বাইসাইকেল থিফ’, এ্যান্ড অব দ্য সঙ; বুচ কাসিতি সিনেমা পত্রিকার মনোযোগী পাঠক হিসেবে (স্কুল জীবন থেকেই) আরও অনেক চিত্র পরিচালক ও সিনেমার নাম মুখস্থ ছিল। ইনগ্রিড বার্গম্যান, বার্তোলুচিং ডিসিকার নাম জানা ছিল। আমার এই স্বল্পজ্ঞান তাকে অবাকই করেছিল। আমি তখন ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তার কাছে মনে হয়েছিল, আমার জানার পরিধি অনেক বেশি। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি মুহম্মদ খসরুর সুবাদে। বিকেলের দিকে তিনি আসতেন শাহবাগে। মৌলি বা সিনোরিটায় বসতেন। আমাদের শিল্প ও সাহিত্যমোদী বন্ধুরাও সেখানে আড্ডা জমাতেন। খসরু ভাইয়ের খিস্তিখেউরের সঙ্গে পরিচয় তখন থেকেই। বন্ধুদের সঙ্গে আমিও আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের সদস্য হয়ে নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখা শুরু করি। শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় ও সোমবার রাত সাড়ে ৮টায় ফরাসী সিনেমা দেখানো হতো। ইংরেজী সাবটাইটেল থাকত। সমস্যা হতো টাইটেল পড়তে গেলে ছবি দেখায়। তাই শুক্রবার ছবি দেখতাম ও সোমবারে টাইটেল পড়তাম। খসরু ভাইও মাঝে মধ্যে আসতেন। আর জমে উঠত ক্যান্টিনে জম্পেশ আড্ডা। মুহম্মদ খসরুর ঝোলায় ক্যামেরাও থাকত। ছবিও তুলতেন। পরে জানলাম, তিনি বিসিকের আলোকচিত্রী। মুহম্মদ খসরু স্বপ্ন দেখাতেন চলচ্চিত্র নির্মাণের। বরেণ্য কথাকার হাসান আজিজুল হকের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক গল্প ‘ফেরা’র চিত্রনাট্য তৈরি করলেন। মাঝে মাঝে পাঠ করে শোনাতেন। প্রযোজকের সন্ধানে ছিলেন। পেয়েছিলেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রের প্রযোজকদের একজনকে। নারায়ণগঞ্জবাসী এই ভদ্রলোক খুন হয়ে যান এক রেস্তরাঁয়। ফলে সিনেমা নির্মাণের স্বপ্নে মাকড়সা বাসা বাঁধে। ঊনআশি সালে আমি ডাকসুর সদস্য ও আশি সালে সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়ার পর মুহম্মদ খসরুর গালিগালাজের পরিমাণটা বেড়ে গিয়েছিল। ‘আওয়ামী কবি’ বলে অযথাই সম্বোধন করতেন, আর আমি যখন ‘দুলাভাই’ ডাকতাম তিনি বিব্রত হতেন। ১৯৭৯ সালের দিকে শান্তি নিকেতন ছেড়ে চলে আসেন সেগুনবাগিচায়, জ্ঞান তাপস কাজী মোতাহের হোসেনের বাসার সিঁড়ি ঘরে একটি ছোট রুমে। সেখানেও যেতাম। অবশ্যই বই পড়ার লোভে। ইউআর অনন্তমূর্তি নামে এক ভারতীয় লোকের বই পড়েছিলাম তারই উৎসাহে একবার বৃষ্টির দিনে জানালা খোলা থাকায় বইপত্র ভিজে গেল, তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন ‘ধ্রুপদী’ বের করার পর আমার কাজ ছিল গোটা বিশেষ কপি বিক্রি করে দেয়ার। বন্ধুরা সিনেমাতে আগ্রহী হলেও ধ্রুপদী পাঠে ছিল অনাগ্রহী। সিনেমাবিমুখ আত্মীয়স্বজনদের কাছেই বিক্রি করতে হতো। খসরু ভাই আমার পোট্রেট তুলেছিলেন একবার ডাকসু নির্বাচনে ব্যবহার করার জন্য। করেও ছিলাম। ঋত্বিক ঘটকের প্রতি আমার আগ্রহ বাড়িয়ে তুলেছিলেন তিনিই। সে সুবাদে ঋত্বিকের লেখা গল্পও পড়েছিলাম। খসরু ভাই সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন, আমরাও স্বপ্ন দেখতাম তার নির্মিত ছবির দর্শক হব। কিন্তু তা আর হয়নি। খসরু ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি কলাতিয়ায় গিয়েছিরাম। খসরু ভাইয়ের বাসা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে সহপাঠী বন্ধু তারেক মাসুদের সঙ্গে দেখা হতো। দু’জন ছিলেন দু’ধারার। মুহম্মদ খসরু নেই এমনটা মনেও আসে না। আমাদের তারুণ্যের অনেকটা অংশ জুড়েই রয়েছেন মুহম্মদ খসরু। যাকে আমি ধ্রুপদী মানব হিসেবেই দেখতাম। তিনি নেই, আমাকে আর কেউ গালিগালাজও করবে না পরিচালিত খিস্তিখেউর ও আর শোনা হবে না। তিনি থাকবেন আমাদের কর্ম ও মননজগতে।
×