ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চকবাজারে অগ্নিকান্ডের পর সামনে এসেছে প্রশ্নটি

বাসা ও যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার কতটা নিরাপদ

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 বাসা ও যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার কতটা নিরাপদ

শাহীন রহমান ॥ পুরান ঢাকার চকবাজারের অগ্নিকান্ডে বিপুল প্রাণহানির সূত্রপাত মূলত সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে। এ ঘটনা পর প্রশ্ন উঠেছে বাসাবাড়ি, যানবাহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত গ্যাসের সিলিন্ডার আসলে কতটা নিরাপদ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক মহাসড়কের জন্য আরও একটি অশনি সঙ্কেত হলো যানবাহনে অনিরাপদ ও মেয়াদ উত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন যানবাহনে যে গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে তার ৭০ ভাগ রি-টেস্টিংয়ের আওতার বাইরে থাকছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ সিলিন্ডার হরহামেশায় ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করায় একেকটি গাড়ি যেন একেকটি বোমা বহন করে চলেছে। অপরদিকে বাসাবাড়িসহ অন্য কাজে যেসব সিলিন্ডার ব্যবহার হচ্ছে তার জন্য সচেতনতার প্রয়োজন। গ্যাস পাইপলাইনের ত্রুটি অবৈধ সংযোগ থেকেও হরহামেশা এ ধরনের দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছেন। গত পাঁচ বছরের এক হিসাবে দেখা গেছে এ ধরনের সিলিন্ডার দুর্ঘটনা ঘটেছে তিন শ’র উপরে। মানুষ মারা গেছে ২শ’ বেশি। চকবাজারের ঘটনায় ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন প্রতি পাঁচ বছর পর পর যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের মান পরীক্ষা করা বা রি-টেস্টিং করা বাধ্যতামূলক। রি-টেস্টিংয়ের মান ভাল পাওয়া গেলে সেটি আরও তিন বছর অতিরিক্ত ব্যবহারের বিধান রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ১০ থেকে ১৫ বছর ব্যবহারের পর সিলিন্ডর রি-টেস্টিং করা হচ্ছে না। এই অনিরাপদ সিলিন্ডার থেকে প্রতিনিয়তই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণ যাচ্ছে বহু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যানবাহনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আরও ঝুঁকি রয়েছে ভাঙ্গাচোরা সড়ক মহাসড়ক ও স্পিড বেকার কারণে। প্রায় এসব সড়ক ও স্পিড বেকারের ধাক্কা লেগে যানবাহনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ফলে মুহূর্তের মধ্যে আগুন ধরে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। সিলিন্ডার দুর্ঘটনা মহাসড়কে আরেকটি মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে দেখা দিয়েছে। গত বছরের ১৭ জুলাই মঙ্গলবারের ঘটনা। টাঙ্গাইলের একটি মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ভোর পাঁচটায় কুমুদিনী কলেজ মোড় সড়কে স্পিড বেকারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে মাইক্রোবাসটির গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে মুহূর্তের মধ্যেই প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে গাড়িতে আগুন ধরে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও রান্নার কাজে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত সিলিন্ডার ঝুঁকিমুক্ত নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ কমে আসার ফলে সিলিন্ডারে বাজারজাত এলপি গ্যাসের চুলায় রান্নাবান্নার প্রচলন বাড়ছে। শহরাঞ্চলের অনেক বাসাবাড়ি, হোটেল, রোস্তরাঁসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে গ্যাসসংযোগ না পাওয়ায় রান্নার কাজে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলেরও আয় বৃদ্ধির ফলে অনেক পরিবার এখন মাটির চুলার পরিবর্তে গ্যাসের চুলায় রান্না করছে, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে সিলিন্ডারের গ্যাস। এটা দেশের অগ্রগতির লক্ষণ হলেও ঝুঁকি এড়াতে এটি ব্যবহারের সচেতনতা প্রয়োজন। দেশের মানুষের মধ্যে তার ঘাটতি রয়েছে। ফলে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মানুষ মারা যাচ্ছে, গুরুতরভাবে জখম হয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারানোর ঘটনাও ঘটছে। শুধু সিলিন্ডার বিস্ফোরণ নয়, গ্যাস পাইপলাইনের ত্রুটি থেকে বিস্ফোরণ ঘটেও দুর্ঘটনা ঘটছে এবং অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছে। ঢাকার বিভিন্ন বস্তি এলাকায় এবং এর আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে অনেক গ্যাসপাইপ সংযোগ নেয়া হয়েছে। অনেক গ্যাস পাইপলাইনে কারিগরি ত্রুটি রয়েছে। পাইপলাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ ঘটে মানুষের হতাহত হওয়ার খবর মাঝে মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরের নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পাইপলাইনের লিকেজ বিস্ফোরণে দগ্ধ হয় একই পরিবারের নয়জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন পাইপলাইনের বিস্ফোরণ, গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে বিস্ফোরণ, চুলার ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণ নানাভাবে দুর্ঘটনা ঘটে মানুষ মারা যাচ্ছে। সিভিল ডিফেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, গত বছর পর্যন্ত এ ধরনের গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৭৮। আগের বছর ছিল ৭৯। ২০১৬ সালে ১৩১ এবং ২০১৫ সালে ৮০টি গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটেছিল। গত ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজের যে দুর্ঘটনা ঘটল তার সূত্রপাত এমনই সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে। পরে কেমিক্যাল বিস্ফোরণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পুড়ে মারা যায় ৭০ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে দুর্ঘটনা এবারই প্রথম নয়। দেশে অনেক আগে থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। মানুষের প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে প্রচুর। এক হিসাবে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরের দেশে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ৩শ’ উপরে। এতে মানুষ মারা গেছে দুই শতাধিক। আর চকবাজারের একদিনের ঘটনায় ৭০ জন। তারা বলেন মূলত দুটি কারণে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রথম কারণ হলো- যানবাহনে যেসব সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয় তা সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না। এমনকি দেশের বেশিরভাগ সিলিন্ডার মেয়াদ উত্তীর্ণ। এ কারণেই একেকটি গাড়ি একেটি জলন্ত বোমা হয়ে দেখা দিচ্ছে। আর একটি কারণ হলো রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। সড়ক ও পরিবহনসহ অন্যান্য সংস্থার অবহেলা ও উদাসিনতা। স্পিড বেকারের ধাক্কা খেয়ে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা ঘটছে। নাভানা সিএনজির সিনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ কামরুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন যানবাহনে তাদের প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা ১ লাখে বেশি সিলিন্ডার ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে ৭০ ভাগই রি-টেস্টিং করাতে আসে না কেউ। তবে চকবাজারের ঘটনায় এই রি-টেস্টিংয়ের পরিমাণও গত দু’দিনে বেড়ে গেছে। ইন্টাকো সিএসজির এজিএম নাসিরুদ্দিন বলেন, প্রতি পাঁচ বছরর পর পর সিলিন্ডার মান পরীক্ষার নিয়ম রয়েছে। পরীক্ষায় মান ভাল হলো সেটা আরও তিন বছর করা যেতে পারে। এর পরেই নতুন সিলিন্ডার ব্যবহার করার বিধান রয়েছে। কিন্তু ১০ থেকে ১৫ বছর পেরিয়ে গেলে কেউ সিলিন্ডার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে না। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, একেটি গাড়ি যেন একেকটি বোমা নিয়ে চলাচল করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলিন্ডার রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানগুওলো এ ধরনের দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্ঘটনা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন যে এগুলো নিয়ে আরও সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন। গ্যাস সিলিন্ডারের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়োজিত রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আরপিজিসিএল। তারা যদি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘটনা কমে আসবে। অন্যথায় দিন যত যাবে সিলিন্ডারের দুর্ঘটনা আরও বেড়ে যাবে। প্রাণহাণির আশঙ্কা বাড়বে।
×