ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

২০ বছরে আগের চেয়ে আরও সবুজ হয়েছে পৃথিবী

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

২০ বছরে আগের চেয়ে আরও সবুজ হয়েছে পৃথিবী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ধ্বংসের মধ্যেই সৃষ্টি হচ্ছে আবার পৃথিবী। জলবায়ু পরিবর্তনে যখন মহাবিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এই বিশ্ব, তখনই এই সৃষ্টির খবর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ বিজ্ঞান সংস্থা নাসা। সংস্থাটি বলছে, গত ২০ বছরে আগের চেয়ে আরও সবুজ হয়েছে পৃথিবী। আর চারপাশের এই ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে দুই কার্বন নির্গমনকারী দেশ ভারত ও চীন। উষ্ণায়নের জেরে যখন তিন-চার ফসলি জমিও উত্তরোত্তর হয়ে পড়েছে অনুর্বর, চাষের অযোগ্য, মাঠ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার মওসুম তখন নাসা জানাল, বিশ্বের সবুজায়নে পথ দেখিয়েছে ভারত ও চীন। নাসার ওই সাম্প্রতিক গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক বিজ্ঞানীর-বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রঙ্গ রামা মায়নেনি। গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ‘নেচার-সাসটেইন্যাবিলিটির’ সর্বশেষ সংখ্যায়। গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমন, উষ্ণায়নের জন্য যখন অভিযোগের আঙুল ওঠার বিরাম নেই মানুষের দিকে তখন এই গবেষণা জানাল, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দু’টি দেশ ভারত ও চীনের নাগরিকরাই ফের প্রাণ ফিরিয়েছেন প্রকৃতির। পরিবেশকে গাছপালার জন্য করে তুলেছেন আগের চেয়ে বেশি বাসযোগ্য। গাছপালার বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন যে আবহাওয়া, পরিবেশ ও পুষ্টির, দক্ষিণ এশিয়ার দু’টি প্রতিবেশী দেশেই, গত দু’দশকে তা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। তাতে এলাকাপিছু শুধু যে গাছপালার সংখ্যা বা তাদের বসতির ঘনত্ব (পপুলেশন ডেনসিটি) বেড়েছে তা-ই নয়, বেড়েছে গাছে গাছে পাতার সংখ্যা। পাতারাও আগের চেয়ে হয়েছে অনেক বেশি হৃষ্টপুষ্ট। গত ২০ বছরে আরও সবুজ হয়ে উঠেছে ভারত ও চীন। নাসা জানাচ্ছে, সেই ‘অসম্ভব’ সম্ভব হয়েছে চীনজুড়ে ব্যাপক বনসৃজনের দৌলতে। আর ভারত ও চীনের কৃষিকাজের কর্মযজ্ঞে। এ প্রসঙ্গে অন্যতম মূল গবেষক, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রঙ্গ রামা মায়নেনি জানিয়েছেন, প্রায় ২৮ লাখ বর্গকিলোমিটার। বিশ্বের বৃহত্তম বনাঞ্চল, আমাজন বৃষ্টি-অরণ্যও (আমাজন রেনফরেস্ট) রয়েছে প্রায় ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। ২০০০ সালের গোড়ার দিক থেকে ধরলে, সেই বৃদ্ধির হার খুব কম হলেও হবে ৫ শতাংশ। মায়নেনি বলেছেন, গত দু’দশকে যেভাবে কেল্লা ফতে করেছে ভারত ও চীন, তা আমাদের রীতিমতো অবাক করে দিয়েছে। কারণ, পৃথিবীর স্থলভাগের যে পরিমাণ জমিতে চাষবাস হয়, তার মাত্র ৯ শতাংশ চাষের জমি রয়েছে ভারত ও চীনে। এত কম চাষযোগ্য জমি হাতে থাকা সত্ত্বেও বিশ্বে গত ২০ বছরে যতটা সবুজায়ন হয়েছে, তার এক-তৃতীয়াংশই হয়েছে ভারত ও চীনে। তাদের ভৌগোলিক এলাকার তারতম্য না ঘটলেও। যার মানে, ওই দু’টি প্রতিবেশী দেশে আরও অন্তত ১০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভরে গেছে নতুন নতুন গাছ আর হৃষ্টপুষ্ট ডালে ডালে আরও বেশি কাছাকাছি থাকা পাতায়। উপগ্রহের পাঠানো এই তথ্যে আমরা অবাক হয়েছি। কারণ এতদিন জানা ছিল জনবহুল দেশে মানুষের পদচিহ্নই উত্তরোত্তর আরও বেশি এলাকাজুড়ে ভূমিক্ষয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে এবং নিয়ে চলছে। গবেষকরা বলছেন, শিল্পোৎপাদনের জন্য বাতাসে গ্রীনহাউস গ্যাস আরও বেশি পরিমাণে মেশায় গাছপালার লাভ হয়েছে। গ্রীনহাউস গ্যাসের মধ্যে অন্যতম কার্বন ডাই-অক্সাইড। এই গ্যাসই গাছপালার রান্নাবান্নার বা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার চালিকাশক্তি। তথা জ্বালানি। বাতাসে তার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় রান্নাবান্নাটা ভালই হচ্ছে গাছপালাদের। ফলে, তারা হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠছে তাড়াতাড়ি। মায়নেনি জানিয়েছেন, নয়ের দশকের মাঝামাঝি প্রকৃতি ও পরিবেশের এই রদবদলটা তার চোখে পড়েছিল। কিন্তু তা হাতেকলমে প্রমাণ করার কোন হাতিয়ার ছিল না তার হাতে। সেটা এবার সম্ভব হয়েছে নাসার পাঠানো দু’টি উপগ্রহে রাখা বিশেষ ধরনের একটি যন্ত্র ‘মডারেট রেজোলিউশন ইমেজিং স্পেকট্রোরেডিওমিটার’ বা ‘মোডিস’-এর দৌলতে। মায়নেনির কথায়, মহাকাশ থেকে উপগ্রহের ভেতরে থাকা ‘মোডিস’ যন্ত্রটি ভূপৃষ্ঠ থেকে শুরু করে তার নিচে ১ হাজার ৬০০ ফুট গভীরতা বা ৫০০ মিটার পর্যন্ত রেডিও রশ্মি পাঠিয়ে এই অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করেছে। মায়নেনির বক্তব্য, ২০ বছরে গোটা বিশ্ব যতটা সবুজতর হয়ে উঠেছে, তার ৪২ শতাংশ সম্ভব হয়েছে চীন জুড়ে ব্যাপক বনসৃজনের সফল কর্মযজ্ঞের দৌলতে। আর ভূমিক্ষয়, বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের রথের চাকায় লাগাম পরানো কিছুটা সম্ভব হওয়ায় চীনে গাছপালায় পাতার সংখ্যা বেড়েছে ৩২ শতাংশ। ভারতে সেটা হয়েছে অন্তত ৮২ শতাংশ। আরও বেশি পরিমাণে খাদ্যশস্যের বীজ রোপণের জন্য। অথচ, ২০০০ সালের তুলনায় ভারত ও চীনে চাষযোগ্য জমির পরিমাণে যে খুব একটা হেলদোল ঘটেছে, তা কিন্তু নয়। দু’টি দেশে চাষবাস হচ্ছে এখন ৭ লাখ ৭০ হাজার বর্গমাইলেরও বেশি এলাকা জুড়ে। গবেষকরা অবশ্য এটাও বলছেন, এর ভিত্তিতেই বলে দেয়া যাবে না, এই উষ্ণায়নের সময় যাবতীয় উদ্বেগকে দূরে সরিয়ে দিতে পেরেছে এই সবুজায়ন। কারণ শস্যের ফলন, উৎপাদন, দীর্ঘ সময় ধরে তার সুস্থ, সবল থাকার প্রক্রিয়াটা নির্ভর করে ভূগর্ভস্থ পানি, জমির উর্বরতা, তাপমাত্রাসহ আনুষঙ্গিক কয়েকটি জরুরী বিষয়ের ওপর। মায়নেনির কথায়, ভারতে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণের যা অবস্থা আর তার গুণাগুণ যা, তাতে সবুজায়নের রথের চাকা আর বেশিদূর নাও গড়াতে পারে, অন্তত ভারত বা তার মতো আরও কয়েকটি দেশে।
×