মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত জীপ গাড়িটি পড়ে আছে। ‘জার্মানির ভক্সেল ভিভার’ ব্র্যান্ডের গাড়িটি ছিল যশোর সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের (তৎকালীন নাম ছিল মোমিন গার্লস স্কুল)। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে গাড়িটি ব্যবহার করেছেন প্রাদেশিক পরিষদের মন্ত্রী এ্যাডভোকেট মশিউর রহমান। এই গাড়িতে চড়েছেন জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ বহনের কাজেও ব্যবহৃত হয়েছে। এই গাড়ির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে।
যশোর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার রাজেক আহমেদ জানান, ‘জার্মানির ভক্সেল ভিভার’ ব্র্যান্ডের গাড়িটি ছিল যশোর সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের (তৎকালীন মোমিন গার্লস)। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যশোর অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র গোলাবারুদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বহনে গাড়িটি ব্যবহার করেছেন।
গাড়িটি চালাতেন সিদ্দিকুর রহমান। তার বাড়ি যশোর সদরের নুরপুর গ্রামে। যশোর শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে। এই গাড়ি চালানোর আগে তিনি তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের মন্ত্রী এ্যাডভোকেট মশিয়ুর রহমানের টয়োটা জিপ চালাতেন। মশিয়ুর রহমানের সঙ্গে অনেক ভাল সম্পর্ক ছিল তার। তখন বয়স ১৮-২০ হবে। মশিয়ুর রহমানের সহধর্মিণী মাহমুদা রহমান তখন মোমিন সরকারী স্কুলের হেড মিস্ট্রেস। একদিন জানতে পারেন জার্মানির ভক্সেল ভিভার গাড়িটি সরকার স্কুলকে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাডামের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেন ওই গাড়ি চালানোর। তখন মাহমুদা বলেন, ‘তোমার স্যার তো ক’দিন পর মন্ত্রী হবে। তুমি এ চাকরি কি করবা!’ সিদ্দিকুর রহমান তখন বলেন, ‘সরকারী চাকরিতে ঢুকে থাকলে তো স্যারের কাছে বদলি হয়ে যেতে পারব।’
মশিউর রহমানকে রাজি করিয়ে শেষ পর্যন্ত ওই গাড়ি চালানোর চাকরি নেন। ঢাকা থেকে গাড়িটি চালিয়েও নিয়ে যান তিনি। মশিয়ুর ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। বহু আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গী। সেই সূত্রে বঙ্গবন্ধু কয়েকবার যশোর গেলে দেখা হয় তার সঙ্গে। অনেকবার এই গাড়িতে করে চোরা পথে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গেছেন বিভিন্ন সমাবেশে। বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামালের সঙ্গেও অনেকবার দেখা হয়েছে তার। ড্রাইভার হলেও বন্ধুর মতো ছিলেন বলেই বক্তব্য তার। ৩২ নম্বরের বাড়িতেও গেছেন। ১৪ সিটের মাইক্রোতে ২০-২৫ ছাত্রীও আনা- নেওয়া করেছেন তিনি। গাড়িটি নাকি খুবই আকর্ষণীয় ও সুন্দর ছিল। একাত্তরের ২৪ মার্চ মশিউর রহমানের সঙ্গে শেষ কথা হয় সিদ্দিকের। তিনি পালিয়ে যেতে বলেন পরিবারসহ। মশিয়ুর রহমানের স্ত্রী মাহমুদা ওই গাড়ি নিয়েই পালিয়ে যান দুই ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে চাঁচুড়িয়া। ২৫ মার্চ গ্রেফতার হন মশিউর রহমান। যশোর সেনানিবাসে আটক রেখে ২৩ এপ্রিল তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
এর কিছুদিন পর মাহমুদা ম্যাডাম খবর দেন সিদ্দিকুর রহমানকে। তখন চাঁচুড়িয়া গিয়ে প্রিয় গাড়িটি নিয়ে আসেন। গাড়িটার প্রতি খুব টান ছিল। কলকাতায়ও গেছেন এ গাড়ি নিয়ে। অনেকে তখন কিনে নিতে চাইতো। অথচ তিনি গাড়ির দামই জানতেন না।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ২ মাস পর থেকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা রাজেক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় সিদ্দিকের। রাজেক আহমেদই গাড়িটা মূলত যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা শুরু করেন। সে সময় অস্ত্র বহন, মুক্তিযোদ্ধাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যবহার হতো গাড়িটি। একবার মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমানের মাথায় মর্টারের শেল লাগলে তাকে নিয়ে কলকাতায়ও যান সিদ্দিক।
যুদ্ধ তখন প্রায় শেষের দিকে। গাড়িটি নিয়মিতই লাগছিল যুদ্ধের নানাবিধ কাজে। গাড়ি চালাতেও হতো খুব সাবধানে। কোন সময় আবার খানসেনাদের সামনে পড়তে হয়! একবার রাজেক আহমেদের সঙ্গে যাচ্ছিলেন যশোর থেকে মধুপুর। সরাসরি রাস্তা ছিল না। যেতে হবে কনেজপুর দিয়ে ঘুরে। সামনে একটা কালভার্ট পড়ল। ওই এলাকা আবার ছিল বিহারি অধ্যুষিত। হঠাৎ সামনে পড়লো ৬ পাকিস্তানী। গাড়ির স্টার্টও বন্ধ হয়ে গেল। রাজেক আহমেদ কিছু না ভেবেই ফায়ার শুরু করেন। তখনও তিনি জানতেন না পিছনে কোন মুক্তিযোদ্ধা আছে কিনা। সিদ্দিক তখনও গাড়িতে বসে। হাতে একটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। কিছু অস্ত্র-ট্রেনিং তিনি নিয়ে রেখেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে চলাফেরা করতে করতেই।
যুদ্ধের পরও বছর দুয়েক চালিয়েছিলেন গাড়িটি। আর ৮০ সালের দিক থেকেই সম্ভবত স্কুলে পড়ে আছে গাড়িটি। প্রথমে গ্যারেজে থাকলেও পরে ফেলে রাখা হয় পিছনের দিকে। এরপর জেলা প্রশাসনের তৎপরতায় যশোর সরকারী বালিকা বিদ্যালয় চত্বর থেকে গাড়িটি উদ্ধার করা হয়। গাড়িটি সংরক্ষণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের অর্থায়নে ৮৭ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ১৪ জুন তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড. মো. হুমায়ুন কবীর প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় দেড় বছর আগে। কিন্তু আজও সেই কাজ সম্পন্ন হয়নি। আর সেই গাড়িটি পড়ে আছে শহরের একটি গ্যারেজে।
এত দিনেও কেন সংরক্ষণাগারটি নির্মাণ হয়নি, জানতে চাইলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের বরাদ্দ ৮৭ হাজার টাকা উত্তোলন করে রাখা হয়েছে। নির্মাণ কাজ অচিরেই সম্পন্ন হবে। মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়িটির অবস্থা ভাল নয়। এজন্য মেরামতের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্যারেজে দেওয়া হয়েছে। সংরক্ষণের উপযোগী করে তোলার কাজটা শেষ হলেই, সংরক্ষণাগার নির্মাণ করে দেওয়া হবে। এজন্য খুব বেশি সময় প্রয়োজন হবে না।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আবদুল আওয়াল বলেন, প্রকল্পটি চলমান রয়েছে। বন্ধ হয়নি। তবে সংরক্ষণাগারের জায়গাটা একটি পরিবর্তনের চিন্তাভাবনা করছি। কারণ জনসাধারণের চলাচলের পথ রেখেই নির্ধারিত জায়গার একটু পাশে সংরক্ষণাগরটির নির্মাণ করা যায় কিনা, সেটি আমরা বিবেচনা করছি। অচিরেই কাজ সম্পন্ন হবে।
-স্টাফ রিপোর্টার, যশোর থেকে
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: