ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি আমলের নির্যাতনের ফলেই সুজার এ মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  বিএনপি আমলের নির্যাতনের ফলেই সুজার এ মৃত্যু

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ে ক্লিনহার্ট অপারেশনের নামে অনেক সংসদ সদস্যসহ অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন চালানো হয়েছে, দেড় শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। সংসদ সদস্য প্রয়াত এসএম মোস্তফা রশিদী সুজাকে ড্রিল দিয়ে হাত-পা ফুটো করাসহ অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তারপর থেকেই তিনি অসুস্থতা নিয়ে বেঁচে ছিলেন। অবশেষে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হলো। এই সংসদে অনেক সংসদ সদস্যই রয়েছেন যারা বিএনপির দ্বারা নির্যাতিত। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে রবিবার জাতীয় সংসদ অধিবেশন শুরুর দিনে এসএম মোস্তফা রশিদী সুজা ও বিরোধী দলের চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুতে আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে রবিবার বিকেল পাঁচটায় সংসদ অধিবেশন শুরুতেই শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও সাবেক হুইপ এসএম মোস্তফা রশিদী সুজা ও বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুতে আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সরকারী দলের শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মীর শওকাত আলী বাদশা, আবদুস সালাম মোর্শেদী, মনিরুল ইসলাম, বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা, কাজী ফিরোজ রশীদ, নুরুল ইসলাম ওমর ও ফখরুল ইমাম। আলোচনা শেষে স্পীকার শোক প্রস্তাবটি ভোটে দিলে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। এরপর তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এক মিনিটি নিরাবতা পালন শেষে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন সরকারী দলের ফজলুল হক হারুন। এরপর বর্তমান সংসদের দু’জন সংসদ সদস্যের মৃত্যুর কারণে সংসদ অধিবেশনের দিনের অন্যান্য কার্যক্রম স্থগিত রেখে সংসদ মুলতবি করা হয়। শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা দুই সংসদ সদস্যকে হারিয়েছি। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। মোস্তফা রশিদী সুজা খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিল। তিনি একজন ক্রীড়া অনুরাগী এবং প্রাণবন্ত সুদক্ষ নেতা ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মী ওপর যে অত্যাচার করা হয়, সেই অত্যাচারে শিকার হয়েছিলেন মোস্তফা রশিদী সুজাও। তার পায়ে ড্রিল দিয়ে ফুটো করে দেয়া হয়েছিল। তার হাত পায়ে অমানুষিকভাবে অত্যাচার করা হয়েছিল। এমনকি তার ভাই ও শিশু সন্তানকে পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছিল অপারেশন ক্লিনহার্টের সময়। তিনি বলেন, ওই সময় খুলনার যুবলীগ নেতা মাসুদকে তো মেরেই ফেলা হয়েছিল। এ রকম অসংখ্যা নেতাকর্মীকে নির্যাতন করা হয়। ওই সময় প্রায় ১৫০ জনের মতো নেতাকর্মী মারা যায়। এই সংসদের অনেক সংসদ সদস্যই আছেন যারা বিএনপির দ্বারা নির্যাতিত। এই নির্যাতনের ফলেই মোস্তফা রশিদী সুজার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুতে খুলনা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক যে ক্ষতি হলো, তা পূরণ হওয়ার নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরেকজন বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ২০১৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানে তার বিরাট ভূমিকা ছিল। আমরা দু’জন দক্ষ সংসদ সদস্যকে হারিয়েছি। এই সংসদের প্রায় ১৫ জন সংসদ সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি প্রয়াত সব নেতার রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ বলেন, প্রয়াত এই দুই নেতাই অসম্ভব ভাল ও ত্যাগী রাজনীতিবিদ ছিলেন। ভাল মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছে। দশম জাতীয় নির্বাচনের সময় অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তাজুল ইসলাম চৌধুরী। কে কখন আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন, তা কেউ জানে না। আমৃত্যু তারা নিজেদের এলাকার মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। তাদের মৃত্যুতে রাজনীতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা কোনদিনই পূরণ হওয়ার নয়। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, খুলনায় অসম্ভব জনপ্রিয় নেতা ছিলেন মোস্তফা রশিদী সুজা। ছাত্রজীবন থেকেই সাহসী একজন রাজনৈতিক যোদ্ধা ছিলেন। খুলনা বিভাগে আওয়ামী লীগের শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য সুজার অত্যন্ত শক্তিশালী অবদান ছিল। কিন্তু বিএনপির আমলে তার পায়ের ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটো করা, হাতের আঙ্গুলে সুঁচ ফুটিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। যার কারণেই তার এই অকাল মৃত্যু ঘটেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ মরহুম তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও মোস্তফা রশিদী সুজার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক সৈনিক সুজা অত্যন্ত ত্যাগী ও সাহসী নেতা ছিলেন। ক্লিনহার্ট অপারেশনের নামে সুজাসহ অসংখ্য নেতাকে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। সাতবারের এমপি তাজুল ইসলাম চৌধুরীও অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী ও অসম্ভব সৎ মানুষ ছিলেন। আজীবন ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন। এ দু’জনের মৃত্যুতে দেশের রাজনীতিতে অনেক ক্ষতি হলো। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, মোস্তফা রশিদী সুজা অত্যন্ত ত্যাগী নেতা ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় যখন খুলনায় সন্ত্রাসী উৎপাটনের কাজে নেমেছিলাম, তখন অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু তার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। বিএনপি-জামায়াতের ক্লিনহার্ট অপারেশনের নামে খালেদা জিয়ারা সুজাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। যার ফলেই অসম্ভব্য জনপ্রিয় নেতাকে চলে যেতে হলো। বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরীও অসম্ভব জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তাদের মৃত্যুতে রাজনীতির জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ হলো। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, মোস্তফা রশিদী সুজা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন ত্যাগী নেতা ছিলেন। আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করতে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। বিএনপি আমলে খালেদা জিয়ারা অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে সুজাকে ড্রিল মেশিন দিয়ে পা ফুটো করাসহ অকথ্য নির্যাতন করেছে। অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তি ছিল বলেই খালেদা জিয়ারা তাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। সেই নির্যাতনের কারণেই দীর্ঘদিন শারীরিকভাবে অসুস্থতা নিয়েই আমাদের মাঝ থেকে চলে গেল। তাজুল ইসলাম চৌধুরীও একজন ভাল মানুষ ও দেশপ্রেমী ছিলেন। জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও মোস্তফা রশিদী সুজা দু’জনই সংগ্রামী ও ত্যাগী নেতা ছিলেন। সাতবারের এমপি তাজুল ইসলাম চৌধুরীর চলে যাওয়াই রাজনীতিতে বিশাল একটি শূন্যতার সৃষ্টি হলো, যা কোনদিনই পূরণ হওয়ার নয়। প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও মোস্তফা রশিদী সুজা দু’জনই গুণী মানুষ ছিলেন। অসম্ভব জনপ্রিয় নেতাও ছিলেন। সাতবার সংসদ সদস্য ও ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব থাকলেও তাজুল ইসলাম চৌধুরীর ঢাকা শহরে এক ছটাক জায়গা নেই, এখনও তার পরিবার ভাড়া বাড়িতে থাকেন। জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম ওমর বলেন, তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাতবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। এমনই জন-মানুষের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। মোস্তফা রশিদী সুজার মৃত্যুতে শূন্য আসনের উপ-নির্বাচনে বিজয়ী সাবেক তারকা ফুটবলার আওয়ামী লীগের আবদুস সালাম মোর্শেদী সংসদে দেয়া প্রথম বৈঠকে শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, প্রয়াত নেতা মোস্তফা রশিদী সুজা আমৃত্যু খুলনার উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। শুধু রাজনৈতিক নেতাই নন, খেলা পাগল লোক ছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে তথাকথিত ক্লিনহার্ট অপারেশনের নামে সাবেক হুইপ সুজার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। যা ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। জাপার কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, জন্ম হলে মৃত্যু হবেই। কিন্তু একে একে আমরা ত্যাগী ও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের হারাচ্ছি। ক্লিনহার্ট অপারেশনের সময় অমানুষিক নির্যাতনের পর থেকেই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি মোস্তফা রশিদী সুজা। তাজুল ইসলাম চৌধুরীর মোবাইল নম্বরও ডিলিট করতে হবে। এটা যে কত কষ্টের তা বলার মতো নয়। জাপার ফখরুল ইমাম বলেন, প্রয়াত এ নেতার শত শত নেতার নাম মুখস্থ থাকত। কোন কাজে কোনদিন না করতেন না। সদালাপী ছিলেন, মুখে হাসি ছাড়া কোনদিন দেখিনি। সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মতো নেতা দেশে হাতেগোনা দু’একজন পাওয়া যাবে। তার মতো অসম্ভব জনপ্রিয় নেতার প্রয়াত জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হলো, যার কোনদিন পূরণ হওয়ার নয়।
×