ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিপন্ন মৃৎশিল্প

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিপন্ন মৃৎশিল্প

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। এক সময় এ এলাকার অনেক মানুষের প্রধান পেশা ছিল এই মৃৃৎশিল্প। আমাদের পূর্ব পুরুষরা নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক বস্তু হিসেবে মৃৎশিল্পের তৈরি থালা, বাসন, হাড়ি, পাতিল, ঘটি-বাটি, বদনা ইত্যাদি তৈজসপত্র ব্যবহার করতেন। বর্তমানে এই স্থান দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন প্লাস্টিক, স্টিল ও সিলভার সামগ্রী। এ কারণে নওগাঁ জেলার মৃৎশিল্প বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। স্থানীয়ভাবে মৃৎ শিল্পীদের কুমোর বলা হয়। কুমোরদের আজ বড়ই দুর্দিন। অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে অতি কষ্টে দিনাতপাত করছে মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কুমোররা। জীবন জীবিকার তাগিদে কঠোর পরিশ্রম করে জেলা সদরের শেরপুর পালপাড়া, রানীনগরের আতাইকুলা, পারইল, ভান্ডারগ্রাম, আত্রাইয়ের ভবানীপুর, পাঁচুপুর, মহাদেবপুরের সুলতানপুর, পোরশার নীতপুরসহ জেলার বেশ কিছু এলাকায় বসবাসরত পাল সম্প্রদায়ের পরিবার এখনও মৃৎশিল্পের ওপর নির্ভরশীল হয়ে শুধু বাপ-দাদার কুমোর পেশা আঁকরে ধরে আছেন। মৃৎশিল্প কর্মের জন্য মহাদেবপুরে স্থানীয়ভাবে খ্যাত ব্যক্তি রামায়ণ পাল জানান, তার স্বর্গীয় পিতা শিউ প্রসাদ পালের মৃত্যুর পর পৈত্রিক ভিটাতে এখনও গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে নিরলসভাবে বাপ-দাদার কুমোর পেশা আঁকরে ধরে আছেন। অতীতে এই পেশায় ভালই লাভ হতো। কিন্তু বর্তমানে এর ওপর নির্ভর করে তিন বেলা ভালভাবে খাবার জোটে না। এখন অনাহারে-অর্ধাহারে অতি কষ্টে দিন কাটাতে হয় তাদের। আধুনিকতার প্রভাবে ছেলে-মেয়েরা এ পেশা ছেড়ে বিভিন্ন পেশায় যোগ দিয়েছে। তিনি বলেন, গোটা জেলায় বংশগতভাবে এ পেশা ধরে আছে আমার মতো হাতে গোনা কয়েকজন। যাদের অবর্তমানে এই শিল্প জেলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে জানান, অতীতে তারা তাদের শিল্প সম্ভার নিয়ে প্রতিটি উৎসব ও গ্রাম্য মেলায় স্টল সাজিয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এসেছেন। কিন্তু বর্তমানে তা আর হচ্ছে না। কেবলমাত্র বাংলা নববর্ষ এলেই শৌখিন পান্তা খেকোদের কাছ থেকে মাটির থালার অর্ডার আসে। এছাড়া সারা বছর মাটির তৈরি থালা বাসনের কোন চাহিদা থাকে না। একই গ্রামের ধীরেন পাল বলেন, এলাকার আশপাশে বেশ কয়েকটি ইট ভাটি রয়েছে। ইট বানাতে তারাই বেশি দামে প্রতি বছর প্রচুর মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। জমির মালিকরাও ইট ভাটিতে অধিক দামে মাটি বিক্রি করায় মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলো পাল্লা দিয়ে মাটি কিনতে পারছে না। তিনি বলেন, ‘বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, ফাল্গুন ও চৈত্র এই চার মাস গ্রামাঞ্চলে মৃৎশিল্পের তৈরি পণ্যের চাহিদা একটু বেশি থাকে। এ সময় কুমোর পরিবারের লোকেরা কোন মতো দু’বেলা পেটভরে খেতে পারে। বাকি ৮ মাস চরম কষ্টের মধ্যে জীবন যাপন করতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, একটা সময় মাটির তৈরি কলস হাঁড়ি পাতিল খেলনার খুব কদর থাকলেও আধুনিকতার ছোয়ায় বিপন্ন হতে বসেছে এ মৃৎশিল্প। তাছাড়াও বর্তমান আধুনিক যুগের প্লাস্টিক সামগ্রীসহ অন্যান্য জিনিস পত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারায় এই শিল্পে ধস নেমেছে। মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কুমোর পরিবারগুলো আর্থিক সঙ্কটসহ নানা অভাব অনটনে পড়ায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মৃতশিল্প থেকে। মৃৎশিল্পের কারিগর কাঞ্চন পাল বলেন, প্রয়োজনীয় অর্থাভাবে এখানকার কুমোর পরিবারগুলোর নেই কোন আধুনিক মেসিন ও সরঞ্জাম। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে এখন কৃষি কাজের দিকে চলে যাচ্ছে। -বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ থেকে
×