ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেড় শ’ সন্তানের জননী এক হাজেরা বেগম

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ৮ আগস্ট ২০১৮

দেড় শ’ সন্তানের জননী এক হাজেরা বেগম

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ দেড় শ’ সন্তানের জননী এক হাজেরা বেগম। অবাক হচ্ছেন? নিজের ঔরসজাত সন্তান না থাকলেও তিনি এক অনন্য মা। ৪৭ বছর বয়সী হাজেরা বেগম পেশায় ছিলেন যৌনকর্মী। এ কাজ থেকে অবসর নেয়ার পর হাজেরা ভাসমান শিশুদের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে এসেছেন। নিজের জীবনের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন যৌনকর্মীদের অবাঞ্ছিত সন্তানের মা। সমাজে তাদের স্বীকৃতি দিতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। সমাজের মূল ধারায় এসব শিশুকে সম্পৃক্ত করতে যোগ্য করে গড়ে তুলছেন। নিজের সব সম্বল ও মানুষের কাছ থেকে পাওয়া সহায়তায় এসব শিশুকে বুকে টেনে নিয়েছেন তিনি। হাজেরা নিজেও এক সময় অন্ধকার জগতের মানুষ অর্থ যৌনকর্মী ছিলেন। কাছ থেকে দেখেছেন অন্ধকার জগতে জন্ম হওয়া শিশুর অনাদরের চিত্র। রাজধানীর আদাবরের লুৎফর রহমান লেনের ৬/২ নম্বর বাড়ির একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে হাজেরা তার সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন। হাজেরার এ পর্যন্ত মোট সন্তানের সংখ্যা প্রায় দেড় শ’। এ সব সন্তানেরা জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে কাজ করে গেলেও মাকে ভোলে না। নিয়ম করে তারা এ পরিবারে আসে এবং সময় কাটিয়ে ফিরে যায় নিজের কর্মস্থলে। কেউ কেউ তার স্নেহেই প্রতিপালিত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ভাসমান যৌনকর্মীরা তাদের অনাকাক্সিক্ষত সন্তানকে নির্ভরতার আশ্রয় হিসেবে তার কাছে রেখে যান। মাসিক আর্থিক খরচ দেয়ার কথা থাকলেও অনেকে আর খোঁজখবর রাখে না। এসব শিশু যখন হাজেরাকে ‘মা’, ‘আম্মা’ অথবা ‘আম্মু’ বলে সম্বোধন করে তখন তিনি সব কষ্ট ভুলে সকলকে নিয়ে মিলেমিশে থাকেন। ২০১০ সালে নিজের সব সম্বল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সহায়তায় ২০ জন শিশুকে নিয়ে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। যা পরবর্তীতে এক পরিবারে রূপ নেয়। একজন আয়া, একজন বুয়ও হাজেরা মিলে চালাচ্ছেন এই পরিবার। এখানে বড় হচ্ছে, তিথি, মিম, স্বপ্না, সোনালি, দুর্জয়, মির্জা, রবিন, স্বপনের মতো অবহেলিত শিশুরা। যারা পাচ্ছে তিন বেলা পেট ভরে খেতে, পড়াশোনা করার সুযোগ। এই শিশুনিবাসের বাসিন্দারা স্থানীয় বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। এদেরই একজন তাহমিনা। সে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। সে বড় হয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। দশম শ্রেণীর ছাত্র সাঈদ জানায়, লেখাপড়া শিখে দেশের জনসাধারণের সেবা করতে মন্ত্রী হতে চায়। আর নবম শ্রেণীর আকাশ বড় হয়ে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখে। হাজেরা জানান, আমার সন্তানেরা প্রাইমারী ও হাইস্কুলে পড়ালেখা করছে। প্রতি সপ্তাহে দুদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবক দলটি এসে পড়িয়ে যায়। অনেকে আবার গানও শিখছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গানের স্কুল সুরের ধারায় আট শিশু গান শিখতে যায়। এ ছাড়া অবসরে এদের সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত করা হয়। এদের তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম নিয়ে শিগগিরই প্রদশর্নী করার পরিকল্পনা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই নানা নিপীড়নের মধ্যে বড় হয়েছেন হাজেরা। তার জীবনের গল্প আর পাঁচজনের মতো নয়। সৎ মায়ের নির্যাতনে বড় হয়েছে সে। পেটে ক্ষুধার জ্বালা নিয়েই ঘর ছেড়ে মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পালিয়ে যান। মীরপুরের এক বস্তি থেকে পালিয়ে বাসে উঠেছিলেন। বাসেই ঘুমিয়ে পড়েন। পরে জানতে পারেন গুলিস্তানে এসে পড়েছেন। ঠিকানা বলতে না পারায় ফিরে যাওয়া হয়নি পরিবারের কাছে। প্রথমত, রাস্তায় ভাসমান শিশুর ন্যায় ময়লা-আবর্জনা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসপত্র ভাঙ্গারি দোকানে বিক্রি করে চলতে থাকে তার জীবন। দশ বছর বয়সে নিজের অজান্তেই বিক্রি হয়ে যান হাজেরা। এরপর ঠিকানা হয় এক ‘মাসী’র কাছে। শুরু হয় তার পতিতাবৃত্তির জীবন। কান্দুপট্টি থেকে টানবাজার। জীবনের সমীকরণে মাঝে অনেক বছর চলে যাওয়া। এরপর ভাসমান পতিতা হিসেবেই দিন কাটাতে থাকেন। এদিকে, বিয়ে হলেও সংসারে ভাগ্য ফেরেনি হাজেরার। অনেকটা বাধ্য হয়েই ফিরে আসেন পুরনো পেশায়। পোশাক তৈরির কারখানায়ও কাজ করেন কিছুদিন। এরপর বেসরকারি সংস্থা ‘কেয়ার বাংলাদেশে’ কাজ নিলেন। সংগঠনের মাধ্যমে লেখাপড়া ও হাতের কাজ শেখেন। এ সময় এইচআইভি এইডসের প্রকল্পে সচেতনতা তৈরি করতে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি বিভিন্ন মতবিনিময় সভায়ও অংশ নিয়েছেন। এমনকি প্রায় ১২টি দেশে ভ্রমণ করেছেন। পরে ‘দুর্জয় বাংলা’য় ‘চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে।’ ভাসমান যৌনকর্মীদের সন্তানদের দেখভালের কাজ পেয়ে যান তিনি।’ একসময় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও এসব শিশুদের মায়া ভুলতে পারেন না তিনি। জীবনের শেষ সম্বল দিয়ে আবারও চালু করেন এটি। হাজেরা নিজ জীবনের গল্প বলতে গিয়ে বলেন, ‘বাবা-মা থাকতেও তাদের আদর পাইনি। ছোটবেলা থেকে রাস্তায় বড় হইছি। একসময় রাস্তার মেয়েমানুষ হয়ে গেছি। নিজে কখনও সন্তান পেটে ধরিনি। কিন্তু নিয়তির খেলায় এখন আমার কত সন্তান! দেখতাম যৌনকর্মীদের বাচ্চা চুরি হয়, অনেকে তাদের মায়ের আদিম পেশায় ফিরে যায়। রাস্তায় বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়। স্বপ্ন দেখতাম এসব শিশুদের জন্য কিছু করার জন্য। বিদেশে যখন গিয়েছি সেসময় যতটা পেরেছি তা জমিয়ে রেখেছি। পরে এসব টাকা দিয়ে দু’বছর কারো সাহায্য ছাড়াই সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে গেছি। সমাজ সচেতন কিছু মানুষ এই শিশুনিবাসটিকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, সবসময় যৌনকর্মীদের সমাজে হেয় করে দেখা হয়। তাদের সন্তানদেরও পিতৃ পরিচয় থাকে না। আমি আমার বাবার নাম দিয়ে এসব শিশুদের ভর্তি করাই। কারো কারো নাম দেই আমাদের ভলান্টিয়ারদের নামে। এসব শিশু আমার পরিচয়ে মানুষ হচ্ছে। আগে এসব শিশুকে ভর্তি করাতে অনেক সমস্যা হতো। এখন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। যদি সরকারী সহযোগিতা পাওয়া যায় তাহলে এসব শিশুকে আরও এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।’ সেইসঙ্গে হাজেরা স্বপ্ন দেখেন হাজার সন্তানের জননী হওয়ার। এক টুকরা জমিও প্রত্যাশা করেন, যখন তিনি থাকবেন না তখন এসব শিশুর নির্দিষ্ট একটি থাকার জায়গা হবে।
×