ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আগামীকাল দিনাজপুর

আওয়ামী লীগ মরিয়া, বিএনপিকে ছাড় দিতে নারাজ জামায়াত

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৮ জুলাই ২০১৮

  আওয়ামী লীগ মরিয়া, বিএনপিকে ছাড়  দিতে নারাজ জামায়াত

ডি. এম. তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাতাস আমের রাজ্য বলে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জুড়ে অনেক জোরেই বইতে শুরু করেছে। এবার চাঁপাইয়ের তিনটি আসনেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিশ দলীয় জোটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা তিনটি আসন নিয়ে গঠিত। মোট ভোটারের সংখ্যা ১০ লাখ ৩৯ হাজার ২১০ জন। মনোনয়ন পেতে বড় দুই দলেরই একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। আওয়ামী লীগ তিনটি আসনই ধরে রাখতে মরিয়া। আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বাসনা নিয়ে নিজের ও দলীয় প্রধানের ছবিসহ বড় বড় পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঝুলিয়ে শুভেচ্ছা ও দোয়া চাওয়া অব্যাহত রয়েছে। অনেক সম্ভাব্য প্রার্থী ইতোমধ্যেই বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে ফেলেছেন। যদিও এখানকার শক্তিশালী দল জামায়াত এখন পর্যন্ত ২০ দল থেকে বেরিয়ে না গেলেও তিনটি আসনেই পৃথকভাবে প্রার্থী নিয়ে মাঠে রয়েছে। জামায়াত কর্মীরা মাঠে থাকলেও সব কর্মতৎপরতা খুবই গোপনে চালাচ্ছেন। জামায়াতের মহিলা কর্মীরা সব চেয়ে বেশি তৎপর। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠোন বৈঠক করছে। তারা এবার কোনভাবেই বিএনপিকে এক ফোঁটাও ছাড় দিতে নারাজ। যেমন সদর আসনে জামায়াত-বিএনপি প্রকাশ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে নানা ধরনের কেচ্ছা কাহিনী বলে বেড়াচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) ॥ জেলার তিনটি আসনের মধ্যে এই আসনটি সবচেয়ে বড়। এটাকে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে রয়েছে একাধিক জঙ্গী সংগঠন। এখানকার ছ’টি ইউপির জনসাধারণ নিবিড়ভাবে মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসা করে থাকে। এক সময়ে সাঈদীর ছবি চাঁদে দেখা নিয়ে আন্দোলনের নামে কানসাট পল্লী বিদ্যুত অফিস, পর্যটন অফিসসহ বহু সরকারী যানবাহন পুড়িয়ে দেয়। হত্যা করে এক প্রকৌশলীকে। সোনামসজিদ স্থল বন্দর এই জেলার মধ্যে। ১২ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে এখানে। এই আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য, কানসাট পল্লী বিদ্যুত আন্দোলনের নেতা গোলাম রাব্বানী। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন তিনি। তার সঙ্গে জেলা কমিটিসহ দলের নেতা কর্মীদের ভাল সম্পর্ক না থাকলেও তিনি সরবে মাঠে রয়েছেন। অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী ব্রিগেডিয়ার (অব) এনামুল হক। তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে মন্ত্রী হয়েছিলেন। অপর জন ডাঃ সামিল উদ্দীন আহম্মেদ শিমুল। এই এলাকার একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং উপজেলা চেয়ারম্যান বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত ডাঃ মঈনউদ্দীন আহম্মেদ মন্টু ডাক্তারের ছেলে। এছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়ে মাঠে রয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার মাহতাব উদ্দিন। সরকারী দু’জন প্রভাবশালী আমলাও নির্বাচনী এলাকায় বেশ তৎপর রয়েছেন। তারা হলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জিল্লার রহমান ও ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার নুুরুল ইসলাম। তারা দু’জনই নির্বাচনী এলাকায় নানা উন্নয়নমূলক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে বর্তমান এমপি গোলাম রাব্বানী এক ধরনের ইমেজ সঙ্কটে পড়েছেন। দলীয় নেতাকর্মীরা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তবে এখানকার উপজেলা পরিষদ জামায়াতের দখলে থাকায় বিএনপিও রয়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। জেলার মধ্যে এই একটি আসনেই বিএনপি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। বিএনপির তিনবারের সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক শাহজাহান মিঞার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলার চার্জশীট রয়েছে। সে ক্ষেত্রে মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্যতা হারালে শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র শামিম কবির হেলিম, বেলালী বাকী ইদ্রিশ ও এ্যাডভোকেট শওকাত প্রার্থী হবেন। একজন মনোনয়ন পেলে তাকে বিএনপি সমর্থন দিবে। অন্যদিকে এই আসনে জামায়াতের একমাত্র প্রার্থী উপজেলা চেয়ারম্যান কেরামত উল্লাহ। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী শাহজাহান মিঞা ৯৬ হাজার ৭৩৯টি ভোট পান। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্রিগেডিয়ার এনামুল হক পান ৮৪ হাজার ৮০৭ ভোট। জামায়াত পেয়েছিল ৬৫ হাজার ৩১০ ভোট। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ব্রিগেডিয়ার (অব) এনামুল হক ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩০৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। ১ লাখ ১৬ হাজার ৬৭৩ ভোট পান বিএনপি প্রার্থী। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনে গোলাম রাব্বানী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (ভোলাহাট, গোমস্তাপুর ও নাচোল) ॥ তিনটি উপজেলা নিয়ে এই আসনটি গঠিত। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিয়াউর রহমান একবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও দ্বিতীয় মেয়াদে লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হন রহনপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস। এবারও এই দুই নেতা সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশা আওয়ামী লীগের। এর বাইরেও রয়েছেন ডাঃ আশরাফুল হক চুন্নু এবং নাচোল উপজেলার চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের। সাবেক এমপি জিয়াউর রহমান সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে রয়েছেন এমন দাবি তার সমর্থকদের। তিনি পোস্টার ব্যানারে ছেয়ে ফেলেছেন পুরো নির্বাচনী এলাকা। তবে পিছিয়ে নেই বর্তমান সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তাফা। তার বাবা আব্দুল খালেক বিশ্বাস গোমস্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান থাকায় তার ইমেজ নিয়ে পুত্র মাঠে রয়েছেন। এদিকে বিএনপিতে তারেক রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট বলে প্রচার থাকা বিএনপি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট শিল্পপতি হাজী আমিনুল ইসলাম তিন উপজেলা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এছাড়াও গোমস্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান বাইরুল ইসলাম বিএনপি থেকে নির্বাচন করার কথা বললেও তেমন পদচারণা নেই। জামায়াত এই আসনে সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল হলেও তারা পৃথকভাবে ভোট করার জন্য একমাত্র প্রার্থী দিয়ে রেখেছেন এহিয়া বিশ্বাসকে। এই আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জিয়াউর রহমান ১ লাখ ৫১ হাজার ২৮৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। বিএনপি প্রার্থী আমিনুল ইসলাম পান ১ লাখ ২১ হাজার ৯৬৯ ভোট। ২০১৪ সালের নির্বাচনে গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস পেয়েছিলেন ৯৩ হাজার ৫০৮ ভোট। সাবেক বিএনপি নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে (খুরশিদ আলশ) লড়ে ভোট পান মাত্র ২৯ হাজার ৮৯৬ ভোট। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) ॥ সদরের এই আসনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুল ওদুদ বিশ্বাস। দীর্ঘ সময় তিনি বিএনপির রাজনীতি করলেও বনিবনা না হওয়ার কারণে বেরিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। মনোনয়নও পেয়েও যান আওয়ামী লীগের। তিনি দুইবার এমপি নির্বাচিত হওয়ার সুবাদে এলাকায় অনেক উন্নয়ন করে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। তবে তার পুরাতন সহকর্মীদের বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আনায় দলের ত্যাগী নেতা কর্মীদের কাছে তিনি অপ্রিয় হয়েছেন। তবে মাঠের রাজনীতিতে তিনি খুবই সক্রিয়। সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অতি সহজেই জনসাধারণের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন। তবে সদরে আওয়ামী লীগের বিকল্প নেতৃত্ব না থাকায় তিনি পুনর্বার দলের মনোনয়ন পেতে পারেন বলেই মনে করছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ রুহুল আমিন, তারই এক সময়ের মেয়ের জামাই মাহফুজুর রহমান বেঞ্জু, সামিউল হক লিটন, ডাঃ গোলাম রাব্বানীসহ অনেকেই। তবে সদর আসনে উন্নয়ন কর্মকা-ে আওয়ামী লীগ চমক সৃষ্টি করেছে। তার পুরো বৈশিষ্ট্য বর্তমান এমপি আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস দাবি করলেও তা অমূলক হবে না। এই আসনে বিএনপির জেলা কমিটির মধ্যে রয়েছে অনেক দ্বন্দ্ব। তার পরেও দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হারুন-অর-রশিদ মনোনয়ন বাগাবার ব্যাপারে অনেক এগিয়ে রয়েছে। এর পরেও প্রার্থী হিসেবে চাইনিজ রফিকের নাম শোনা গেলেও দৃশ্যমান কোন ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে না এখন পর্যন্ত। তবে এই আসনে ইতোমধ্যেই জামায়াতের একক প্রার্থী হিসেবে ঢাকা মহানগর নেতা বুলবুলের নাম সর্বত্র শোনা যাচ্ছে। তার পোস্টার ব্যানার ছেয়ে গেছে পুরো শহর। যদিও তিনি কারাগারে তবুও তার নামে বিভিন্ন উপকরণ ও উপঢৌকন বিতরণ অব্যাহত রয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে। সাবেক এমপি লতিফুরের নাম শোনা গেলেও তিনি এখনও পর্দার আড়ালে রয়েছেন। এই আসনে ২০০১ সালে বিএনপি প্রার্থী হারুন-অর-রশিদ ৮৫ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও জামায়াত পেয়েছিল ৬০ হাজার ৪৬০ ভোট। আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ্যাডভোকেট সামশুল হক পান ৫৭ হাজার ২৮৯ ভোট। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জাতায়াতের এই শিবিরে আঘাত হানেন বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আসা আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস। তিনি ১ লাখ ১২ হাজার ৮০২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ও চাচাত ভাই বিএনপির হারুন পান ৮৬ হাজার ১৭৮ ভোট। জামায়াত প্রার্থী লতিফুর রহমান ৭২ হাজার ২৯২ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে চলে যান। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনর্বার নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস। এই আসনে বিএনপি জামায়াত ঐক্যবদ্ধ হয়ে একক প্রার্থী দিতে না পারলে আওয়ামী লীগের বিজয় এবারও ঠেকাতে পারবে না। তবে বহু দৃশ্যমান উন্নয়ন হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের ভোট বেড়েছে বহুগুণ। এদিকে জাতীয় পার্টির গুটি কয়েক চিহ্নিত নেতা ছাড়া কোন সংগঠন নেই। সিপিবির বেশ কিছু নেতা থাকলেও লড়াই করার মতো সংগঠন নেই। অন্যান্য দলের কোন অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
×