ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুঃখের সাগরে জলকন্যা ওুমি

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২৮ জুলাই ২০১৮

 দুঃখের সাগরে জলকন্যা ওুমি

ফারজানা রুমি। যশোর অঙ্কুর কিন্ডার গার্টেনের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। বাবা থেকেও নেই। মা অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। তবে রুমি এই সাধারণ পরিচয় মুছে নিজ কৃতিত্বে ইতিমধ্যে স্বমহিমায় প্রকাশিত হয়েছে। বয়সভিত্তিক সাঁতারে জাতীয় পর্যায়ে সাত স্বর্ণসহ ১৪টি পদক জয় করে কয়রার মেয়ে পেয়েছে জলকন্যার খেতাব। তবে রুমির জীবন শুরুর গল্পটা ছিল নিদারুণ কষ্টের। রীতিমতো বিচ্ছেদের করুণ গল্প। তখন তার বছর ছয়েক বয়স। হঠাৎ বাবা হাকিম তরফদার দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন সংসার পাতেন। মা মারিয়া বেগম যেন অথৈ সাগরে পড়েন। তবে এনিয়ে বোঝার বয়স তখন হয়নি রুমির। তাই মনের সুখে বরাবরের মতো প্রতিদিন সকালে খেলার সঙ্গীদের সঙ্গে নেমে পড়তো শাকবাড়িয়া নদীতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটত। মা মারিয়া বেগমকে রীতিমতো লাঠি হাতে নদী থেকে তাকে তুলতে হতো। মা মারিয়া বেগম বলেন, ‘২০০৯ সালে রুমির বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এরপর সংসারে প্রায় অশান্তি লেগে থাকত। বাধ্য হয়ে ২০১৪ সালে আমি ছেলেমেয়েকে নিয়ে যশোর চলে আসি। শহরের সার্কিট হাউস পাড়ায় একটি বাসা ভাড়া নেই। পরে শহরের বিভিন্ন মেসে রান্নার কাজ করি। ওই সময় রুমিকে অঙ্কুর কিন্ডার গার্টেনে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করি। আর ছেলেটিকে ভর্তি করি একটি মাদ্রাসায়। অঙ্কুর কিন্ডার গার্টেনের প্রধান শিক্ষিকা আকলিমা খাতুন আকলির অনুপ্রেরণায় যশোরে সাঁতার প্রশিক্ষক আব্দুল মান্নানের কাছে সাঁতারের প্রশিক্ষণ নিয়ে রুমি এই পদকগুলো অর্জন করেছে।’ কথা প্রসঙ্গে রুমির মা মারিয়া বেগম জানালেন, তিনি দুইবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে আগের মতো এখন আর কাজ করতে পারেন না। তাই সংসার চালানো তার কাছে এখন এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মাস কয়েক পর রুমির জাতীয় পর্যায়ের খেলা রয়েছে। কিন্তু মা মারিয়া তাকে পুষ্টিকর খাবার দিতে পারছেন না। একটি মেসে রান্নার কাজ আর কয়েকজন শিশুকে কোরআন শরীফ শিক্ষা দিয়ে যা আয় হয় তার অধিকাংশই খরচ হয়ে যায় ঘর ভাড়া দিতে। এছাড়া আছে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ। তাই রুমির খেলা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে তিনি দারুণ সংশয়ে দিনাতিপাত করছেন। জানা যায়, ফারজানা রুমি আন্তঃজেলা মহিলা সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দুটি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্য এবং একটি তামা পদক অর্জন করে। ২০১৫ সালে ৫০ মিটার ব্যাক স্ট্রোকে ও ৫০ মিটার বেস্ট স্ট্রোকে দুটি স্বর্ণপদক অর্জন করে। চলতি বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তৃণমূল সাঁতার প্রতিযোগিতায় সে ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল, এবং ৫০ ও ১০০ মিটার ব্যাক স্ট্রোকে অংশগ্রহণ করে। তিন ইভেন্টেই জিতে নেয় স্বর্ণ পদক। এছাড়া ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল, ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক এবং ৫০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে পায় রৌপ্য পদক। আর ২০০ মিটার ইন্ডিভিজুয়াল মিডলে অংশ নিয়ে তৃতীয় স্থান পায়। সবমিলে সাতটি ইভেন্টেই পদক পেয়ে ফারজানা রুমি দেশ সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়। ফারজানা রুমি এখন স্বপ্ন দেখছে বড় সাঁতারু হওয়ার। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পদক অর্জন করে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি করা ইচ্ছা তার। তবে রাক্ষুসে অভাব তাকে কতদূর যেতে দেবে তাই নিয়ে রয়েছে বড় সংশয়। যশোর জেলা সাঁতার প্রশিক্ষক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পদক অর্জন করার মতো প্রতিভা ফারজানা রুমির মধ্যে আছে। তাকে সঠিক গাইডলাইন, উন্নত প্রশিক্ষণ আর আর্থিক সহযোগিতা দিতে পারলেই দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলবে ফারজানা রুমি।’ -সাজেদ রহমান, যশোর, থেকে
×