ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী তৎপরতা থেমে নেই, নাশকতার নতুন ছক

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৪ জুলাই ২০১৮

 জঙ্গী তৎপরতা থেমে নেই, নাশকতার নতুন ছক

গাফফার খান চৌধুরী ॥ এখনও দেশে জঙ্গীবাদের তালিম দিতে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর গ্রেফতার হওয়া বহুল আলোচিত মাদ্রাসা শিক্ষক নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক খান ওরফে আব্দুল্লাহ ও জঙ্গী সংগঠনটির আধ্যাত্মিক নেতা কারাবন্দী মুফতি মাওলানা জসীমুদ্দিন রাহমানীর জিহাদী বইপুস্তক পড়ানো হয়। জঙ্গী তৈরির তৎপরতা থেমে নেই। এখনও গোপনে ঢাকা ও আশপাশের কয়েকটি জেলার অন্তত অর্ধশত মাদ্রাসায় জিহাদী বইপুস্তক পড়ানো হচ্ছে। এই দুই জঙ্গী নেতার বই পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েই জঙ্গীরা গত কয়েক বছরে লেখক, প্রকাশক, ব্লগার, বিদেশীসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষকে হত্যা করেছে। নতুন করে নাশকতার পরিকল্পনা করছে। কোন কোন মাদ্রাসায় জঙ্গী তৈরি করা হচ্ছে তা জানার চেষ্টা করছে গোয়েন্দারা। এজন্য সদ্য গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী মাওলানা ইসহাক খান ওরফে আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে র‌্যাব। গত ১০ জুলাই র‌্যাব-৩ এর একটি দল মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানাধীন ইরতা কাশিমপুর গ্রাম থেকে মোহাম্মদ ইসহাক খান ওরফে আব্দুল্লাহকে (৩২) গ্রেফতার করে। উদ্ধার হয় বিপুল জিহাদী বই। র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এমরানুল হাসান জনকণ্ঠকে জানান, ২০০৬ সালে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসা থেকে দাওরা হাদিস পাস করেন ইসহাক। ওই সময় মাদ্রাসাটির শিক্ষক ছিলেন নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বর্তমানে আনসার আল ইসলামের কারাবন্দী আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি মাওলানা জসীমুদ্দীন রাহমানী। রাহমানীর একান্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ছাত্র ইসহাক। রাহমানীর সঙ্গে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে উগ্রবাদী প্রচার ও দাওয়াতে অংশগ্রহণ করেছেন। রাহমানীর জুমা’র খুতবাসহ বিভিন্ন বয়ান, জঙ্গীবাদের উপর তার এবং আল কায়েদা নেতা আনোয়ার আল আওলাকির লেখা বিভিন্ন বক্তব্য বয়ান পুস্তক আকারে বের করার উদ্যোগ নেন ইসহাক। এজন্য ঢাকার বাংলাবাজারে ইসলামী টাওয়ারে খান প্রকাশনা খোলেন। সেখান থেকে মুফতি মাওলানা জসীমুদ্দিন রাহমানী, আল কায়েদা নেতা আওয়ার আল আওলাকির বক্তব্য বাংলায় অনুবাদ করে পুস্তক আকারে বের করে তা বিভিন্ন মাদ্রাসায় সরবরাহ করতেন। এছাড়া ইউটিউবে এমডি ইসহাক খান নামে বিভিন্ন জঙ্গীবাদী লেকচারের অডিও ক্লিপ রয়েছে। লাইট হাউস ডট কম নামীয় ব্লগ পেজে তার উগ্রবাদী মতবাদ প্রচার করতেন। এভাবেই মাওলানা ইসহাক জঙ্গীবাদের জন্য কাজ করে আসছিলেন। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় ২০১৩ সালে। ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয় যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এমন রায়ের প্রতিবাদে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ঢাকার শাহবাগে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিকভাবে ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। এ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ছিলেন প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন (৩৭)। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে আটটায় ঢাকার পল্লবী থানাধীন পলাশ নগরের ৫৬/৩ নম্বর নিজ বাড়ির সামনেই রাজীবকে ছুরিকাঘাতে ও জবাই করে হত্যা করা হয়। শাহবাগে রাজীবের জানাজা আদায়কারী ইমামকে হত্যার হুমকি দেয় শফিউর রহমান ফারাবি নামে এক শিবির কর্মী। ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেফতারের পর ফারাবির তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ১ মার্চ রাজীব হত্যায় জড়িত রাজধানীর বনানীর বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল এ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের সাত ছাত্রের মধ্যে ৫ ছাত্র ঢাকার খিলক্ষেত চৌধুরীপাড়ার ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দ্বীপ (২২), ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার পোড়াপাড়া গ্রামের এহসান রেজা ওরফে রম্মন (২৩), ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানার ধলেশ্বর গ্রামের মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক (২৩), ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কলেজপাড়ার নাঈম শিকদার ওরফে ইরাদ (১৯) ও চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার হারামিয়া গ্রামের নাফিজ ইমতিয়াজ (২২) গ্রেফতার হয়ে রাজীব হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দেয়। এ মামলার আরেক আসামি ঢাকার কলাবাগান থানার ভুতের গলির সাদমান ইয়াছির মাহমুদ (২০) পরে গ্রেফতার হয়। আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে হত্যাকারীরা জানায়, তারা মুফতি মাওলানা জসীমুদ্দিন রাহমানীর বই পড়ে এবং সরাসরি তার বয়ান ও খুতবায় অংশ নিয়ে ‘নাস্তি¡ক ব্লগারদের হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত হয়। হত্যার জন্য তারা অনুতপ্ত নয়। রাহমানী ব্লগার রাজিব হত্যার মূল উৎসাহদাতা। এরপর থেকে দেশে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বর্তমানে আনসার আল ইসলামের জঙ্গীদের হাতে একের পর এক ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, বিদেশীসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ খুন হতে থাকে। রাহমানীর বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানোর পর রাহমানীর পাশাপাশি মাওলানা ইসহাক খানের লেখা বহু জঙ্গীবাদী বইপুস্তক জব্দ হয়। কিন্তু কে এই মাওলানা ইসহাক তা এতদিন অজানাই ছিল। রাজীব হত্যার ঘটনায় ২০১৩ সালে জসীমুদ্দীন রাহমানী গ্রেফতার হওয়ার পর আবারও মাওলানা ইসহাক খানের নাম প্রকাশ পায়। র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক জানান, দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর জানা যায় গত দুই বছর ধরে মানিকগঞ্জে নিজের নাম পরিবর্তন করে আব্দুল্লাহ রেখে জঙ্গীবাদী মতবাদ প্রকাশ ও মাদ্রাসা স্থাপন করে ছাত্রদের জঙ্গীবাদের দিকে নিয়ে যাওয়ার কাজ করছিলেন ইসহাক। মাওলানা জসীমুদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে তার নাম প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই তিনি আত্মগোপনে চলে যান। সব প্রযুক্তির বাইরে ছিলেন তিনি। কোন প্রকার মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন না। মানিকগঞ্জের যে বাড়িতে তিনি বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িটি একটি বিলের মধ্যে অবস্থিত। বাড়িতে যাওয়ার মতো শুধু একটি হেঁটে চলার রাস্তা আছে। অনেক দূর থেকেই সেই পথে কে বা কারা যাতায়াত করে তা দেখা যায়। সেখানে আব্দুল্লাহ নামে পরিচিত হয়ে মারকাজুল কোরান ওয়াল হিকমাহ নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। তিনি সেই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক। মাদ্রাসাটিতে ৪০ জনের মতো স্থায়ী ছাত্র আছে। এছাড়া বেশ কিছু অস্থায়ী ছাত্র আছে। স্থায়ী ছাত্রদের জঙ্গীবাদের বিষয়ে দীক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন তিনি। ইসহাকের খান প্রকাশনীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একাধিকবার হানা দিলে সে মাকবুল প্রকাশনী নামে আরেকটি প্রকাশনা সংস্থা খোলেন। সেখান থেকে জঙ্গীবাদের উপর তার, মাওলানা জসীমুদ্দিন রাহমানী ও আল কায়েদা নেতা আনোয়ার আল আওলাকির লেখা বই প্রকাশ করতেন। সেসব বই তিনি নিজেই মানিকগঞ্জ, ঢাকা ও গাজীপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোর যেসব মাদ্রাসায় জঙ্গীবাদের উপর পড়াশুনা করানো হয়, সেখানে নিজে গিয়ে পৌঁছে দিতেন। তার ভাই মোঃ আশরাফ আলী খান আনসার আল ইসলামের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তার আরেক ভাই রাকিব নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর সক্রিয় সদস্য। গ্রেফতার হয়ে বর্তমান জেল হাজতে আছে। র‌্যাব কর্মকর্তা বলছেন, মাওলানা ইসহাকের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দায়ের করে থানা পুলিশের মাধ্যমে রিমান্ডে নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। মামলাটির তদন্ত করতে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করছেন।
×