ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দশম সংসদ বিষয়ে টিআইবির পার্লামেন্টওয়াচ রিপোর্টে তথ্য

এমপিদের গড় উপস্থিতি বাড়লেও কোরাম সঙ্কট অপরিবর্তিত

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ১৮ মে ২০১৮

এমপিদের গড় উপস্থিতি বাড়লেও কোরাম সঙ্কট অপরিবর্তিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দশম জাতীয় সংসদের চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ অধিবেশনের গড় বৈঠককাল এবং প্রতি কার্যদিবসে সদস্যদের গড় উপস্থিতির হার অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদের একই অধিবেশনগুলোর তুলনায় বৃদ্ধি পেলেও কোরাম সঙ্কট প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। এছাড়া আইন প্রণয়নে জনমত গ্রহণের বিদ্যমান পদ্ধতিগুলোর সীমিত প্রয়োগ, সংসদীয় উন্মুক্ততা চর্চার ঘাটতি, সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিরোধী দলের ব্যর্থতা লক্ষণীয়। সেইসঙ্গে আইন প্রণয়নে ব্যয়িত মোট সময়ের শতকরা হার পূর্বের তুলনায় হ্রাস পাওয়াসহ একাধিক কারণে সংসদের প্রত্যাশিত কার্যকরতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত দশম জাতীয় সংসদের চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ অধিবেশনের কার্যক্রমের ওপর টিআইবির পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদন ‘পার্লামেন্টওয়াচ’ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাপ্ত ফলে এ চিত্র ওঠে আসে। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে সংসদকে কার্যকর করতে ১৪ দফা সুপারিশ উত্থাপন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। সংস্থার ধানম-িস্থ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোর্শেদা আক্তার ও নিহার রঞ্জন রায় এবং এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার অমিত সরকার। সংশ্লিষ্ট গবেষক দলের অপর সদস্য টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি এ সময় উপস্থিত ছিলেন। গবেষণায় জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ’১৭ পর্যন্ত দশম সংসদের চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ অধিবেশনের বিভিন্ন পরিমাণবাচক এবং গুণবাচক তথ্য সংগৃহীত হয়। প্রত্যক্ষ তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সংসদ টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত সংসদ কার্যক্রম। এছাড়া পরোক্ষ তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয় সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত অধিবেশনের সংক্ষিপ্ত কার্যবিবরণী ও কমিটি প্রতিবেদন, সরকারী গেজেট, প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন, বই, প্রবন্ধ ও সংবাদপত্রের তথ্য। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, সংসদ অধিবেশন পরিচালনা করতে প্রতি মিনিটে গড় ব্যয় হয় এক লাখ ৬৩ হাজার ৬৮৬ টাকা। প্রতিবেদনে জানানো হয়, দশম সংসদের চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ অধিবেশনের (জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০১৭) কোরাম-সঙ্কট অষ্টম ও নবম সংসদের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বলা হয়, এবারের কোরাম-সঙ্কট ছিল ৩৮ ঘণ্টা তিন মিনিট। এর অর্থমূল্য ৩৭ কোটি ৩৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৩৮ টাকা। অন্যদিকে, দশম সংসদের চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ অধিবেশনের মোট ৭৬ কার্যদিবসের উপস্থিতির তথ্য বিশ্লেষণ করে টিআইবি জানায়, সার্বিকভাবে সংসদ সদস্যদের গড় উপস্থিতি প্রতি কার্যদিবসে ৩০৯ যা মোট সদস্যের ৮৮ শতাংশ। এতে সময় ব্যয় হয় ২৬০ ঘণ্টা ৮ মিনিট। কার্যদিবস প্রতি গড় বৈঠককাল প্রায় ৩ ঘণ্টা ২৫ মিনিট। সবচেয়ে বেশি ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ বাজেট আলোচনায় ব্যয়িত হয়। অন্যান্য পর্বের মধ্যে আইন প্রণয়নে ৯ শতাংশ, প্রশ্নোত্তর পর্বে মোট ১৪ দশমিক ১ শতাংশ সময়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দশম সংসদের চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ-এই পাঁচটি অধিবেশনে নবম সংসদের একই অধিবেশনগুলোর তুলনায় সংসদ নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতাসহ সাধারণ সদস্যদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া অধিবেশনের গড় বৈঠককালের ক্ষেত্রেও বৃদ্ধি লক্ষণীয়। এ সকল ইতিবাচক পরিবর্তন সত্ত্বেও অধিবেশনগুলোতে মন্ত্রীদের উপস্থিতি হ্রাস পাওয়াসহ বেশকিছু চ্যালেঞ্জ লক্ষণীয়। পাঁচটি অধিবেশনের প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সঙ্কট ৩০ মিনিট, নবম জাতীয় সংসদের একই অধিবেশনগুলোর প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সঙ্কট ছিল ৩২ মিনিট। কার্যপ্রণালি বিধি ২৭০ এর ৬ উপবিধি লঙ্ঘন করে সরকার ও বিরোধীদলীয় সদস্যদের অসংসদীয় আচরণ ও ভাষার ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। আইন প্রণয়নে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের তুলনামূলক বেশি অংশগ্রহণ থাকলেও তাদের মতামত ও প্রস্তাব যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি এবং আইন প্রণয়নে জনমত গ্রহণের বিদ্যমান পদ্ধতিগুলোর প্রয়োগের ঘাটতির ফলে জন-অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত ছিল। এছাড়া প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে অধিবেশনে উপস্থাপিত না হওয়ার চর্চা অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক আলোচিত হত্যাকা-, জঙ্গী-তৎপরতা, বাজেটে প্রস্তাবিত বিষয়ের ওপর গঠনমূলক সমালোচনা, আর্থিক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিস পর্বে আলোচিত হলেও সদস্যদের একাংশের বক্তব্যে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার ও আচরণে বিধির ব্যত্যয় লক্ষণীয়। নারী সদস্যদের উপস্থিতি পুরুষ সদস্যের তুলনায় বেশি হলেও অধিকাংশ পর্বের আলোচনায় নারী সদস্যদের অংশগ্রহণের হার তুলনামূলক কম ছিল। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বসহ জনগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পর্বে নারী সংশ্লিষ্ট কোন বিষয় উত্থাপিত হয়নি। সরকারী ও বিরোধী উভয় দলের সদস্যদের বক্তব্যে বাজেটে প্রস্তাবিত বিষয়ের ওপর গঠনমূলক সমালোচনা হলেও সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা লক্ষণীয়। অপরপক্ষে সংসদীয় কমিটির নিয়মিত সভা অনুষ্ঠানের সংখ্যা তুলনামূলক বৃদ্ধি পেলেও কমিটি সদস্যদের একাংশের স্বার্থের দ্বন্দ্ব^, কমিটির একাংশের বিধি অনুযায়ী নিয়মিত সভা না হওয়া, কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্বারোপে ঘাটতি এবং সংসদের কার্যবিবরণী ও কমিটি প্রতিবেদনসমূহের উন্মুক্ততা ও অভিগম্যতার ঘাটতি ইত্যাদি চ্যালেঞ্জসমূহ লক্ষণীয় ছিল। সংসদ অধিবেশনে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার ও কোরাম সঙ্কট অব্যাহত থাকার বিষয়কে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সুশাসন ও জাবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে সংসদের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। সরকারী ও বিরোধী উভয় দলই এ ব্যর্থতার জন্য দায়ী। সংসদে বিরোধী দল হিসেবে যারা নিজেদের দাবি করেন বা যাদের উপস্থাপন করা হয় আত্মপরিচয় নিয়ে তাদের মধ্যে সৃষ্ট সঙ্কট বর্তমান সংসদের মেয়াদের শেষ বছরে তারা নিজেরাই স্বীকার করেছেন।’ সংসদকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর জনগণের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, কমিটিগুলোতে আলোচিত সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের সঙ্গে কমিটিগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের স্বার্থ জড়িত থাকার কারণে কার্যকর ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সরকারকে জনগণের নিকট জবাবদিহি করার মৌলিক দায়িত্ব পালনে কমিটিগুলোর একাংশের কার্যকরতার ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।’ দশম সংসদের পাঁচটি অধিবেশন সময়ে ৫০ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মধ্যে ছেচল্লিশটির সভা হলেও চারটি কমিটির কোন সভা হয়নি। বিধি অনুযায়ী প্রতি মাসে ন্যূনতম একটি করে সভা হয়েছে ৪২ কমিটির। এর মধ্যে সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সর্বোচ্চ ৫২ সভা হয়েছে। হলফনামার তথ্য অনুযায়ী আটটি কমিটিতে সদস্যদের স্বার্থের সংঘাত সম্পর্কিত সম্পৃক্ততা দেখা যায় যা কার্যপ্রণালি বিধির লঙ্ঘন। ৫০ স্থায়ী কমিটির মধ্যে ষোলটি কমিটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ১১ কমিটির সদস্যদের সার্বিক গড় উপস্থিতি ৫৬ শতাংশ, ৫ কমিটির প্রতিবেদনে উপস্থিতি সংক্রান্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়নি। প্রকাশিত প্রতিবেদনের ৪১ শতাংশ সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ৪৬ শতাংশ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দশম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের সভাপতিকে সরকারের বিভিন্ন কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করাসহ দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে দলীয় ফোরাম ও জনসভায় জোরালো বক্তব্য দিতে দেখা গেলেও সংসদীয় কার্যক্রমে এ সকল বিষয়ে তার অনুরূপ ভূমিকার ঘাটতি লক্ষণীয়। বর্তমান সংসদের মোট ১৮ অধিবেশনের ৩২৭ কার্যদিবসের মধ্যে তিনি উপস্থিত ছিলেন ৭৯ কার্যদিবস (২৪ শতাংশ)। সরকারী প্রটোকল ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের জন্য বিশেষ ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাসহ প্রতি মাসে গড়ে পাঁচ লাখ টাকা সরকারী ব্যয় হলেও দায়িত্ব পালনে তাঁর ভূমিকা লক্ষণীয় নয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশে ব্যক্তিগত সফর করলেও বিশেষ দূত হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনে ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।
×