উত্তম চক্রবর্তী, লন্ডন থেকে ॥ জাতিসংঘের পর কমনওয়েলথ সম্মেলনেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে সদস্যভুক্ত দেশগুলোর জোরালো সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ইস্যুতে সম্মেলনে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুই ছিলেন তিনি। ২৪০ কোটি জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী কমনওয়েলথভুক্ত ৫৩ দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানরাও এ ইস্যুতে সম্মেলনে বাংলাদেশের পাশে থাকার ব্যাপারে তাদের সমর্থনের কথা বেশ জোরের সঙ্গেই জানিয়েছেন। সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অপরাধীদের স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়ায় বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ থেকে উত্থাপিত একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে কমনওয়েলথ সম্মেলনে। নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে টেকসই প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ তৈরির জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি জোরালো দাবি উঠেছে কমনওয়েলথ সম্মেলন থেকে।
কমনওয়েলথ সম্মেলনে একদিকে যেমন সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানরা অসহায়-নির্মম নির্যাতনের শিকার ১০ লক্ষাধিক উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে বাংলাদেশে সাময়িক আশ্রয় প্রদানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ, ঠিক তেমনি আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে দেশটির ওপর চাপ সৃষ্টির ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন কমনওয়েলথ সম্মেলনে বিশ্বের বাঘা বাঘা সরকার প্রধানরা।
যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে কমনওয়েলথ সম্মেলনে আন্তঃযোগাযোগ, সাইবার ক্রাইম এবং সমুদ্রসীমায় সম্পদ রক্ষার ব্যাপারে সদস্য দেশগুলো বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব গ্রহণ করলেও বিভিন্ন কর্ম অধিবেশনে ঘুরে ফিরেই এসেছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি। পার্শ্ববর্তী বন্ধু প্রতীম দেশ ভারতের অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলেও কমনওয়েলথ সম্মেলনে এসে সেই দ্বিধা অনেকটাই কাটিয়ে দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদি নিজেই।
দু’দেশের দুই শীর্ষ নেত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একান্ত বৈঠকে এ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ভারত যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আগের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে তা বৈঠক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বেশ আস্থার সঙ্গেই জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক।
দুই দিনব্যাপী শীর্ষ সম্মেলন শুক্রবারই শেষ হয়েছে। জানা গেছে, কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত রেজ্যুলেশনেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। এতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার প্রতি কমনওয়েলথ সদস্য দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানরা পূর্ণসংহতি জ্ঞাপন করেছেন। একইসঙ্গে শীর্ষ সম্মেলন থেকে অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়া বাস্তুচ্যুত এ জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশ এবং দেশটির সরকার প্রধান শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে গৃহীত রেজ্যুলেশনে।
কমনওয়েলথ সম্মেলনে উপস্থিত থাকা একাধিক সূত্র জানায়, শীর্ষ সম্মেলন ছাড়াও সাইড লাইন একাধিক কর্ম অধিবেশনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সমর্থন এবং বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির ব্যাপারে কমনওয়েথ দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। এ প্রস্তাবটি সমর্থন করে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জ্যাস্টিন ট্রুডোসহ বেশ কয়েকটি দেশ তাৎক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করে বাংলাদেশের পাশে থাকার ব্যাপারে তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
সম্মেলনের একাধিক কর্ম অধিবেশনে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব সর্বসম্মতক্রমে গ্রহণের বিষয়ে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। ওই প্রস্তাবে কমনওয়েলথ রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করা ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। একইসঙ্গে স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতেও সম্মেলনে সরকার প্রধানরা জোর দাবি জানান।
জানা গেছে, সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রস্তাব থাকছে। এতে জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশনস হাইকমিশন ফর রিফিউজির মাধ্যমে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বাস্তুচ্যুত মিয়ামনারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের টেকসই প্রত্যার্বতনের আহ্বান জানানো হতে পারে। একইসঙ্গে নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে টেকসই প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ তৈরিরও আহ্বান থাকছে তাতে। শীর্ষ সম্মেলন থেকে কমনওয়েলথ রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণ খুঁজে বের করা এবং শীঘ্রই রাখাইন এ্যাডভাইজারি কমিশনের (কোফি আনান কমিশন) সুপারিশ বাস্তবায়নের জোর তাগিদ দেয়া হতে পারে।
সূত্র জানায়, শীর্ষ সম্মেলন শেষে লন্ডনের স্থানীয় সময় সন্ধ্যার পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে গৃহীত রেজ্যুলেশন সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানানো হবে। এতে শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে কী কী সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে তাও আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হতে পারে। পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকও সংবাদ সম্মেলনে বেশ জোরের সঙ্গে জানিয়েছিলেন, কমনওয়েলথ সম্মেলনেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: